কালের পুরাণ-শিক্ষা দেওয়ার বনাম শিক্ষা নেওয়ার রাজনীতি by সোহরাব হাসান

গত শুক্রবার একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে আওয়ামী লীগ আয়োজিত এক আলোচনা সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় থাকতে আড়াই শ প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনার নাম বদল করেছিল। এসবের মধ্যে কয়েকটির নাম প্রত্যাহার করায় তাদের গায়ে জ্বালা ধরেছে।


ভবিষ্যতে যাতে কেউ নাম বদল করতে না পারে, সেই শিক্ষা দেওয়ার জন্যই এ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।’
অন্যদিকে বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া এক বিবৃতিতে বিএনপির মিছিলে পুলিশের লাঠিপেটা ও গ্রেপ্তারের প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগ অতীত থেকে শিক্ষা নেয়নি। এ জন্য অতীতে তাদের ভয়াবহ পরিণতি হয়েছে।’
শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া দেশের দুই প্রধান দলের শীর্ষ নেত্রী। একজন বর্তমানে প্রধানমন্ত্রী, অন্যজন বিরেধী দলের নেত্রী ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী। রাজনৈতিক মত ও পথের ভিন্নতা সত্ত্বেও দেশবাসী তাঁদের কাছ থেকে দায়িত্বশীল আচরণ ও বক্তব্য আশা করে। কিন্তু প্রায়ই সে আশা দুরাশায় পরিণত হয়।
সম্প্রতি মন্ত্রিসভার বৈঠকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নাম বদল করা হয়। জিয়াউর রহমানের নাম তুলে দিয়ে সেখানে বসানো হয় ধর্মীয় নেতা হজরত শাহজালাল (রহ.)-এর নাম। বিএনপি এর প্রতিবাদ করেছে। বিএনপির আমলে চট্টগ্রামের এম এ হান্নান বিমানবন্দরের নাম বদলে হজরত শাহ আমানত (রহ.)-এর নাম যুক্ত করা হলে আওয়ামী লীগও প্রতিবাদ করেছিল। তারা বলেছিল, রাজনৈতিক স্বার্থে ধর্মকে ব্যবহার করা হচ্ছে। আজ একই অভিযোগ আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে আনলে তারা কী বলবে? ক্ষুদ্র ও দলীয় স্বার্থে নেতা-নেত্রীরা বারবার ধর্মকে ব্যবহার করছেন। এর পরিণাম ভালো হতে পারে না।
নামবদল বিতর্কে জড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেত্রী তাঁদের বক্তৃতা ও বিবৃতিতে দুটি বোমা ফাটিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘যারা নাম বদল করেছিল, তাদের শিক্ষা দিতেই কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের নাম বদল করা হয়েছে।’ বাংলায় ‘শিক্ষা দেওয়া’ কথাটি দ্ব্যর্থক। সাধারণ অর্থে কাউকে কিছু জানানো, বোঝানো, পড়ানো বা অবহিত করাকে আমরা শিক্ষা দেওয়া বলে জানি। যেমন নেতারা কর্মীদের রাজনৈতিকভাবে শিক্ষিত করে তোলেন, শিক্ষকেরা শ্রেণীকক্ষে ছাত্রছাত্রীদের পড়ান। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী যে শিক্ষা দেওয়ার কথা বলেছেন, সেটি আসলে ‘উচিত শিক্ষা’। কেউ সহজে না বুঝলে তাকে গলাধাক্কা দিয়ে বুঝিয়ে দেওয়া। আমাদের নেতা-নেত্রীরা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে এভাবেই শিক্ষা দিয়ে আসছেন। হয়তো ভবিষ্যতেও দেবেন। এ রকম শিক্ষা দেওয়ার রাজনীতি যে দেশকে রসাতলে নিয়ে যাচ্ছে, তা নিয়ে তাঁদের মাথাব্যথা নেই।
