মার্চ : শুরু হলো স্বাধীনতার মাস by মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী

বছর ঘুরে মার্চ মাস আসতেই বাংলাদেশের জনগণ ১৯৭১-এর মার্চ মাসে ফিরে যায়। যত দিন বাংলাদেশ পৃথিবীতে টিকে থাকবে, তত দিন মার্চ মাসের অন্য কোনো অর্থ বা তাৎপর্য বাংলাদেশের জনগণের কাছে থাকবে না। ১৯৭১-এর পর থেকে প্রতিবছরই মার্চ মাস আসে।


কিন্তু কোনো মার্চ মাসই আমাদের ১৯৭১-এর চেয়ে বেশি আন্দোলিত বা আলোড়িত করেনি। আলোড়িত করার কোনো কারণ আমরা দেখি না। কেননা ১৯৭১ সালে মার্চ মাসে সাড়ে সাত কোটি মানুষ যেভাবে গর্জে উঠেছিল, যেভাবে প্রতিটি দিনকে স্বাধীনতা লাভের জন্য বিশেষভাবে মূল্যবান করে তুলেছিল, নিজেরা গড়ে উঠছিল, ২৬ মার্চের দিকে ধাবিত হচ্ছিল, পাকিস্তান রাষ্ট্রকে প্রত্যাখ্যান করে যেভাবে মরণপণ লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়েছিল, সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত করতে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত ও ঘোষিত মন্ত্রে মেতে উঠেছিল_এর কি কোনো তুলনা কখনো করা যায়? সেই সমতুল্যে বাঙালি এবং ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলো আর কি কখনো যেতে পেরেছে বা পারবে? না, আমরা এ পর্যন্ত যতগুলো মার্চ মাস অতিক্রম করে এসেছি, তাতে স্পষ্ট বলা যায় যে এর কোনোটিই ১৯৭১-এর ব্যাপ্তির ধারেকাছেও যাওয়ার কোনো যোগ্যতা রাখেনি। ১৯৭১-এর মার্চ মাসকে অতিক্রম করা জাতি ও রাষ্ট্রগতভাবে আমাদের পক্ষে কোনোকালেই আর সম্ভব হওয়ার নয়। কেননা ১৯৭১ সালের মার্চ মাসব্যাপী আমরা বাংলাদেশের স্বাধীনতার মতো এত বড় ইতিহাস সৃষ্টির মহতী কর্মযজ্ঞে আত্মনিয়োগ করেছিলাম যার সঙ্গে অন্য কোনো ইতিহাসের তুলনাই চলে না, চলবে না। ১৯৭১-পরবর্তী মার্চ মাসগুলো আসছে, আসবে_আমাদেরকে ১৯৭১-এর মার্চ মাসে নিয়ে যেতে, সেভাবে গড়ে তুলতে, সেভাবে উজ্জীবিত করতে। তাহলেই নতুন প্রজন্ম ১৯৭১-এর মার্চ মাস তথা স্বাধীনতা ধারণ করতে পারবে। সে কারণেই আমাদের জাতীয় জীবনের জন্য ১৯৭১-এর পর থেকে যত মার্চ মাসই আসুক না কেন, আমরা সব মার্চ মাসেই ১৯৭১-এর মার্চকে দেখতে পাব, চেষ্টা করব। ইতিহাসের এমন এক অলঙ্ঘনীয় বিষয়ের কাছে মার্চ মাসটি আমাদের জাতীয় জীবনের কাছে বাঁধা পড়ে আছে। এখান থেকে সরে যাওয়ার, ব্যতিক্রম কিছু হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
মার্চ মাসের ১ তারিখ আসতেই আমাদের মনে পড়ে যায় ১৯৭১ সালের এই দিন পাকিস্তানের স্বঘোষিত প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান আকস্মিকভাবেই ৩ মার্চ ঢাকায় পূর্ব থেকে নির্ধারিত পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বাতিলের ঘোষণা করেন। অবশ্য দাবিটি ২৮ ফেব্রুয়ারিতেই করেছিলেন জুলফিকার আলী ভুট্টো। অথচ সেই সময় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন সফল করতে হোটেল পূর্বাণীতে পাকিস্তানের সংবিধানের খসড়া তৈরিতে সবাই ব্যস্ত ছিলেন। সেই মুহূর্তে অধিবেশন স্থগিত করার ঘোষণা জনগণ এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না। সাধারণ মানুষ ওই দিন দুপুরে খবর শোনার সঙ্গে সঙ্গে রাস্তায় প্রতিবাদ করতে করতে নেমে আসে। জনগণ জানতে পারে, বঙ্গবন্ধু ওই সময় হোটেল পূর্বাণীতে অবস্থান করছেন। জনগণ তাঁর কাছেই ছুটে গেল। বঙ্গবন্ধু সমবেত হাজারো জনতার সম্মুখে