জেলা জজ, অতিরিক্ত জেলা জজের শতাধিক পদ খালি-দেশজুড়ে বিচারক সংকট বিচারপ্রার্থীদের দুর্ভোগ by আশরাফ-উল-আলম

বিচারপ্রার্থীর পক্ষে আইনি লড়াই করাই আইনজীবীদের কাজ। কিন্তু বিচারক না থাকলে সেই সুযোগ কোথায়? এ কারণে এবার আদালতে বিচারক নিয়োগের দাবিতে লড়াইয়ে নেমেছেন মেহেরপুর জেলার আইনজীবীরা। কারণ সেখানে বিচারকের অভাবে ভোগান্তি পোহাচ্ছেন বিচারপ্রার্থীরা।


বিচারকের শূন্যপদ পূরণের দাবিতে কয়েক মাস আগে সংবাদ সম্মেলন করেন নোয়াখালীর আইনজীবীরাও। কিন্তু বিচারকের শূন্যতা এখনো কাটেনি সেখানে।
শুধু মেহেরপুর ও নোয়াখালীতেই নয়, ঢাকা, চট্টগ্রাম রাজশাহী, খুলনাসহ অনেক জায়গায়ই বিচারক সংকট তীব্র। চট্টগ্রামে বিচারক সংকট নিরসনের দাবিতে কিছুদিন আগে সংবাদ সম্মেলন করে নানা কর্মসূচি ঘোষণা করে একটি মানবাধিকার সংগঠন।
আইন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে জেলা জজ মর্যাদার ১৮টি বিচারকের পদ খালি আছে। অতিরিক্ত জেলা জজের পদ খালি আছে ৭০টি। এটি এ বছরের শুরুর দিকের হিসাব। এরই মধ্যে আরো পদ খালি হয়েছে বলে জানা গেছে। এসব খালি পদ পূরণের জন্য আইন মন্ত্রণালয় একটি প্যানেল তৈরি করে সুপ্রিম কোর্টের অনুমোদনের জন্য পাঠিয়েছে। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট থেকে এখনো কোনো নির্দেশনা না আসায় পদগুলো পূরণ করা যাচ্ছে না।
অন্যদিকে বিভিন্ন আদালত সূত্রে জানা গেছে, এরই মধ্যে জেলা জজের ২৫টির বেশি পদ শূন্য হয়েছে। অন্যদিকে অতিরিক্ত জেলা জজের শূন্যপদের সংখ্যা ৯০ ছাড়িয়ে গেছে।
আইন কমিশনের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এম শাহ আলম এ প্রসঙ্গে কালের কণ্ঠকে বলেন, 'বিচার বিভাগে অনেক পদ শূন্য রয়েছে বলে শুনেছি। শূন্য পদগুলো পূরণের জন্য নতুন নিয়োগ ও পদোন্নতির বিষয়ে আইন মন্ত্রণালয় ও সুপ্রিম কোর্টের দ্রুত উদ্যোগ নেওয়া উচিত। অন্যথায় দেশের আদালতগুলোতে মামলাজট আরো বাড়বে। বিচারপ্রার্থীদের দুর্ভোগও বাড়বে।'

এ বিষয়ে সাবেক জেলা ও দায়রা জজ মো. নুরুল হক বলেন, বিচার বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ পদে পদোন্নতির বিষয় বেশি দিন আটকে রাখা উচিত নয়। এটা হলে বিচারকদের মধ্যেই এক ধরনের হতাশা দেখা দেয়, যার প্রভাব বিচার বিভাগের ওপর পড়ে। পদ খালি থাকলে নতুন নিয়োগও দেওয়া উচিত। না হলে মামলাজট আর বিচারপ্রার্থীদের দুর্ভোগ বাড়া ছাড়া কমবে না।
মেহেরপুরে মানববন্ধন : মেহেরপুরের আইনজীবীরা সেখানকার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক নিয়োগের দাবিতে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছেন গত ৫ এপ্রিল। আইনজীবীদের দাবি, বিচারকশূন্যতায় ওই আদালতে শত শত মামলার বিচার ঝুলে আছে। বিনা বিচারে কারাগারে কাটাতে হচ্ছে অনেক বন্দিকে।
