লিবিয়ায় পরিবর্তনের যন্ত্রণা by অতুল আনেয়া

৪২ বছর ধরে লিবিয়ায় শক্ত হাতে ক্ষমতা ধরে রাখা মুয়াম্মার গাদ্দাফির রাজনৈতিকভাবে টিকে থাকা হুমকির সম্মুখে পড়েছে। ক্ষমতার পালাবদল এখন রাজধানী ত্রিপোলির দিকে ধেয়ে আসছে। পরিবর্তনের জন্য একটি নিরস্ত্র সংগ্রাম শুরু হয়েছিল। কিন্তু রাষ্ট্রের সহিংস আচরণের মুখে আন্দোলন এখন সশস্ত্র রূপ নিয়েছে।


আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে পূর্ব লিবিয়া ইতিমধ্যে বিরোধীদের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। ক্ষমতাসীন শাসক যে টিকে থাকতে পারবে না সে ব্যাপারে এখন আর কোনো প্রশ্ন নেই। লিবিয়ার বাইরে মুয়াম্মার গাদ্দাফির এখন আর কোনো বন্ধু অবশিষ্ট নেই যে তাকে উদ্ধার করবে। এখন প্রশ্ন হলো, কিভাবে তিনি ক্ষমতা থেকে সরে যাবেন? তাঁর বদলে কে আসবেন? হঠাৎ করে তিনি ক্ষমতা ছাড়বেন, নাকি সামরিক অভ্যুত্থান হবে? নাকি সংক্ষিপ্ত একটি গৃহযুদ্ধের মাধ্যমে এর সমাধান হবে, যখন তাঁর অনুসারী বাহিনী ত্রিপোলিকে আর ধরে রাখতে পারবে না? এর বাইরে আরেকটি সম্ভাব্য বিষয় হতে পারে। তাহলো ভূমধ্যসাগরের পার ধরে গাদ্দাফি-বিরোধীরা যখন এগিয়ে আসছে তখন অনুগত বাহিনীর ভেতর থেকে পাপের প্রায়শ্চিত্ত করে পেছন থেকে কেউ হুল ফোটাতে পারে?
গাদ্দাফির সমস্যার সমাধান হওয়ার সম্ভাবনা এখন ক্ষীণ হয়ে এসেছে। কারণ এখন তাঁর সমর্থনের ভিত্তি দুর্বল হয়ে এসেছে। কয়েক দশক ধরে গাদ্দাফিকে কোনো বড় চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়নি। কারণ তিনি বেছে বেছে বিশেষ উপজাতিকে কাজে লাগিয়েছেন, তেল থেকে যে অপ্রত্যাশিত আয় হয়েছে সেটা ব্যবহার করেছেন।
১৯৬৯ সালে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা গ্রহণ করে প্রথম বছরগুলোতে তিনি মিসরের গামাল আবদেল নাসেরের মতো আরব জাতীয়তাবাদের পথ অনুসরণ করেছিলেন। এর ফলে তিনি দেশের অভ্যন্তরে প্রশংসিত হয়েছিলেন। কিন্তু সুদান থেকে ফিলিস্তিন পর্যন্ত আরব ঐক্য ধরে রাখতে গিয়ে যখন ব্যয়ভার বেড়ে যায়, তখন তেলের আয় দিয়ে আর লিবিয়ার মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন হয় না। ফলে গাদ্দাফির নিজের দেশের মানুষের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটতে থাকে। চার দশক ধরে লিবীয়দের অসন্তোষ ধীরে ধীরে ঘনীভূত হয়ে উঠছিল। শেষ পর্যন্ত তা বিস্ফোরিত হলো। লিবিয়ার এ দুর্দশার একটি বড় কারণ এর অর্থনীতি। একটি নেতৃস্থানীয় তেল রপ্তানিকারক দেশ হয়েও লিবিয়ার জনসংখ্যার একটি বড় অংশ প্রতিদিন দুই ডলারের কম আয় করে।
