রবে নীর্বে by এম আফজাল হোসেন

আজ আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পরমাণু বিজ্ঞানী ড. এমএ ওয়াজেদ মিয়া আমাদের ছেড়ে চলে যাওয়ার তিন বছর পূর্তি হলো। জীবিতকালেও তাকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছিল। প্রায় ২৮ বছর আগে মূলত আমার স্ত্রীর চাকরির সূত্র ধরেই পরিচয়।


ওয়াজেদ ভাই কোনো তদবির পছন্দ করতেন না। আমার স্ত্রীকে বলতেন, মাছের পেটি খাওয়ালেও তোমাকে কোনো প্রমোশন দিতে পারব না। এই ছিলেন নির্ভীক, অকৃত্রিম ও স্পষ্টবাদী ওয়াজেদ মিয়া। তিনি শুধু বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী ছিলেন না, তিনি ছিলেন নির্লোভ, নিভৃতচারী, আদর্শবান, সৎ, সহজ-সরল ও বিনয়ী একজন মানুষ।
আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পরমাণু বিজ্ঞানী ড. এমএ ওয়াজেদ মিয়া ১৯৪২ সালে রংপুর জেলার পীরগঞ্জ উপজেলার ফতেহপুর গ্রামে একটি সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার ডাক নাম ছিল সুধা মিয়া। বাল্যকাল থেকেই তিনি মেধাবী ছাত্র ছিলেন এবং সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। তিনি উলেল্গখযোগ্যসংখ্যক পদার্থ বিজ্ঞানের পাঠ্যবই এবং রাজনৈতিক বইয়ের রচয়িতা ছিলেন। শুধু তাই নয় স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা, কিংবদন্তির মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জ্যেষ্ঠ কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার স্বামী ওয়াজেদ মিয়া একজন বহুমাত্রিক গুণের অধিকারী ছিলেন।
বাংলাদেশের বিশিষ্ট পরমাণু বিজ্ঞানী ড. ওয়াজেদ মিয়া ১৯৫৬ সালে পূর্ব পাকিস্তান শিক্ষা বোর্ডের আওতায় রংপুর জিলা স্কুল থেকে ডিস্টিংশন নিয়ে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। ১৯৫৮ সালে রাজশাহী সরকারি কলেজ থেকে মেধা তালিকায় দ্বিতীয় স্থান নিয়ে আইএসসি পাস করেন। এরপর ১৯৬১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিদ্যা বিভাগে অনার্স পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে দ্বিতীয় স্থান এবং ১৯৬২ সালে মাস্টার্স পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করেন। ১৯৬৭ সালে ইংল্যান্ডের ডরহাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিদ্যায় পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন।
ষাটের দশকে বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকার মাধ্যমে তার রাজনৈতিক জীবন শুরু। তিনি ১৯৬১-৬২ সালে ছাত্রলীগের নেতা হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলের ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন। সে সময় অর্থাৎ ১৯৬২ সালে আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে তিনি গ্রেফতার হন এবং কিছুদিন জেলও খাটেন। ১৯৬৭ সালের ১৭ নভেম্বর তিনি জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনাকে বিয়ে করেন; কিন্তু বঙ্গবন্ধু তখন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় কারাগারে বন্দি ছিলেন। বিয়ের পর জেলগেটে বঙ্গবন্ধু নবদম্পতিকে আশীর্বাদ করেন। বঙ্গবন্ধু পরিবারের এই দুঃসহ ও শোচনীয় অবস্থায় তিনি বঙ্গবন্ধুকন্যাকে বিয়ে করে তার চারিত্রিক দৃঢ়তা, ভ্রাতৃত্ববোধ ও সত্যিকারের একজন দেশপ্রেমিকের পরিচয় দিয়েছেন। ১৯৭১ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হওয়ার পর তিনি হয়ে ওঠেন গোটা পরিবারের কাণ্ডারি। সরাসরি রাজনীতিতে সম্পৃক্ত না হয়েও যে রাজনীতিতে যথেষ্ট অবদান রাখা যায় তা প্রমাণ করে দিয়েছেন ড. ওয়াজেদ মিয়া।
শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার পর তিনি আওয়ামী লীগের আর কোনো সক্রিয় সাংগঠনিক পদ গ্রহণ করেননি। তিনি আমাদের এটাই শিক্ষা দিয়েছেন যে, ক্ষমতার বৃত্তে বসবাস করেও ক্ষমতার উত্তাপ তাকে স্পর্শ করতে পারেনি কোনোদিন।
ওয়াজেদ মিয়ার অবদান ও আদর্শ বাংলাদেশের বিজ্ঞান জগতে পাথেয় হয়ে থাকবে। বাংলাদেশের বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানজীবী সংগঠনগুলোকে ক্রিয়াশীল এবং শক্তিশালী করার পক্ষে তার গভীর দর্শন ও চিন্তাধারা ছিল। আমাদের নতুন প্রজন্মের স্বার্থে ওয়াজেদ মিয়ার স্মৃতিকে তাদের কাছে চিরস্মরণীয় করে রাখতে হবে। এ জন্য তাদের বিজ্ঞানচর্চা ও বিজ্ঞানমুখী করতে হবে। তাকে অনুকরণ করে আগামী প্রজন্ম বিজ্ঞানে, অর্থনীতিতে ও সংস্কৃতিতে শক্তিশালী হয়ে বাংলাদেশকে উন্নত দেশের কাতারে তুলবে। তবেই খ্যাতিসম্পন্ন বিজ্ঞানী ড. ওয়াজেদ মিয়ার চিন্তা-চেতনা, প্রজ্ঞা, গবেষণা, কর্ম ও দর্শন সফলতার মুখ দেখবে। বিশিষ্ট পরমাণু বিজ্ঞানী ড. ওয়াজেদ মিয়ার স্বপ্ন ছিল রূপপুরে একটি আণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করার। রূপপুরের আণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি তারই নামে হওয়া উচিত।

প্রফেসর ড. এম আফজাল হোসেন উপাচার্য, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, দিনাজপুর
mafzal07@yahoo.com
 

No comments

Powered by Blogger.