সরকারের ৪০ মাস by আসিফ কবীর

সংসদীয় ব্যবস্থার সরকারের পীঠস্থান নির্বাচিত সদস্যদের সমন্বয়ে গঠিত সংসদ। চলতি নবম সংসদের তিন বছর পূর্তি হলো ২৫ জানুয়ারি। ইতিপূর্বে একটি সংসদের মেয়াদ শেষেই সরকারের মেয়াদ শেষ হতো। নির্বাচনের পর সংসদ বসার প্রথম দিনটিতে পাঁচ বছর অন্তর সরকার বদলাত।


কিন্তু অন্যায়ভাবে ক্ষমতা দখল বন্ধ করাকে প্রাধান্য দিয়ে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা অব্যাহত রাখা এবং অনির্বাচিত সরকারের অনাহূত দীর্ঘতা বন্ধে ১৫তম সংশোধনী পাস হয়েছে। এই সংশোধনী অনুসারে চলতি সংসদের পাঁচ বছর মেয়াদের মধ্যে নির্বাচনের মাধ্যমে পরবর্তী সংসদের সদস্য নির্বাচন তথা গঠন হবে। এই হিসাবে ২৫ জানুয়ারি দশম সংসদ গঠনের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। এবারকার শীতকালীন অধিবেশন এই তারিখেই বসেছে এবং যথারীতি রাষ্ট্রপতি ভাষণ দিয়েছেন। একনাগাড়ে ৯০ কার্যদিবস অনুপস্থিতিজনিত সদস্যপদ খারিজ হওয়া এড়াতে প্রধান বিরোধী দলও শীতকালীন অধিবেশনে এসেছিল। আমরা এখন বাজেট অধিবেশনের জন্য অপেক্ষমাণ। ইতিমধ্যে শপথ গ্রহণের দিন (৬ জানুয়ারি, ২০০৯) থেকে ৬ মে সরকারের ৪০ মাস পূর্ণ হলো। এখন থেকে সরকারের মেয়াদ আছে ১৮ মাস বা দেড় বছরের কিছু কম। ১/১১-পরবর্তী সরকার মাত্র দুই বছরে জাতীয় পরিচয়পত্র প্রদানসহ রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে আলোচিত অগণন পদক্ষেপ নিয়েছিল। তাদের বাস্তবতাবোধ ও নৈয়ায়িক ঘাটতির দোষে তারা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সফল হতে পারেনি, সেটা অন্য আলোচনা। কিন্তু কাজ হিসেবে, উদ্যোগ হিসেবে, ক্ষেত্র কিংবা বিস্তৃতির বিবেচনায়, সর্বোপরি মনোযোগ ও তৎপরতার পরিমাপে তাদের কর্মকাণ্ড ছিল ব্যাপক। এই দেড় বছরকে সঠিকভাবে কাজে লাগানোয় জনসেবা ও স্বার্থ সমুন্নত হলে মহাজোট সরকার তাদের অবস্থান নির্বাচনের মুখে আরো সুদৃঢ় দেখতে পাবে। বিরোধী দলের অসহযোগিতা এবং তৈরিকৃত রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা তত্ত্বাবধায়ক সময়কালের চেয়ে সরকারের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের অনুকূল অবস্থা কমাবে সত্য, কিন্তু মন্ত্রিসভা এবং সরকারের অপরাপর সভ্যরা ইত্যসময়ে কাজের মধ্য দিয়েই অনেক অভিজ্ঞ ও পারঙ্গম হয়ে উঠেছেন। তাঁদের দক্ষতা-যোগ্যতা সংগতই বেড়েছে, যা দিয়ে সরকার অনায়াসেই উন্নয়ন-বৈরী পরিবেশের ঘাটতি পুষিয়ে নিতে পারবে।
অনেকে আজকাল মতামত প্রদানমূলক অনুষ্ঠানে কোনো অপ্রত্যাশিত অবস্থা বা সমস্যা নিয়ে মত ব্যক্ত করে বলেন, সরকার এ অবস্থার পরিবর্তন বাকি দিনগুলোতে আর ঘটাতে পারবে বলে মনে হয় না। এভাবে হতাশা জ্ঞাপনের সাধারণীকরণ ঠিক নয়। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার নিজেরাই নিজেদের উদ্যোগে তিন মাসের মতো মেয়াদ কমিয়ে আগেভাগেই পরবর্তী সংসদের কার্যক্রম শুরুর সাংবিধানিক ব্যবস্থা নিয়েছে। সেই হিসাবে সরকারের মেয়াদ দেড় বছর আছে। সংবিধানের নতুন সংশোধনী অনুসারে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নয়, বরং নিয়মতান্ত্রিক কাজে সীমাবদ্ধ রাজনৈতিক সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে। পরবর্তী সংসদের গঠন চলতি সংসদের প্রথম