বিরোধীদলীয় নেত্রী আরও ভয়ংকর কথা বলেছেন এবং ক্ষমতাসীন দলকে পরোক্ষভাবে হুমকিও দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগ অতীত থেকে শিক্ষা নেয়নি বলেই অতীতে তাদের পরিণতি হয়েছে ভয়াবহ।’ এই ভয়াবহ পরিণতি বলতে তিনি নিশ্চয়ই নির্বাচনে পরাজয়কে বোঝাননি। নির্বাচনে বিএনপিও একাধিকবার পরাজিত হয়েছে। তিনি হয়তো বুঝিয়েছেন ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে বঙ্গবন্ধু হত্যার কথা। সেটা যদি হয়ে থাকে, তবে এর মাধ্যমে খালেদা জিয়া কি আওয়ামী লীগের অভিযোগকেই সত্য প্রমাণিত করলেন না? সেদিন কতিপয় উচ্ছৃঙ্খল সেনাসদস্য বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করেছিলেন। সেটি কি শুধু আওয়ামী লীগের জন্য ভয়াবহ পরিণতি ছিল, না সারা দেশের জন্য? সেই অশুভ শক্তি কি পরবর্তী সময়ে জিয়াউর রহমানকে শান্তিতে থাকতে দিয়েছিল? দেয়নি। জিয়া বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিদেশি মিশনে সম্মানজনক চাকরি দিলেও তাঁরা সেনাবাহিনীতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করেছেন; বারবার সেনা-অভ্যুত্থানে মদদ জুগিয়েছেন।
বিরোধীদলীয় নেত্রী কি দেশে ফের সেই ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনতে চান? ক্ষমতায় থাকতে তাঁরা হরকাতুল জিহাদ, জেএমবি নামে যে অপশক্তি তৈরির পরিবেশ সৃষ্টি করে দেশকে মহাবিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিয়েছিলেন, তা কারও অজানা নয়। কত মায়ের বুক খালি হয়েছে, কত প্রাণ আত্মাহুতি দিয়েছে, বিপথগামী কত তরুণ বোমার স্প্লিন্টারে গুরুতর আহত হয়ে এখনো কাতরাচ্ছে, তার খবর কি খালেদা জিয়া রাখেন? তিনি কি ’৮১ সালের সেই ভয়ংকর দিনের কথা ভুলে গেছেন? না গেলে তিনি সেই ভয়াবহ পরিণতির কথা উচ্চারণ করতে পারতেন না। গণতন্ত্র তো ভয়াবহ পরিণতি থেকে উদ্ধারের মন্ত্র।
এটি খালেদা জিয়ার মুখ ফসকে বেরিয়ে যাওয়া কথা নয়, গণমাধ্যমে পাঠানো লিখিত বিবৃতি। এর আগে সংসদেও তাঁর দলের একজন সদস্য আবারও ১৫ আগস্টের মতো ঘটনা ঘটানোর হুমকি দিয়েছেন। এসব কিসের আলামত? এখন দেখছি ক্ষমতাই মানুষকে উন্মত্ত করে না, ক্ষমতা হারানোর বেদনাও তাকে উন্মত্ত করে।
কি ক্ষমতাসীন, কি বিরোধী দলে আসীন আমাদের নেতা-নেত্রীদের বক্তৃতা শুনে, বিবৃতি দেখে এ কথা জোর দিয়ে বলা যায়, তাঁরা অন্যকে শিক্ষা দেওয়ার কথা বললেও নিজেরা কখনো শিক্ষা নেন না। জাতীয় সংসদ জাতির আশা-ভরসার স্থল। সেখানে জনগণের অভাব-অভিযোগ, দেশের সমস্যার সংকট-সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা হবে, দেশবাসী দিকনির্দেশনা পাবে—সেটাই প্রত্যাশিত। কিন্তু এখন এমন সব বিষয় নিয়ে বিতর্ক হয়, যার সঙ্গে জনগণের কোনো সম্পর্ক নেই। নিজ দলের নেত্রীর বন্দনা ও অন্য দলের নেত্রীর নামে অশালীন ও অশোভন উক্তির প্রতিযোগিতা চলে সংসদে। আগে বিদ্যার্থী থেকে বিদ্বজ্জন—সবাই সংসদের