গ্লোবাল সোশ্যাল ভেনচার প্রতিযোগিতা ২০১২-পাটে পুরস্কার by মারুফ ইসলাম

যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠিত জিএসভিসি চূড়ান্ত প্রতিযোগিতায় ১০ হাজার ডলার মূল্যমানের পুরস্কার জিতে নিয়েছে বাংলাদেশের গ্রিননোভিশন টেকনোলজিস। যুক্তরাষ্ট্র, সুইডেন, কেনিয়া, ইতালির পাশে ‘বাংলাদেশ’ নামটা বিস্ময় জাগায় বিচারকদের মনে।


তাঁরা ভেবে পান না, তৃতীয় বিশ্বের অনুন্নত এই দেশের তরুণেরা মেধাচর্চার সময় পায় কখন? খরা-বন্যা-জলোচ্ছ্বাসসহ নানান প্রাকৃতিক দুর্যোগ যাদের নিত্যসঙ্গী, তারা কিনা গ্লোবাল সোশ্যাল ভেনচার প্রতিযোগিতার (জিএসভিসি) চূড়ান্ত আসরে! বিচারকেরা অবশ্য তখনো জানেন না ‘গ্রিননোভেশন টেকনোলজিস’ নামের বাংলাদেশের এই তরুণ দলই কিনা দিন শেষে রানারআপ শিরোপা জয় করে তাদের বিস্ময়কে শীর্ষ চূড়ায় নিয়ে যাবে!
এই বিস্ময়ের শুরু ভারতের হায়দরাবাদে। এ বছরের ১০ মার্চ সেখানেই বসেছিল এ বছরের গ্লোবাল সোশ্যাল ভেনচার প্রতিযোগিতার (জিএসভিসি) আফ্রো-এশিয়া অঞ্চলের চূড়ান্ত প্রতিযোগিতা। সেখানে আফ্রিকা ও এশিয়ার ৫০টি দেশের বাঘা বাঘা মেধাবী তরুণের সঙ্গে বাংলাদেশের চার তরুণের সংগঠন ‘গ্রিননোভেশন টেকনোলজিস’ হাজির হয়েছিল নিজেদের ব্যবসায়িক ভাবনা নিয়ে লড়াই করার জন্য। এ দলের সদস্যরা হচ্ছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজনেস স্টাডিজ অনুষদের ফিন্যান্স ও অ্যাকাউন্টিংয়ে পড়ুয়া সাইমুম হোসেন, বাঁধন মজুমদার, সাগর মেহেদী হাসান ও হাসানুল কাদের। কথা ছিল, এই আঞ্চলিক পর্বে চ্যাম্পিয়ন হতে পারলেই সুযোগ মিলবে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় অনুষ্ঠেয় ফাইনাল পর্বে লড়াই করার। সেদিন বাংলাদেশের এই তরুণেরাই হেসেছিলেন শেষ হাসি। আফ্রো-এশিয়া পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল বাংলাদেশের গ্রিননোভিশন টেকনোলজিস।
অতঃপর ১৮ এপ্রিল ২০১২। ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, বার্কলে, যুক্তরাষ্ট্র। সেদিন সেখানেই অনুষ্ঠিত হলো গ্লোবাল সোশ্যাল ভেনচার প্রতিযোগিতার ফাইনাল। তাতে পৃথিবীর ৩৭৪টি বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন সহস্রাধিক শিক্ষার্থীর সঙ্গে লড়াইয়ে অংশ নিলেন বাংলাদেশের সাইমুম হোসেন ও বাঁধন মজুমদার।