মেহেরপুর আদালত সূত্রে জানা গেছে, গত ডিসেম্বর থেকে মেহেরপুর জেলা ও দায়রা জজ আদালতে বিচারক নেই। এ কারণে নারী ও শিশু, বিশেষ ট্রাইব্যুনাল ও দায়রা আদালতে প্রায় এক হাজার নতুন মামলা বিচারের অপেক্ষায় ঝুলে আছে। এ ছাড়া পুরনো আরো প্রায় তিন হাজার মামলার বিচারকাজ থমকে গেছে। দীর্ঘদিন ধরে জেলা জজ না থাকায় অনেক বিচারপ্রার্থী জামিনের সুযোগ পাচ্ছেন না।
জানা গেছে, মেহেরপুর আদালতে জেলা জজ ছাড়াও অতিরিক্ত জেলা জজ ও দুজন যুগ্ম জেলা জজের পদ বহুদিন ধরে শূন্য রয়েছে। শূন্য রয়েছে সহকারী জজ ও বিশেষ জজ আদালতের বেশ কিছু পদও।
রাজশাহীতে গুরুত্বপূর্ণ পাঁচটি পদ শূন্য : মাঝেমধ্যে কিছুদিনের জন্য প্রয়োজনীয়সংখ্যক বিচারক পাওয়া গেলেও বেশির ভাগ সময়ই বিচারকস্বল্পতা থাকে রাজশাহীতে। জেলায় বর্তমানে পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ বিচারকের পদ শূন্য থাকায় সুষ্ঠু বিচার থেকে বিচারপ্রার্থীরা বঞ্চিত হচ্ছেন বলে জানা গেছে। অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ও অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিমের পদ প্রায় এক বছর খালি ছিল। অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতের একটি পদ এবং তিনটি যুগ্ম জেলা জজ আদালতের দুটি পদ খালি দীর্ঘদিন ধরে।
চট্টগ্রামে ২৫ বিচারকের পদ খালি : চট্টগ্রামের বিভিন্ন আদালতে ২৫ বিচারকের পদ শূন্য রয়েছে দীর্ঘদিন ধরে। বিচারক শূন্যতার কারণে এসব আদালতে মামলার স্তূপ জমতে শুরু করেছে। চট্টগ্রাম আদালতে লক্ষাধিক মামলা বিচারাধীন। বিচারক শূন্যতার কারণে শুধু মামলার স্তূপই জমছে না, বিচারপ্রার্থীরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন; তাঁরা ভেঙে পড়ছেন মানসিকভাবেও।
কুড়িগ্রামে ঝুলে আছে ২২ হাজার মামলা : কুড়িগ্রাম জেলা ও দায়রা জজ আদালত এবং বিচার বিভাগীয় হাকিমের আদালতে ২২ হাজারের বেশি মামলা ঝুলে রয়েছে বিচারক সংকটের কারণে। জানা গেছে, জেলা ও দায়রা জজ, যুগ্ম জেলা জজের একটি পদ এবং সহকারী জজের পাঁচটি পদ বহুদিন ধরে শূন্য। মুখ্য বিচার বিভাগীয় হাকিম আদালতের ৯টি পদের মধ্যে ছয়টিই শূন্য রয়েছে। এ কারণে মামলা যথাসময়ে নিষ্পত্তি হচ্ছে না। বিচারপ্রার্থীরা হয়রানির শিকার হচ্ছেন।
একই চিত্র ঢাকা, নোয়াখালী, কক্সবাজারে : জানা গেছে, নোয়াখালীতে জজ আদালত ও ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ১০টিরও বেশি পদ শূন্য রয়েছে। ঢাকার জজ আদালত ও ম্যাজিস্ট্রেট আদালতেও গুরুত্বপূর্ণ অনেক বিচারকের পদ শূন্য। খুলনায় বিশেষ জজ আদালতের পদ ধীর্ঘদিন ধরে খালি রয়েছে। কক্সবাজার জেলা আদালতে বিচারকের পদ শূন্য থাকায় গুরুত্বপূর্ণ মামলার শুনানি হচ্ছে না। সেখানে ৪০ হাজারেরও বেশি মামলা রয়েছে। আইনজীবীরাও শূন্যপদ পূরণের দাবি জানিয়ে বিবৃতি দিচ্ছেন।