এসে বক্তব্য দেন। পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বাতিল করাকে গভীর ষড়যন্ত্র হিসেবে উল্লেখ করে আন্দোলন-সংগ্রামের প্রস্তুতি নিতে জনগণকে আহ্বান জানান। সেখানেই তিনি ২ মার্চ ঢাকায়, ৩ মার্চ দেশব্যাপী হরতাল পালনের ঘোষণা দেন। একই সঙ্গে ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে জনসভা আয়োজনের ঘোষণা দেন। এ ঘোষণা বিদ্যুৎবেগে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে, মানুষ যেন বারুদের মতো জ্বলে উঠল। ঢাকার হরতাল সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ল, স্বতঃস্ফূর্তভাবে মানুষ হরতাল একে একে ৬ তারিখ পর্যন্ত পালন করল। সেই হরতালের জন্য কোনো পিকেটিং বা প্রচারণা করতে হয়নি, গাড়ি-রিকশা ভাঙচুর করতে বা পোড়াতে হয়নি। মানুষই স্বতঃস্ফূর্তভাবে হরতালের পরিধি বাড়িয়ে দিল, মিছিল নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়ে। পুলিশের গুলি উপেক্ষা করে মানুষ রাস্তায় প্রতিদিন মিছিল করতে থাকে। মিছিলে অংশ নেওয়া বেশ কয়েকজন নিহত হলেন, আহতও হলেন। বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর সহকর্মীরা পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছিলেন, জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়নের উপায় খুঁজছিলেন। জনগণ স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষায় সেই সময় ব্যাপকভাবে রাস্তায় নেমে আসতে থাকে। কিন্তু মানুষকে সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত না করে নেতার পক্ষে স্বাধীনতার ডাক দেওয়ার পরিণতি সব কিছুকে হঠকারিতামূলক বিপর্যয়ের দিকে ধাবিত করতে পারে। তাই জনগণকে আরো প্রস্তুত করা, নিজেকে বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতারূপে পরিচিত না করার অবস্থানে বঙ্গবন্ধু যান। ৭ মার্চের প্রাক্কালে ইয়াহিয়া খান ৬ মার্চ জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়ে পরিস্থিতি বাগে আনতে ১০ মার্চ ঢাকায় গোলটেবিল বৈঠক এবং ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডাকার ঘোষণা করেন। উদ্দেশ্য ছিল ৭ মার্চের জনসভাকে ম্লান করে দেওয়া। কিন্তু ঘটেছিল উল্টো ঘটনা। ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে লাখ লাখ জনতার স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতি এবং স্বাধীনতা লাভের প্রতি আকাঙ্ক্ষার স্লোগান স্পষ্টই বুঝিয়ে দিচ্ছিল বাংলাদেশের জনগণ আর পাকিস্তানে বসবাস করতে চায় না, জনগণ একমাত্র স্বাধীনতাই চায়। কিন্তু স্বাধীনতা লাভের পথটি খুবই কঠিন ছিল_যা জানতেন ও বুঝতেন নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি রাষ্ট্র-রাজনীতিকে কত গভীর প্রজ্ঞা দিয়ে বুঝতেন তা বোঝা গেল ১৮ মিনিটের ইতিহাস কাঁপানো মহান দীপ্ত ভাষণে। এমন ভাষণ তো কেউ মুখস্থ করেও দিতে পারে না। অথচ বঙ্গবন্ধু গড়গড় করে বলেই গেলেন বাঙালির হাজার বছরের চাওয়া-পাওয়া, দুঃখকষ্টের কথা, দিয়ে গেলেন স্বাধীনতার ডাকও, বুঝিয়ে দিলেন সেই স্বাধীনতা বাস্তবায়নে সবাইকে অস্ত্র হাতে যুদ্ধে যেতে হবে, ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলতে হবে। এক কঠিন যুদ্ধের দিকে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, যেখানে হয়তো তাঁর মৃত্যু হতে পারে, কিন্তু অবিচল লক্ষ্যে