আলোচনা গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনতেন কিছু জানার জন্য, শেখার জন্য। এখন টিভিতে সংসদ অধিবেশনের ধারাবিবরণী দেখালে অনুষ্ঠান বন্ধ করে দিতে হয়। সরকার ও বিরোধী দলের সাংসদদের কথাবার্তা শুনে জীবনানন্দ দাশের সেই বিখ্যাত কবিতার কয়েকটি পঙিক্ত মনে পড়ে: ‘অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে পৃথিবীতে আজ/ যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দেখে তারা;/ যাদের হূদয়ে কোনো প্রেম নেই, প্রীতি নেই—করুণার আলোড়ন নেই/ পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।’
বহু বছর আগে জীবনানন্দ দাশ কবিতাটি লিখেছিলেন বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে। ‘পৃথিবী’র স্থলে ‘বাংলাদেশ’ শব্দটি বসিয়ে নিলে মনে হবে, এর চেয়ে সত্য আর কিছু নেই। যারা অন্ধ, এখন তারাই সবচেয়ে বেশি দেখছেন। ভাবছেন. ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের মধ্যে তাদের সমকক্ষ দেশপ্রেমিক ও জ্ঞানী ব্যক্তি নেই। তাঁরা যেভাবে চালাবেন সেভাবে সবাইকে চলতে হবে। কেননা পাঁচ বছরের জন্য তাঁরা দেশটা ইজারা নিয়েছেন। এ সময়ে কারও কোনো ওজর-আপত্তি, নালিশ চলবে না।
সব দেশেই একজন প্রধানমন্ত্রী থাকেন। বাংলাদেশের সমস্যা হলো, এখানে সব সময় দুজন প্রধানমন্ত্রীর সরব উপস্থিতি। একজন শপথ নিয়ে সরকার পরিচালনা করেন; আরেকজন মনে করেন তাঁরই প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু ষড়যন্ত্র করে তাঁকে সেই পদ থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। এই পদাধিকারী ও পদবঞ্চিত প্রধানমন্ত্রীর ঝগড়া মাঝেমধ্যে চরম আক্রোশে পরিণত হয়। দেশ ও জনগণ ছাড়খার হয়ে যায়। ২০০৬ সালের অক্টোবরের শেষ দিনগুলোর কথা ভাবুন। ক্ষমতায় থাকার ও যাওয়ার জন্য তাঁরা দেশের মানুষকে জিম্মি করতেও দ্বিধা করেন না।
প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলের নেত্রীর কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছে, তাঁরা নিজে শিক্ষা নেওয়ার চেয়ে অন্যকে শিক্ষা দিতে অনেক বেশি উদ্গ্রীব। আশা করা গিয়েছিল এক-এগারোর পরিবর্তনের পর আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে কিছুটা হলেও গুণগত পরিবর্তন আসবে। স্বেচ্ছায় হোক বা বাধ্য হয়ে হোক সে সময় দুই দলের নেতা-নেত্রীরা পরিবর্তনের অঙ্গীকারও করেছিলেন।
সেই পরিবর্তনের রাজনৈতিক ভাষা ছিল সংস্কার। সেই সংস্কার কেবল নির্বাচন কমিশনের নির্ধারিত ছকে গঠনতন্ত্র তৈরি করা নয়, দলের ভেতরে-বাইরে পরিবর্তন, আচরণে পরিবর্তন, মনমানসিকতায় পরিবর্তন। কিন্তু এখন উল্টো দিকেই তাদের পরিবর্তনটা লক্ষ করা যাচ্ছে। আগে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতাদের মধ্যে সংসদের ভেতরে-বাইরে কথাবার্তা হতো, কুশল বিনিময় হতো। এখন সেটি করতেও তাঁরা ভয় পান, যদি নেত্রী দেখে ফেলেন! আমাদের বিজ্ঞ রাজনীতিকেরা জানেন কি জানি না, তাঁদের এসব কথাবার্তা নিয়ে দেশের অনেক মানুষ হতাশ হন, বিদেশিরা হাসাহাসি করেন। নির্বাচনের পর দেখা গেল সবই বুজরুকি, ধাপ্পাবাজি।
