* পাচারে ট্রাকচালকদের ট্যাংকি কৌশল * দৈনিক যায় দেড় লাখ লিটার ডিজেল-ভর্তুকির তেল পাচার হচ্ছে ভারতে by ওমর ফারুক

বাংলাদেশের চেয়ে ভারতে জ্বালানি তেলের দাম বেশি। সেই সুযোগে প্রতিদিন দেশ থেকে দেড় লক্ষাধিক লিটার জ্বালানি তেল পাচার হয়ে যাচ্ছে ভারতে। এই পাচারের নেপথ্যে রয়েছে রপ্তানি পণ্যবাহী ট্রাকের চালকরা। ভারত সীমান্তে রপ্তানি পণ্য পৌঁছে দেওয়ার সময় কৌশলে চলে তাদের তেল পাচার।


দেশে গাড়ির ট্যাংকিতে তেল (ডিজেল) ভরা হয়। এরপর ওপারে গিয়েই চালকরা সে তেল বের করে বিক্রি করে দেয় চড়া দামে। এ ছাড়া কোনো কোনোট্রাক চালক পণ্যের ভেতরে লুকিয়ে রাখা কনটেইনারে করে শত শত লিটার ডিজেল পাচার করে বলেও তথ্য মিলেছে। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) কর্মকর্তা ও ট্রাকচালকদের সঙ্গে কথা বলে এবং সীমান্ত এলাকা ঘুরে এই চিত্র পাওয়া গেছে। তবে বিজিবি কর্মকর্তারা বলেছেন, তেল পাচার রোধে সীমান্ত এলাকার পেট্রল পাম্পগুলো তাঁরা নজরদারিতে রেখেছেন।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) চেয়ারম্যান মো. আবু বকর সিদ্দিক কালের কণ্ঠকে বলেন, পাচার রোধ করা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও বিজিবির ব্যাপার। ভর্তুকি দেওয়ার কারণে দেশের সব পর্যায়ের লোকজন সুবিধা ভোগ করে থাকে। সবার ক্রয় ক্ষমতার কথা চিন্তা করে সরকার তেলে ভর্তুকি দিচ্ছে। যারা দেশের ভালো চায় না, দেশাত্মবোধ নেই তারাই তেল পাচার করে থাকে। এ বিষয়ে সবাইকে সচেতন করতে বিপিসির তরফ থেকে বিজ্ঞাপন দেওয়া হচ্ছে। তিনি জানান, জ্বালানি তেল আমদানির পর কম দামে বিক্রি করতে গিয়ে প্রতি মাসে বিপিসি গড়ে এক হাজার ১০০ থেকে এক হাজার ২০০ কোটি টাকা লোকসান দিচ্ছে। ডিজেল ক্রয়/আমদানি মূল্য ৮৫ থেকে ৮৭ টাকা, খুচরা বিক্রি হয় ৬১ টাকা। ভর্তুকি দেওয়া হয় ২৪ থেকে ২৬ টাকা।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, একটি ট্রাক কতটুকু তেল নিয়ে ভারত সীমান্তে প্রবেশ করছে আর বেরিয়ে আসার সময় কতটুকু নিয়ে আসছে, তা কাস্টমসের দেখার দায়িত্ব। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ঊর্ধ্বতন কাস্টমস কর্মকর্তা সেটি অস্বীকার করে বলেন, কাস্টমসের মূল দায়িত্ব হলো যে পণ্য আসা-যাওয়া করছে সেগুলো বৈধ না অবৈধ তা দেখা। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, সীমান্তে চোরাচালান রোধে 'আঞ্চলিক চোরাচালানবিরোধী টাস্কফোর্স' রয়েছে। সেখানে বিজিবি, পুলিশ, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন বিভাগের কর্মকর্তারা সদস্য।