অধিবেশনের শুরুর দিনের মধ্যে সম্পন্ন হবে। সারা দেশেই আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে ভোটগ্রহণ হতে পারে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে। এ দুটি বিষয়েই বিএনপি ও সমমনাদের আপত্তি আছে। তারা মনে করে, এতে জাতীয় নির্বাচনের সুষ্ঠুতা ব্যাহত হবে। কিন্তু এতে আওয়ামী লীগ এবং এর জোটবদ্ধ শরিকদের আত্মবিশ্বাস বোধ করার কারণ নেই যে আমাদের অধীনে নির্বাচনে আমরাই জিতব। কারণ, কারচুপি বা সাজানো নির্বাচনের বিএনপি এবং সমমনাদের আশঙ্কার খুব ভিত্তি নেই। বরং দেড় বছরে ক্ষমতাসীন সরকার জনগণের আস্থা লাভে প্রথম হতে না পারলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়াও ইভিএমে (যা তারা নির্ভরযোগ্য মনে করছে) বিজিত (রানার্সআপ) হওয়াই সহজ অঙ্ক হিসেবে দেখতে হবে। কারণ, জনগণের ভোট একটি করে এবং মন পরিবর্তনশীল। কোনো কারণে তাদের মনের নাগাল পাওয়া না গেলে, মন তুচ্ছ কারণে উঠে গেলে গত্যন্তর থাকবে না। দুজনকে নির্বাচনে পছন্দ করে সমর্থন দেওয়া যায় না। কাজেই জনমত টানতে প্রথম হলেই জয় হবে।
বর্তমান ক্ষমতাসীনদের মেয়াদকালের শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক গরিমা লাভের খবরটি হলো, এবার সর্বস্তরের নেতা-কর্মীরা প্রথম বছর থেকেই স্মরণে রাখছেন, আগামীতে ক্ষমতায় নাও ফেরা হতে পারে। ২০০১ সালের মধ্যভাগ পর্যন্ত নির্বাচনী আলোচনায় মানুষই আওয়ামী লীগকে অবিকল্প মনে করত। আর দলীয় লোকদের আত্মবিশ্বাস স্বাভাবিকভাবেই ছিল অনেক বেশি। এবার এই অনিশ্চয়তাবোধ জবাবদিহিতা বাড়াতে, নির্বাচনী কৌশল নির্ধারণ এবং নির্বাচনব্যবস্থাকে তাদের বিরুদ্ধে প্রভাবিত করা নিয়ে সতর্ক রাখবে।
গত ৬ জানুয়ারি দেশের মর্যাদাশীল দুটি দৈনিক পত্রিকায় সরকারের বর্ষপূর্তিকে ঘিরে জনমত যাচাইপূর্বক জরিপ রিপোর্ট ছাপা হয়েছে। পাঁচ হাজার পর্যন্ত বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলার বাসিন্দাদের (জরিপ) প্রশ্নোত্তর ছিল প্রকাশিত এই রিপোর্টের ভিত্তি। অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা প্রতিনিধিত্বশীল না হলেও সরকার সতর্কতা ও আত্মসমালোচনার প্রয়োজনে এই জরিপগুলোর ফলাফল বিবেচনায় নিতে পারে। যদিও ইংরেজি ও বাংলা দৈনিকে একযোগে প্রকাশিত জরিপটিতে আওয়ামী লীগের সমর্থক অধ্যুষিত গোপালগঞ্জ, বাগেরহাট, নড়াইল, মাগুরা, রাজবাড়ী, শরীয়তপুর প্রভৃতি জেলা বাইরে রাখায় এর ফলাফলের সর্বজনীনতা হ্রাস করেছে। প্রসঙ্গত, বগুড়া, লক্ষ্মীপুর ও ফেনী অন্তর্ভুক্ত ছিল। জরিপের উদ্বেগজনক বিষয়ের তালিকা এবং অসন্তোষের ক্ষেত্রগুলোর ক্রম বস্তুনিষ্ঠতার মানদণ্ডে উত্তীর্ণ নয়, বরং প্রকাশকারী কর্তৃপক্ষের সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ মনে করার সুযোগ আছে। তবু গণমাধ্যমের মানুষের কাছে পেঁৗছানোর ক্ষমতা বিবেচনায় একে উপেক্ষা করা যাবে না।
একটি রাজনৈতিক দল জনকল্যাণে অবদান রাখতে না পারলে জনসমর্থন হারায়। এর বাইরে আরো একটি কারণে ভোটের রাজনীতিতে ভাটা পড়ে। তা হলো, মন্ত্রী, এমপি এবং নেতাদের কাছে কর্মী-সমর্থকরা প্রত্যাশিতভাবে মূল্যায়ন না পেলে। রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা সাধারণ মানুষকে মনোক্ষুণ্ন করলে তা হয় চরম বিপর্যয়কর। একজন রাজনীতিকের সমীপে মানুষের ঢল না নামলে তাঁর মূল্য কী? মানুষকে কাছে নেওয়া, আস্থাশীল করা, অভাব-অভিযোগ বলার সুযোগ দেওয়া খুবই জরুরি। নির্বাচন-পূর্ব ও উত্তর সময়ে এই ধারা একরকমই রাখতে হয়। না হলে নির্ঘাত সমর্থন কমে।
আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের কাছে ২০০১ সালের নির্বাচনোত্তর সহিংসতার বিভীষিকাময় স্মৃতির জন্য বিএনপির আবার ক্ষমতায় আসা দুঃস্বপ্নের মতো। পক্ষান্তরে, বিএনপি-জামায়াতও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা লাভে মরিয়া। বিএনপি-জামায়াতকে ভরসা করে মানুষের ভোট দেওয়ার কারণ নেই সত্য, কিন্তু ভোটাররা সরকার সমর্থকদের আচরণে ব্যথিত-দুঃখিত থাকলে তখন ভিন্নভাবে ভাববে। যুক্তির চেয়ে আবেগাশ্রয়ী হয়েই আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলের ধারাবাহিকতায় ছেদ টানতে চাইবে। ক্ষমতাসীনদের এ প্রসঙ্গে মনে রাখতে হবে, মান-অভিমান, বিশেষ করে সম্মানবোধ সাধারণ মানুষের খুবই শাণিত। কোনো ভোটার যেন তার জনপ্রতিনিধির ব্যাপারে দুর্ব্যবহার, জনবিচ্ছিন্নতা বা উপেক্ষার অভিযোগ মনে পোষণ না করে।
অধিকন্তু নির্বাচনোত্তর সহিংসতায় চরম মূল্য দিতে বাধ্য হওয়ায় সাধারণ কর্মী-সমর্থকদেরও একটি জোরালো বক্তব্যের অধিকার আছে। জনপ্রতিনিধি এবং বিভিন্ন পর্যায়ের নেতৃত্বের ভ্রান্তিতে হেরে গেলে প্রতিপক্ষের হাতে নিরীহ কর্মী-সমর্থকদের পর্যন্ত জীবন বিপন্ন হওয়ার শতভাগ ঝুঁকি থাকবে। সেটাই ক্ষমতা থেকে দূরবর্তী সাধারণ মানুষের পরামর্শদানের, ভালো-মন্দ নিয়ে বক্তব্য প্রতিষ্ঠার কিংবা আবেগ-অনুভূতির মূল্যায়নের অনিবার্যতা সৃষ্টি করেছে।
বিএনপি তার সঙ্গীয় ১৭ সহদলকে নিয়ে শেষ এপ্রিলে পাঁচ দিন হরতাল করল। হরতালের শেষ দিনে (৩০ এপ্রিল) বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সাবেক উপরাষ্ট্রপতি ও মন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ গুলশানে বিরোধীদলীয় নেতার সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে বললেন, সরকারের পতন না হওয়া পর্যন্ত এই আন্দোলন চলবে। পরে একাধিক সভায় বক্তব্যে তিনি বলেছেন, নিখোঁজ ইলিয়াস আলী এবং সংবিধান থেকে অপসৃত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফেরত দিন, সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে। এ বক্তব্য থেকে সুস্পষ্ট হলো- ১. জনস্বার্থ বা গণমানুষের কথা বিরোধী দলের কাছে প্রাধান্য পাচ্ছে না, ২. সরকারকে বিব্রত করতে যেকোনো অজুহাতেই হরতাল ও সরকারবিরোধী কর্মসূচি বিএনপিকে দিতে হতো। এর আগে সমুদ্রজয়ের কৃতিত্বে গদিনশিন সরকারকে চিন্তাতীত উচ্চতায় পেঁৗছতে দেখে তাদের দেওয়া ধন্যবাদও প্রত্যাহার করে নেয়। সরকারকে সর্বাত্মক অসহযোগিতা এবং ক্রমে ক্রমে তা আরো বাড়িয়ে তোলাই আগামী দিনগুলোতে সরকার ও বিরোধী দলের সম্পর্কের রসায়ন হবে। এর মধ্য দিয়েই দুই বড় দলের নেতৃত্বাধীন জোট নির্বাচনগামী থাকবে। আশা করি এসব বৈপরীত্য সত্ত্বেও সরকার সামনের দিনগুলোতে জনস্বার্থকে সমুন্নত করতে কেবল একার মতো নিবেদিত থেকে নয়, নাগরিকদের অপেক্ষাকৃত ভালো বোধ করানোর প্রতিবার্তার মাধ্যমে নিজেদের প্রমাণের সুযোগটি হাতছাড়া করবে না।
লেখক : সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.