এগিয়ে গেলে জয় বাঙালির সুনিশ্চিত, সেটিও তিনি বুঝিয়ে দিলেন। ৭ মার্চ গোটা জাতিকে নতুনভাবে উজ্জীবিত করল, স্বপ্ন দেখাল, করণীয় পথও দেখিয়ে দিল। স্বাধীনতার ঘোষণা যথানিয়মে হয়েও গেল। ৭ মার্চ হয়ে উঠল স্বাধীনতা সংগ্রামের এক অনন্য অসাধারণ ঐতিহাসিক দিবস, মাইলফলক; যেখান থেকে পিছিয়ে আসা গোটা জাতির পক্ষে আর সম্ভব ছিল না। সূচিত হলো পাকিস্তান সরকার ও রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতি অসহযোগ আন্দোলন, পাকিস্তানকে প্রত্যাখ্যান করার সামগ্রিক মানসিকতা। কার্যত পূর্ববাংলা তখন বঙ্গবন্ধু তথা জনগণের পছন্দের নেতৃত্বের হাতেই চলে আসে। কিন্তু তার পরও সামরিক শক্তি, রাষ্ট্রযন্ত্র বলে একটি মহাদানবীয় ব্যাপার ছিল, ছিল আন্তর্জাতিক মহাশক্তিধর রাষ্ট্রব্যবস্থার অবস্থান ইত্যাদি। সব কিছু ঠিক রেখে, নিয়মের মধ্যে রেখে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব তখন মানুষকে মুক্তিযুদ্ধের জন্য মানসিক এবং সশস্ত্রভাবে প্রস্তুতি নিতে সাহস দেয়। সেই পর্ব চলতে থাকে পরবর্তী দিনগুলোতে। পাকিস্তান রাষ্ট্রব্যবস্থাকে বিশ্ব পরিসরে আক্রমণকারী, আগ্রাসী এবং অন্যায়কারী অপশক্তিরূপে বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরা, চিহ্নিত করা ছাড়া বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক নেতৃত্বের অন্য কোনো সুযোগ নেই। বঙ্গবন্ধু যেন গুনে গুনে তাই করলেন। ২৫ মার্চ পাকিস্তানের শাসক শ্রেণী প্রতিশ্রুত জাতীয় পরিষদের অধিবেশনের পরিবর্তে কামান, ট্যাংক, গোলাবারুদ নিয়ে নিরস্ত্র মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। মানুষের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাকে তারা কামান-ট্যাংকের নিচে গুঁড়িয়ে দিতে সচেষ্ট হলো। পাকিস্তানিরা ধারণা করেছিল, তাতে বাঙালির স্বাধীনতার স্বপ্নকে স্তব্ধ বা গুঁড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হবে। কিন্তু হলো ঠিক উল্টোটি, বাঙালির প্রত্যাশিত স্বাধীনতার যাত্রাই শুরু হলো, বাংলাদেশ ভূখণ্ডে পাকিস্তানের ইতি ঘটল, চিরবিদায়ের ঘোষণা বেজে উঠল।
মানুষের শক্তি কত প্রবল হলে সাড়ে সাত কোটি নিরস্ত্র মানুষ ২৫ মার্চের পর মাথা এত উঁচু করে দাঁড়াতে পারে, সেখান থেকে মুক্তিযুদ্ধের অস্ত্র হাতে নিয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সুদৃঢ় অবস্থান তৈরি করতে পারে_এমন শক্তি সাড়ে সাত কোটি মানুষ কোথা থেকে পেল তা আজও বিস্ময়ের সঙ্গে ভাবতে হয়, নতুন প্রজন্মকে ভাবিয়ে তোলে। এভাবে ভাবিয়ে তোলার মধ্যেই এ দেশের প্রত্যেক নাগরিক ১৯৭১-এর শক্তিকে নতুন করে ধারণ করার সুযোগ পায়, সেই আগুনে নিজেদের পোড়ানোর মাধ্যমে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের এক একজন সময়ের সাহসী মুক্তিযোদ্ধারূপে কল্পনা করতে পারে, গড়েও তুলতে পারে। ইতিহাসের এমন অদৃশ্য তরঙ্গশক্তি প্রতিবছর মার্চ মাসে প্রতিটি বাঙালি ও ক্ষুদ্র নৃজাতি-গোষ্ঠী মানুষের ভেতর দিয়ে বয়ে যায়। স্বাধীনতার ৪০তম বছরে মার্চ মাসে আমরা ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের প্রতিটি দিন, ক্ষণ, ঘটনা ও মহৎ অর্জনই যেন নতুনভাবে স্পর্শ করছি, অনুভব করছি, দেখছি, একই সঙ্গে শুনছি যেন বঙ্গবন্ধুর নতুন কোনো ৭ মার্চের ভাষণ।

লেখক : শিক্ষা ও ইতিহাসতত্ত্ববিদ

No comments

Powered by Blogger.