গত ৭ এপ্রিল দুপুরে কুমিল্লার বিবিরচর স্থলবন্দরে গিয়ে দেখা যায়, অন্তত ৫০টি ট্রাক অপেক্ষা করছে ভারতে মাল পৌঁছে দেওয়ার জন্য। কোনোটিতে সিমেন্ট, কোনোটিতে পাথর। বিবিরবাজার জিরো লাইনে গিয়ে দেখা মেলে এক বিএসএফ সদস্যের। তিনি ট্রাক তদারকি করছেন। তাঁর টাইটেল শোল্ডারে হিন্দিতে 'বিএসএফ' লেখা রয়েছে। দেখা গেল, একটি ট্রাক বাংলাদেশের দিক থেকে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি চালকের কাছ থেকে কাগজপত্র নিয়ে দেখছেন। এরপর তিনি ট্রাকটি ভেতরে যেতে দেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বিবিরবাজার দিয়ে ভারতের সীমান্ত রেখা পার হওয়া বেশির ভাগ ট্রাকের চালকই সেখানে তার চালানো ট্রাকের ট্যাংকি থেকে তেল বিক্রি করে আসে। কেউ কেউ ট্রাক থেকে দুই থেকে আড়ই শ লিটার তেলও বিক্রি করে থাকে। প্রতি লিটারে তাদের লাভ হয় চার থেকে পাঁচ টাকার মতো। যশোরের বেনাপোল, সাতক্ষীরার ভোমরা, চাঁপাইনবাবগঞ্জের সোনা মসজিদ, সিলেটের তামাবিলসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় ২৯টি স্থলবন্দর চালু আছে। আর এসব স্থলবন্দর দিয়ে প্রতিদিন গড়ে এক হাজারের বেশি ট্রাক রপ্তানি পণ্য নিয়ে ভারতে প্রবেশ করে। এ ক্ষেত্রে প্রায় ৯৫ ভাগ চালকই সেখানে জ্বালানি তেল বিক্রি করে আসে বলে একাধিক সূত্রে নিশ্চিত হওয়া গেছে। এক হিসাবে দেখা যায়, এক হাজার ট্রাকের প্রতিটি থেকে গড়ে দেড় শ লিটার করে তেল বিক্রি করলে প্রতিদিন এক লাখ ৫০ হাজার লিটার তেল পাচার হয়ে যাচ্ছে। এভাবে মাসে প্রায় ৪৫ লাখ লিটার তেল ভারতে পাচার হয়ে যাচ্ছে।
টেলিফোনে যোগাযোগ করা হলে বিজিবির কুমিল্লা সেক্টর কমান্ডার কর্নেল মো. রুস্তম আলী কালের কণ্ঠকে বলেন, 'সীমান্তের আট কিলোমিটারের মধ্যে যেসব পেট্রল পাম্প আছে সেগুলো কত তেল বিক্রি করছে তার খোঁজ রাখছে বিজিবি। তেল বিক্রিতে অস্বাভাবিকতা রয়েছে কি না, এসব নজরদারি করা হয়। তিনি বলেন, 'কুমিল্লা সেক্টরের অধীনে ফেনী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও কুমিল্লা এলাকায় ১৫-১৬টি পেট্রল পাম্প রয়েছে সীমান্তের আট কিলোমিটারের মধ্যে। এগুলোর ব্যাপারে নিয়মিত খোঁজখবর রাখছি আমরা।'
ভারতে পণ্য নিয়ে যাওয়া একটি ট্রাকের চালক শফিক তেল বিক্রির কথা স্বীকার করে কালের কণ্ঠকে জানান, 'পণ্য খালাসের সময় সেখানে অনেক চালকই ডিজেল বিক্রি করে দেয়। দেশে যে টাকায় তেল (ডিজেল) কেনা হয় তার থেকে পাঁচ টাকা করে বেশি দামে বিক্রি করে আসা যায়। ২০০ লিটার তেল বিক্রি করলে এক হাজার টাকা লাভ পাওয়া যায়।'
যে কারণে পাচার হচ্ছে
