আমরাই বাস্তবায়ন করতে পারি পদ্মা সেতু by ড. শামসুল আলম

আমরা পেরেছি ১৯৭১ সালে। পারা যাবে পৃথিবীর পরাক্রমশালী সুসংগঠিত সেনাবাহিনীকে পরাস্ত করতে, তাও আবার মাত্র ৯ মাসে- এমনটাই সাধারণভাবে কেউ ভেবে উঠতে পারেনি ১৯৭১ সালের আগে। জাতি সংকল্পবদ্ধ ও একতাবদ্ধ হলে সবই সম্ভব। পদ্মা বহুমুখী সেতু, যার প্রাক্কলিত ব্যয় ২ দশমিক ৯০ বিলিয়ন ডলার।


মানে, প্রায় ২৪ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হবে চার বছরে। যদি সমাপ্তিকাল চার বছর ধরি, বার্ষিক খরচের পরিমাণ দাঁড়ায় ছয় হাজার কোটি টাকা (এক বছরের কৃষি খাতে ভর্তুকির সমান)। বাজেট যাঁরা প্রণয়ন করেন বা প্রণয়নের সঙ্গে জড়িত, তাঁরা স্বীকার করবেন, ছয় হাজার কোটি টাকার বার্ষিক বরাদ্দ রাখা অসম্ভব কোনো ব্যাপার নয়। আমাদের বার্ষিক বাজেটের দুটি জানালা (Window)- (ক) রাজস্ব ব্যয় বা অনুন্নয়ন জানালা, (খ) অন্যটি উন্নয়ন বাজেট (বার্ষিক উন্নয়ন জানালা)। চলতি বছর আমাদের মোট বার্ষিক বাজেট বরাদ্দ ছিল এক লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকা, যার মধ্যে শুধু ৪৬ হাজার কোটি টাকা ছিল উন্নয়ন বাজেট বা বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (মোট বাজেটের ২৮ শতাংশ)। গত মার্চে এসে দেখা গেল, পাঁচ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করতে পারছে না মন্ত্রণালয়গুলো। তাই সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন বাজেট কেটেছেঁটে করা হলো ৪১ হাজার কোটি টাকা। অতীতের ধারা থেকে বলা যায়, বছর শেষে দেখা যাবে, এই সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে আরো ৯-১০ শতাংশ ব্যয় করা যাচ্ছে না এবং এই হারে অব্যয়িত থাকবে অন্তত চার হাজার কোটি টাকা। তাহলে প্রথম যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল, দেখা যাচ্ছে, তা থেকে বছর শেষে ৯ হাজার কোটি টাকাই অব্যয়িত থাকছে। এটা শুধু এ বছরই নয়, প্রতিবছরেরই দৃশ্য। বরাদ্দ দিই মানে, আমাদের টাকা জোগান দেওয়ার সক্ষমতা আছে। জনবল ও ব্যয় সক্ষমতা না বাড়িয়ে বছরের পর বছর উন্নয়ন ব্যয় বাড়িয়ে চললে গণব্যয়ের অপচয়ই বেড়ে যায়। যদিও রাজস্ব ব্যয় কমানোর সুযোগ আছে, আমি রাজস্ব ব্যয়ে হাত দিতে বলব না। কেননা বেতন, ভাতা, ভর্তুকি, সামাজিক নিরাপত্তা ও পেনশনে হাত দিলে ভোটের রাজনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তেও পারে। উন্নয়ন বাজেটের জন্য প্রতিশ্রুত অব্যয়িত বরাদ্দ থেকেই উন্নয়নমূলক এই পদ্মা সেতুর কাজে হাত দেওয়া সম্ভব। পদ্মা সেতু নির্মাণ বর্তমান সরকারের রাজনৈতিক অঙ্গীকার এবং অর্থনৈতিকভাবে জাতির জন্য অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ। নব্বইয়ের দশকের প্রথমার্ধে আমাদের গড় প্রবৃদ্ধির হার ছিল চার শতাংশ, যা ওই দশকের দ্বিতীয়ার্ধে (১৯৯৮ সালের আগ পর্যন্ত) সেই হার উন্নীত হয় ৫ শতাংশে। বঙ্গবন্ধু বহুমুখী সেতু প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর থেকেই তা ৬ শতাংশে উন্নীত হয়। এই বর্ধিত ১ শতাংশ জিডিপি বৃদ্ধির হার বঙ্গবন্ধু সেতুর সরাসরি অর্থনৈতিক অবদান। বঙ্গবন্ধু সেতুর মাধ্যমেই বাংলাদেশ উচ্চ প্রবৃদ্ধির যুগে প্রবেশ করেছে। ২০০৫ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত গড় প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়িয়েছে সাড়ে ৬ শতাংশ। পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মিত হলে প্রবৃদ্ধির হার অন্য সব যা আছে, তা থেকেও এক-দেড় শতাংশ এমনিতেই বেড়ে যাবে। ১ শতাংশ জিডিপি (দেশজ স্থূল উৎপাদন) বৃদ্ধি পাওয়া মানে, ওই বছরের জন্য আড়াই লাখ নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হওয়া। কম করে হলেও ১০ লাখ ব্যক্তি নিশ্চিত দারিদ্র্যসীমার ওপরে উঠে আসা। পদ্মা সেতু নির্মিত হলে সারা দেশে সম-উন্নয়নের জন্য প্রাণচাঞ্চল্য সৃষ্টি হবে। পদ্মা বহুমুখী সেতুর স্ব-অর্থায়নের এ বিষয়টি আমাদের গভীরভাবে ভাবতে হবে এ কারণে যে, যেকোনো কারণেই হোক, মনে হচ্ছে, বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু নির্মাণে তার প্রতিশ্রুত অর্থ ছাড় করবে না। সে ক্ষেত্রে এডিবি, জাইকা, আইডিবি- সবাই বেঁকে বসবে গুরুকে অনুসরণ করে। বিশ্বব্যাংকের এ ক্ষেত্রে অন্তর্নিহিত কারণ শুধু অন্তর্যামীই নয়, সরকারের উচ্চ মহলেও জানা থাকতে পারে। বিশ্বব্যাংকের রাজনীতিকে প্রভাবিত করার প্রচেষ্টা থাকে, এ কথাও কারো অজানা নয়। সরকারই ভালো জানে, কিভাবে কৌশল নির্ধারণ করবে। তবে এ ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংকের নেতিবাচক কোনো সিদ্ধান্তে জাতি হিসেবেই বাংলাদেশের হার মানার সুযোগ নেই। জাতীয় সক্ষমতার পরিচয় দেওয়ার এ চ্যালেঞ্জ গ্রহণের যোগ্যতা বাঙালি জাতির রয়েছে। বিশ্বব্যাংকের চুক্তির সময় প্রলম্বিত না করে দ্রুত এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন। অবশ্যই বিশ্বব্যাংকের তত্ত্বাবধানে স্বল্প সুদের এ ঋণ পেলে ভালো হতো। সেই ভালো যেহেতু আর হচ্ছে না, সেহেতু ইতিউতি না করে মালয়েশিয়া থেকে অধিক সুদে ঋণের ঝুঁকি না নিয়ে আমাদের স্ব-অর্থায়নের কথা অবশ্যই ভাবা যায়। আসছে বাজেটে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির বরাদ্দ থাকছে ৫৪ হাজার ৩০০ কোটি টাকা, যা চলতি বছরের সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির ৪১ হাজার টাকার বরাদ্দ থেকে ১৩ হাজার ৩০০ কোটি টাকা বেশি। এ থেকেই যদি আমরা ছয় হাজার কোটি টাকা পদ্মা সেতু খাতে পৃথক থোক বরাদ্দ রাখি, তাতে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে তহবিল সংকটের কোনো কারণ দেখি না। পদ্মা সেতু নির্মাণে এই বরাদ্দ হবে দেশের বাজেটের জন্য ঐতিহাসিক চমক। এই ছয় হাজার কোটি টাকার পরও উন্নয়ন বাজেটে বরাদ্দ থাকছে ৪৮ হাজার ৩০০ কোটি টাকা (এ বছরের ৪১ হাজার কোটি টাকার পরও এই বৃদ্ধি)। আগামী দুই-তিন বছরে আমাদের বরাদ্দ সক্ষমতা আরো বাড়বে। অবস্থা আরো সহনীয় করতে জনগণের অংশগ্রহণের সুযোগও বৃদ্ধি করা যায় সারচার্জ আরোপ করে। রেল-বাস-লঞ্চের টিকিট, সিনেমার টিকিট এবং জমির নিবন্ধীকরণে সারচার্জ আরোপ করে বঙ্গবন্ধু সেতুর জন্য ৫০১ কোটি টাকা সংগৃহীত হয়েছিল। এখনো ওইসব এবং প্রতিটি মোবাইল কলে, বিদেশি ফোন কলে সারচার্জ আরোপিত হতে পারে এবং জনগণ তা সানন্দে দেবে। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য ১৫-২০ বছর মেয়াদি সভরেন বন্ড (Sovereign Bond) ছাড়া যায়। দেশীয় সুদের হারের চেয়েও সেই সুদের হার হবে অনেক কম। শ্রীলঙ্কা বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে এ রকম বন্ড ছেড়ে। অন্তত এক বিলিয়ন ডলারের সভরেন বন্ড ছাড়ার কথা সরকার বিবেচনা করতে পারে। পদ্মা সেতুর আয় থেকে সুদে-আসলে এসব বহিঃঋণের টাকা শোধ করা যাবে। বিগত কয়েক বছরে বাংলাদেশের ক্রেডিট রেটিং ভালো বিবেচনায় এবং দেশ কখনোই ক্রেডিট ক্রাইসিস বা ঋণ সংকটে পড়েনি বিধায় সভরেন বন্ড ভালো বাজার পাবে বলেই মনে হয়।
স্ব-অর্থায়নে পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন করতে হলে দক্ষ ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে। পদ্মা সেতুর মতো মহাপ্রকল্পে যেহেতু বিশ্বব্যাংক টেন্ডার প্রক্রিয়ায় দুর্নীতির অভিযোগে সহায়তা স্থগিত করেছে, স্ব-অর্থায়নে বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও দেশের ১৬ কোটি মানুষের ৩২ কোটি চোখ এ প্রকল্প বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখবে। এ কারণেই এ মহাপ্রকল্প বাস্তবায়নের রাজনৈতিক গুরুত্ব বিবেচনায় এর সমুদয় কার্যক্রম ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া হতে হবে স্বচ্ছ এবং লাল ফিতার প্রভাবমুক্ত। প্রকল্পের নকশা যেহেতু করাই আছে, কারিগরি যন্ত্রপাতি, প্রযুক্তি ও কন্সালট্যান্সি সহায়তার জন্য দক্ষিণ কোরিয়া, চীন, জাপান ও ভারতের মতো দেশের সহযোগিতা গ্রহণে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরেও পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। ছয় থেকে আট হাজার কোটি টাকা প্রতিবছর উন্নয়ন বরাদ্দ রেখে বাংলাদেশ তিন-চার বছরে এ প্রকল্প সমাপ্ত করতে পারে। পদ্মা সেতু নিয়ে দৃশ্যমান ব্যাপক নির্মাণ কার্যক্রম শুরু হলে আগামী সাধারণ নির্বাচনে এ মহাপ্রকল্প আওয়ামী লীগের জন্য নির্বাচনী জয়ের মহাটনিক হিসেবেও ভোটারদের উজ্জীবিত করতে পারে। প্রয়োজন স্বাধীনতা সংগ্রামকালের সেই অদম্য ইচ্ছা, জনসংযোগ, স্বচ্ছতা এবং জাতিকে ঐক্যবদ্ধ রাখার সর্বোচ্চ প্রয়াস। আশা করি, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বিষয়টি ভেবে দেখবেন।
লেখক : অর্থনীতিবিদ
sabau47@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.