লিবিয়ার উপজাতি সমস্যাও এ ক্ষেত্রে কাজ করেছে। বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের অভাব এবং নাগরিক স্বাধীনতা রহিত হওয়ার কারণে সেখানে লিবীয় জাতীয়তাবাদ গড়ে উঠতে পারেনি। বহুকাল ধরে লিবিয়ার পূর্বাঞ্চলে রয়েছে ঐতিহ্যবাহী সিরেনাইকা। লিবীয় রাজা ইদ্রিসের কেন্দ্র ছিল এ এলাকা। ১৯৬৯ সালে তাঁকে উৎখাত করেন গাদ্দাফি। এবং তখন থেকেই এ অঞ্চলের মানুষ বৈষম্যের শিকার। গাদ্দাফির অধীনে ত্রিপোলিতানিয়ার অংশ ত্রিপোলি হয়ে ওঠে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু। গাদ্দাফির নিজের গোষ্ঠী খাদাদফার সদস্যরা এ অঞ্চলে প্রভাবশালী এবং তারাই নতুন শাসনের ফায়দা লুটতে থাকে। সে কারণেই বেনগাজি থেকে বিদ্রোহের শুরু হওয়াটা কোনো অবাক করার বিষয় নয়। ১৯৬৯ সালের আগে বেনগাজিই ছিল লিবিয়ার রাজধানী।
মানবাধিকার পরিস্থিতি এবং রাজনৈতিক দাবিও এ বিদ্রোহের পেছনে কাজ করেছে। ১৫ ফেব্রুয়ারি ফাতি তারবিলের আটকাদেশের পর লিবিয়া জ্বলে ওঠে। ৩৯ বছর বয়সী বেনগাজির এ আইনজীবী হলেন সেই এক হাজার মানুষের পরিবারের প্রতিনিধি, যাদের ১৯৯৬ সালে ত্রিপোলির আবু স্লিম কারাগারে হত্যা করা হয়। তার আটকাদেশের বিরুদ্ধে ওই পরিবার ১৭ ফেব্রুয়ারি প্রতিবাদের আয়োজন করে। এ ছাড়া গত দুই বছর ধরে শান্তিপূর্ণ দাবি ছিল একটি নতুন সংবিধানের। সে দাবির পেছনে ছিলেন বেনগাজিভিত্তিক একদল আইনজীবী।
গাদ্দাফির এই একা হয়ে যাওয়ার পেছনে দুটো জিনিস একত্রে কাজ করেছে; তাহলো ১৯৬৯ সালের অভ্যুত্থানের পর থেকেই নিরাপত্তার অভাব বোধ এবং ক্ষমতার লোভ। ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ করতে তিনি তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীদের নিঃশেষ করেছেন।
১৯৭৫ সালে মেজর উমর মিহাইস এবং আরো ৩০ জন সেনা কর্মকর্তা তাঁকে উৎখাতের ব্যর্থ চেষ্টা করার পর তিনি তাঁর মুষ্ঠি আরো শক্তিশালী করেন। ১৯৮০ সালে অসফল সেনা বিদ্রোহের পর তিনি কয়েক শ মানুষকে হত্যা করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। সেনাবাহিনীকে বিপজ্জনক মনে করে তিনি পদ্ধতিগতভাবে প্রচলিত সেনাবাহিনীকে দুর্বল করে ফেলেন। এর বিকল্প হিসেবে তিনি রেভ্যুলেশনারি গার্ড কর্পসকে (আরজিসি) শক্তিশালী করে তোলেন। এ বাহিনীর তিন হাজার সদস্যকে আধুনিক সরঞ্জাম দিয়ে শক্তিশালী করা হয়। বাহিনীর অধিকাংশ সদস্য তাঁর নিজের উপজাতি খাদাদফার এবং নিজের শহর সুর্টের থেকে আসা।
তবে গাদ্দাফি যে শুধু আরব ধারণার জন্য বা অর্থনৈতিক কারণে পতনের মুখে, তা নয়। তাঁর কর্তৃত্বপরায়ণ ধারণা এবং নিষ্ঠুর পথে তাঁকে প্রতিষ্ঠিত করার ধরনও তাঁর বিরুদ্ধে মানুষকে জাগিয়ে তুলেছে।

দ্য হিন্দু থেকে সংক্ষিপ্ত ভাষান্তর : মহসীন হাবিব

No comments

Powered by Blogger.