বাংলাদেশের চেয়ে ভারতে তেলের দাম বেশি হওয়ার কারণেই তেল পাচার হচ্ছে বলে মনে করেন অনেকে। তেজগাঁওয়ের শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ সরণির সিটি ফিলিং স্টেশনের কর্মী ফিরোজ কালের কণ্ঠকে জানান, বর্তমানে ডিজেল ৬১ টাকা, পেট্রল ৯১ ও অকটেন ৯৪ টাকা লিটার দরে বিক্রি হচ্ছে। কালের কণ্ঠের কলকাতা প্রতিনিধি সুব্রত আচার্য্য জানিয়েছেন, ভারতে বর্তমানে প্রতি লিটার ডিজেল ৪৩ দশমিক ৭৬, পেট্রল ৭০ দশমিক ০৬ ও অকটেন ৭৩ দশমিক ১১ রুপি দরে বিক্রি হয়। ভারতে অকটেনকে পাওয়ার হিসেবে উল্লেখ করা হয়। বাংলাদেশি টাকায় ভারতে প্রতি লিটার ডিজেলের মূল্য দাঁড়ায় ৭০ দশমিক ২৪ টাকা, পেট্রলের ১১৩ ও অকটেনের ১১৭ টাকা। এই হিসাবে বাংলাদেশে যে মূল্যে ডিজেল বিক্রি হচ্ছে তার চেয়ে ৯ টাকা বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে ভারতে। আর এই সুযোগে বাংলাদেশি ট্রাকচালকরা প্রতি লিটারে চার টাকা লাভ নিয়ে ৬৫ টাকা লিটারে ডিজেল বিক্রি করে দিয়ে আসছে ভারতে গিয়ে। এতে ট্রাকচালকদের পাশাপাশি লাভবান হচ্ছে ভারতীয় ক্রেতারা। ক্ষতির শিকার হচ্ছে দেশ।
তেল আমদানিতে ভর্তুকি বাড়ছেই
সর্বশেষ গত ২৯ ডিসেম্বর জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর পরও সরকারকে প্রতি লিটার ডিজেলে ভর্তুকি দিতে হচ্ছে ১৬ টাকা ৩৪ পয়সা। গত অর্থবছরে (২০১০-২০১১) জ্বালানি তেল আমদানিতে বিপিসিকে আট হাজার ১৯৮ কোটি ২৪ লাখ টাকা লোকসান দিতে হয়েছে। দাম বাড়ানোর পরও চলতি অর্থবছরে জ্বালানি তেল আমদানিতে সরকারকে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
যেভাবে পাচার হয়
সূত্র জানায়, দেশের স্থলবন্দর দিয়ে যেসব পণ্য ভারত থেকে আমদানি করা হয়, সেগুলো এ দেশের মাটিতেই খালাস করা হয়। অন্যদিকে বাংলাদেশ থেকে যেসব পণ্য রপ্তানি করা হয় সেসব পণ্যে বহনকারী ট্রাকের মাল খালাস করা হয় ভারতীয় ভূখণ্ডে। এ কারণে রপ্তানি পণ্যবাহী ট্রাকচালকদের সুযোগ থাকে তেল পাচারের।
বাবু নামের একজন ট্রাকচালক কালের কণ্ঠকে জানান, 'ট্রাকে কয়েক ধরনের তেল নেওয়ার ট্যাংকি রয়েছে। আমি যে ট্রাক চালাই সেটিতে ১০০ লিটার তেল ধরে। যেসব ট্রাক সীমান্তে মালামাল আনা নেওয়া করে সেগুলো ২৫০ থেকে ৩০০ লিটার পর্যন্ত তেল ধারণ করতে পারে।' তাঁর কথার সত্যতার ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যায় সিটি ফিলিং স্টেশনের কর্মী ফিরোজের সঙ্গে কথা বলে। ফিরোজ জানান, ট্রাকের বিভিন্ন ধরনের ট্যাংকি রয়েছে। এর মধ্যে ১০০ লিটার থেকে ৩০০ লিটার পর্যন্ত তারা রিফিল করে থাকেন। তবে একাধিক ট্রাকচালক কালের কণ্ঠকে জানিয়েছেন, কোনো কোনো ট্রাকে ৪০০ থেকে ৫০০ লিটার তেল নেওয়ার মতো ট্যাংকিও রয়েছে।