‘চূড়ান্ত লড়াইটা জমেছিল বেশ। কিন্তু তীরে এসে তরী ডোবা আর কাকে বলে! অল্পের জন্য আমরা চ্যাম্পিয়ন হতে পারিনি। এবারের জিএসভিসি আসরের চ্যাম্পিয়ন হয় ইউনিভার্সিটি অব উইজকনসিন, ম্যাডিসন।’ সেদিনের স্মৃতি বাঁধনের মুখে। কিন্তু এ পরাজয় বিজয়ের সমতুল্য। রানারআপ হয়েও সাইমুম-বাঁধনরা জিতে এনেছেন ১০ হাজার ডলার মূল্যমানের (বাংলাদেশি টাকায় প্রায় সাড়ে আট লাখ টাকা) পুরস্কার। বয়ে এনেছেন দেশের জন্য সম্মান। জিজ্ঞাসা করি, ‘এত টাকা নিয়ে এখন কী পরিকল্পনা? উত্তরে বাঁধন, ‘আমরা আমাদের প্রকল্পকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই। এই অর্থ আমরা আমাদের প্রকল্প বাজারজাতকরণে ব্যবহার করব।’
যে প্রকল্পের জন্য এই পুরস্কার, তার নাম ‘পাট থেকে ঢেউটিন’। সাইমুম বলেন, ‘আমরা শুরু থেকেই ভাবছিলাম এমন পণ্য নিয়ে কাজ করব, যা হবে একই সঙ্গে পরিবেশবান্ধব ও সুলভ মূল্যের। সেই ভাবনা থেকেই পাটের তৈরি ঢেউটিন বাজারজাতকরণের চিন্তা আসে মাথায়।’ তাঁদের ভাবনা যে পুরোটাই সময়োপযোগী ছিল তার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে জোরেশোরেই। ইতিমধ্যে এই প্রকল্পের কল্যাণে তাঁরা পেয়েছেন ২০১০ সালের এইচএসবিসি ইয়াং এন্টারপ্রেনিউরশিপ অ্যাওয়ার্ড, ২০১১ সালে দ্য আলগোর সাসটেইনেবল টেকনোলজি অ্যাওয়ার্ড, ২০১২ সালে গ্লোবাল হেলথ অ্যাওয়ার্ড এবং সর্বশেষ যুক্তরাষ্ট্র থেকে গ্লোবাল সোশ্যাল ভেনচার প্রতিযোগিতার রানারআপ অ্যাওয়ার্ড।
তবে সাইমুম ও বাঁধন স্মরণ করিয়ে দেন, ‘পাট থেকে ঢেউটিন—এই প্রকল্পের উদ্ভাবক আমরা নই। আমরা এই পণ্যের বাজারজাতকরণের কৌশল নিয়ে কাজ করছি মাত্র। প্রকল্পটি উদ্ভাবন করেছেন বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের বিজ্ঞানী ড. মোবারক আহমদ খান।’
সাইমুম ও বাঁধন কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন আনোয়ার গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রির ব্যবস্থ্থাপনা পরিচালক হোসেন খালেদ এবং ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির প্রেসিডেন্ট আসিফ ইব্রাহীমের প্রতি। তাঁদের ভাষায়, ‘এ পুরস্কার অর্জন ও সাফল্য সম্ভব হতো না, যদি তাঁরা এগিয়ে না আসতেন। তাঁরা স্পন্সর করেছিলেন বলেই আমরা যুক্তরাষ্ট্রে এ প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পেরেছি।’
সাইমুম-বাঁধনরা দেখিয়েছেন যে বাংলাদেশও পারে। তাই তাঁদের কাছে সবার প্রত্যাশাও এখন অনেক বেশি। এই প্রত্যাশার কথা মাথায় রেখে তাঁরা তাঁদের স্বপ্নকে বাড়াচ্ছেন দৈর্ঘ্যে ও প্রস্থে। তাঁদের স্বপ্ন এখন এই পণ্যকে বিশ্বব্যাপী পরিচিত করানো। এবং একই সঙ্গে স্বপ্ন বাংলাদেশের পরিচিতিটাও হবে বিশ্বব্যাপী। আর সে পরিচিতিটা হবে অবশ্যম্ভাবীভাবেই ইতিবাচক।

No comments

Powered by Blogger.