সংকট নিরসনে সংলাপের কোনো বিকল্প নেই by ড. নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন সে দেশের সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে সম্প্রতি বাংলাদেশ সফর করে গেছেন। তিনি সরকারি ও বিরোধী জোটপ্রধানদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক সংকট, গণতন্ত্রের বিকাশ, আইনের শাসন ও স্বচ্ছতার বিষয় নিশ্চিত করার পাশাপাশি আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে কথা বলেছেন


এবং বিদ্যমান রাজনৈতিক সংকট নিরসনে রাজনৈতিক দলগুলোকে গঠনমূলক পথ খুঁজে বের করার পরামর্শ দিয়েছেন। ভারতের অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জিও সে কথাই বলে গেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে এমন উদ্যোগ আমরা অতীতেও দেখেছি। বিশেষ করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আন্দোলন যখন তুঙ্গে, তখন মার্কিন সিনেটের বৈদেশিক সম্পর্কবিষয়ক কমিটির শক্তিশালী দুজন সদস্য সিনেটর রিচার্ড লুগার এবং সিনেটর ক্লেবন পেল সে সময় তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়ারেন ক্রিস্টোফারের বরাবরে একটি চিঠি লেখেন।
সেই চিঠিতে তাঁরা যে শর্তগুলো নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলেন, এর ওপর ভিত্তি করেই বাংলাদেশের পরবর্তী ঘটনাগুলো আবর্তিত হয়। এই যে বিষয়টি, অর্থাৎ বিদেশি প্রেসক্রিপশন, আগেই বলেছি, এটা আমাদের ক্ষেত্রে নতুন কিছু নয়। উল্লেখ্য, এর এক দশক আগে ফিলিপাইনে মার্কোস যখন ক্ষমতায় ছিলেন, তখন সে দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বিদ্যমান সংকট নিরসনের লক্ষ্যে পাঁচটি শর্তবিশিষ্ট একটি টার্মস অব রেফারেন্স প্রণয়ন করে দিয়েছিলেন মার্কিন সিনেটররা। এর ওপর ভিত্তি করে ফিলিপাইনের পরবর্তী রাজনৈতিক পরিবর্তন ঘটেছিল। পূর্ব ইউরোপ এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের মধ্য দিয়ে এই পৃথিবী এককেন্দ্রিক একটি বিশ্বে পরিণত হয়েছে। এ অবস্থায় একবিংশ শতাব্দীতে স্ট্র্যাটেজিক বিবেচনায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠা মহাদেশ এশিয়ায় যেহেতু বাংলাদেশের অবস্থান, সে কারণে যুক্তরাষ্ট্রের একটি সহায়ক ভূমিকা থাকবে আমাদের রাজনৈতিক সংকট নিরসনে- এটি বিদ্যমান পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে স্বাভাবিক। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার এবং সব দলের অংশগ্রহণের ভিত্তিতে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনও সব দলের অংশগ্রহণের ভিত্তিতে সুষ্ঠু ও অবাধ হোক- মার্কিন এই নীতির ধারাবাহিকতা থাকবে এ তো স্বাভাবিক। এখানে যে বিতর্কটা নতুন মাত্রা পেয়েছে তা হলো, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার অবসান এবং অন্য সব দেশের মতোই প্রচলিত ব্যবস্থায়, অর্থাৎ রাজনৈতিক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের যে আয়োজন হয়ে থাকে, সে মতো করা। এ দুটি বিষয় নতুনতর মাত্রা যোগ করেছে সংকট ঘনীভূত করার ক্ষেত্রে। অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে বলা যায় যে জাতীয় সংসদকে নির্বাচনকালীন সরকার-সংক্রান্ত ও অন্য সব বিষয়ের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করা গেলে তা হবে জাতির জন্য স্বস্তিদায়ক। মনে রাখা দরকার, কারোরই এমন কিছু করা উচিত নয়, যার নেতিবাচক মূল্য দিতে হয় দেশ ও জাতিকে। ক্ষমতাসীন মহাজোট সরকারের অধীনেই যদি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং প্রধান বিরোধী জোট যদি এই নির্বাচন বর্জন করে, তাহলে এর গ্রহণযোগ্যতা জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এই পরিস্থিতি দেশের স্থিতিশীলতার জন্য বড় ধরনের হুমকি হয়ে দেখা দিতে পারে। প্রতিবেশী দেশগুলো, অর্থাৎ ভারত, মিয়ানমার ও গণচীনকে নিয়ে গঠিত আমাদের যে ব্যাকইয়ার্ড, এর যে স্থিতিশীলতা তাও বিপন্ন করে তুলতে পারে। এ সব কিছুর বিবেচনায় সর্বাগ্রে আমাদের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অত্যন্ত জরুরি। আর এ জন্যই দরকার সংলাপ। সংলাপ ছাড়া বিদ্যমান সংকট নিরসনের কোনো রাস্তা আছে বলে আমি মনে করি না। সে ক্ষেত্রে আমাদের বন্ধুরাষ্ট্রগুলোর সহায়ক ভূমিকাও দরকার। আমাদের ভালো লাগুক আর না-ই লাগুক, যুক্তরাষ্ট্র বর্তমান বিশ্ব প্রেক্ষাপটে নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে এবং আমাদের বিদ্যমান সংকট নিরসনে, বিতর্কমুক্ত নির্বাচন নিশ্চিতকরণে তাদের ভূমিকা অবশ্যই বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ আমাদের সার্বিক স্বার্থ রক্ষায় এবং অগ্রগতির প্রয়োজনে জাতীয় ইস্যুতে রাজনৈতিক ঐকমত্য, সহনশীলতা এবং গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রায় সবার বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখা।

No comments

Powered by Blogger.