সূত্র মতে, যেসব ট্রাকচালক তেল পাচার করে তারা সীমান্তে যাওয়ার আগে পুরো ট্যাংকি রিফিল করে নেয়। ফিরে আসার জন্য ৫০ লিটারের মতো রেখে বাকি তেল বিক্রি করে দেয়। আগে থেকেই ভারতীয় দালালরা কনটেইনার নিয়ে বসে থাকে ওই এলাকায়। বাংলাদেশ থেকে ট্রাক পৌঁছার পর ট্যাংকিতে পাইপ ঢুকিয়ে তেল কনটেইনারে ভরে দাম মিটিয়ে চলে যায়। বিএসএফও তাদের সহযোগিতা করে বলে অভিযোগ রয়েছে।
গত ৯ এপ্রিল তেজগাঁও ট্রাক স্ট্যান্ডে কথা হয় ট্রাক চালক মান্নানের সঙ্গে। তিনি জানান, মাঝেমধ্যে পণ্য নিয়ে তিনিও সীমান্তে যান। তবে তিনি কখনো তেল বিক্রি করেন না। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'সরকার আমাদের সুবিধার জন্য তেলে ভর্তুকি দিচ্ছে। আর আমরা যদি তেল বিদেশে বিক্রি করে দিয়ে আসি তা হলে তো বেইমানি করা হলো।' তবে তিনি জানান, কিছু কিছু অসাধু ট্রাকচালক এই অপকর্ম করে থাকে। ১০০ লিটার তেল বিক্রি করতে পারলে এক থেকে দেড় হাজার টাকা লাভ নিয়ে ফেরা যায়। কাজেই তেল বিক্রি করে দিয়ে আসে তারা।
কুমিল্লার 'ময়নামতি ভিউ' পেট্রল পাম্পের মালিক মোস্তফা কামাল পারভেজ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমার মনে হয় ভারতে তেল পাচার এখন কমেছে। আগে যখন ডিজেলের দাম অনেক কম ছিল তখন ব্যাপক হারে তেল পাচার হতো।' তিনি অভিযোগ করেন, আগে বিজিবি সদস্যরা পেট্রল পাম্পে সারাক্ষণ খোঁজখবর নিতেন। এখন সেটা কম দেখা যায়।
মোটরসাইকেলেও পাচার
সীমান্ত এলাকা ঘুরে দেখা গেছে ত্রিপুরার দিক থেকে একের পর এক মোটরসাইকেল আসছে কুমিল্লা শহরের দিকে। বেশির ভাগ মোটরসাইকেলের পেছনে রেজিস্ট্রেশন নম্বর প্লেট নেই। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, প্রতিদিন গড়ে অন্তত ৫০০ মোটরসাইকেল ঢোকে কুমিল্লায়। এক হিসাবে দেখা যায়, প্রতিটি মোটরসাইকেল ১০ লিটার করে তেল নিলেও এভাবে পাঁচ হাজার লিটার পেট্রল চলে যাচ্ছে ভারতে।
সূত্র জানায়, কাস্টমস কর্তৃপক্ষের দেখার কথা কতটুকু তেল নিয়ে ট্রাক ভারতের সীমানায় প্রবেশ করল, আবার কতটুকু নিয়ে ফেরত এল। কিন্তু একাধিক ট্রাকচালক জানিয়েছেন, একটি ট্রাক কতটুকু তেল নিয়ে গেল-এলো তা কেউ পরীক্ষা করে না।
চট্টগ্রাম প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক ও ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি পেলে দেশের সব কিছুর দাম বেড়ে যায়। তাই দাম না বাড়িয়ে কিভাবে পাচার রোধ করা যায় সে চেষ্টাই করতে হবে। সেটা করার জন্য আইনকানুন রয়েছে। কিন্তু প্রয়োগ না থাকায় লোকজন পাচারের সুযোগ পাচ্ছে।

No comments

Powered by Blogger.