সরকারি ও বিরোধী দল প্রতিপক্ষকে শিক্ষা দেওয়ার কথা বললেও পরস্পরের কাছ থেকে একটি শিক্ষা নিখুঁতভাবে গ্রহণ করছে। সেটি হলো অন্ধ অনুকরণ। আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে থাকতে যা যা করেছে, বিএনপি আক্ষরিক অর্থে এখন তা অনুসরণ করছে। আবার বিএনপি ক্ষমতায় থাকতে যা যা করেছে, আওয়ামী লীগও তার বাইরে এক পা নড়বে বলে মনে হয় না। জাতীয় সংসদে আসন বদল থেকেই কাজটা শুরু হয়। তবে বড়ই অনিচ্ছায়। পাঁচ বছর ক্ষমতার স্বাদ ভোগ করার পর কে বিরোধী দলে বসতে চায়? এক ধরনের লজ্জাও তাদের পেয়ে বসে। এ কারণে বিরোধী দল সংসদের বাইরে থেকে প্রতিপক্ষকে সেই পথ অনুসরণে উদ্বুদ্ধ করে। আবার ক্ষমতাসীনেরা এমন সব দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে, তারা বিরোধী দলে গেলে অন্য পক্ষ তাকে অবশ্যপালনীয় মনে করে। ইতিমধ্যে বিএনপির নেতারা আগাম ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন, ক্ষমতায় আসতে পারলে তাঁরা আওয়ামী লীগের শিক্ষাই কাজে লাগাবেন।
রাজনৈতিকভাবে বিপরীত মেরুতে অবস্থান করলেও দুই দলের মধ্যে এক অদ্ভুত সমঝোতা আছে। তারা একে অপর থেকে যেমন শিক্ষা নিচ্ছে, তেমনি জনগণকেও ‘উচিত শিক্ষা’ দিচ্ছে। নিচের ক্লাসের শিক্ষার্থী যেমন সবকিছু শিখতে পারে না, ধীরে ধীরে সে অভিজ্ঞতা লাভ করে, আমাদের সরকারি ও বিরোধী দলও এখন মহা-অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ১৯৯১—১৯৯৬ মেয়াদের বিএনপির সঙ্গে ২০০১—২০০৮ মেয়াদের বিএনপির তুলনা করুন। প্রথমবার বিএনপি টেনেটুনে পাস করেছিল (দুর্নীতি, মাস্তানি ও বিরোধী দলকে ঠেঙানিতে), দ্বিতীয়বার তারা প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করে (স্মরণ করুন ২১ আগস্টের ও এক দিনে সারা দেশে বোমা হামলার ঘটনা); ১৯৯৬—২০০১ মেয়াদে আওয়ামী লীগ বিএনপির কাছ থেকে শিক্ষা নিলেও কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত ছিল। এবার কী হবে, তার জবাব একমাত্র ভবিষ্যত্ই দিতে পারবে। ইতিমধ্যে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যেভাবে ডিজিটাল সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, দখলবাজি শুরু হয়েছে, তা চলতে থাকলে মানুষ বলবে, বিএনপির আমলেই ভালো ছিলাম। যেমন বিএনপির আমলে বলেছিল, না, আওয়ামী লীগের আমলেই ভালো ছিলাম। এভাবে তারা একে অপরকে ‘শিক্ষিত’ করে তুলছে।
রাজনীতির এই ধ্বংসাত্মক ধারা বন্ধ না হলে কেবল দুর্নীতি নয়, তথাকথিত গণতন্ত্রের চর্চায় পাকিস্তান, সুদান, ইরাক প্রভৃতি দেশকে পেছনে ফেলে বাংলাদেশও চ্যাম্পিয়ন হবে।
সবশেষে মহামান্য প্রধানমন্ত্রী ও আরও মান্য বিরোধীদলীয় নেত্রীর প্রতি সবিনয় নিবেদন, আপনারা যত খুশি একে অপরকে শিক্ষা দিন, পরস্পর থেকে অভিজ্ঞতা ধার করুন, আমাদের আপত্তি নেই। দয়া করে জনগণকে ‘উচিত শিক্ষা’ দেওয়া থেকে বিরত থাকুন।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net

No comments

Powered by Blogger.