বিচারকের পদশূন্য আদালতগুলোতে অন্য আদালতের বিচারকরা সাময়িকভাবে দায়িত্ব পালন করলেও তাঁরা জামিন আবেদনের শুনানি ছাড়া মূল মামলার শুনানি গ্রহণ করেন না। ফলে বিচারকাজ বিঘি্নত হচ্ছে। বিচারাধীন মামলার সংখ্যাও বাড়ছে।
২০০৭ সালের ১ নভেম্বর নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথক হলেও মামলাজট কমছে না। বরং বেড়েই চলেছে। মামলাজট বাড়ার প্রধান কারণ হিসেবে আইনজীবীসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বিচারক সংকটকেই দায়ী করছেন।
পদোন্নতির ফাইল আটকা : আইন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, অতিরিক্ত জেলা জজ হিসেবে পদোন্নতি দিতে যুগ্ম জেলা জজদের প্যানেল প্রণয়নের জন্য বিভাগীয় পদোন্নতি কমিটির সভা হয় গত ৬ ও ২৮ ফেব্রুয়ারি আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আইন ও বিচার শাখায়। সভায় ১৫৭ জনের বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদন যাচাই-বাছাই করে ১১৯ জন যুগ্ম জেলা জজকে অতিরিক্ত জেলা জজ হিসেবে পদোন্নতি দেওয়ার জন্য সুপারিশ করা হয়। ওই সুপারিশের কপি সুপ্রিম কোর্টে পাঠানো হয় গত ৬ মার্চ অনুমোদনের জন্য। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট থেকে কোনো নির্দেশনা এখনো আসেনি। তবে সুপ্রিম কোর্টের একটি সূত্রে জানা যায়, সুপ্রিম কোর্ট তালিকাটি যাচাই-বাছাই করছে।
মন্ত্রণালয় থেকে সুপ্রিম কোর্টে পাঠানো সুপারিশে বলা হয়েছে, আগামী এক বছরের মধ্যে জেলা জজের ৩৫টি পদ শূন্য হবে। আর অতিরিক্ত জেলা জজের পদ শূন্য হবে ১১৫টি। এ কারণে পদোন্নতি যাঁদের দেওয়া হবে তাঁদের প্যানেল তৈরি করা প্রয়োজন।
অভিজ্ঞজনদের মতে, প্যানেল তৈরি করে জরুরি ভিত্তিতে বর্তমান শূন্য পদে নিয়োগ দেওয়া না হলে বিচার বিভাগ ভেঙে পড়বে। আবার পরে আরো পদ শূন্য হলে ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হবে।
এদিকে সম্প্রতি ১২৯ জন সিনিয়র সহকারী জজকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। তাঁদের যুগ্ম জেলা জজ পদে পদায়ন করার বিজ্ঞপ্তিও এরই মধ্যে জারি করেছে আইন মন্ত্রণালয়। পদোন্নতিপ্রাপ্ত বিচারকরা দেশের বিভিন্ন আদালতে কাজে যোগদান করতে শুরু করেছেন। যুগ্ম জেলা জজের শূন্য পদ পূরণ হলেও সিনিয়র সহকারী জজ ও সহকারী জজের পদ আবার শূন্য হবে। এ ক্ষেত্রে নতুন নিয়োগ দেওয়া না হলে আদালতে বিচারক সংকট থেকে যাবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
জানা গেছে, জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশন সহকারী জজ নিয়োগের সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছে। সহকারী জজ হিসেবে নিয়োগপ্রার্থীদের মৌখিক পরীক্ষা শেষ হয়েছে প্রায় চার মাস আগে। যাঁদের নিয়োগ দেওয়া হবে তাঁদের তালিকাও চূড়ান্ত হয়েছে। কিন্তু এখনো নিয়োগ দেওয়া হয়নি।
প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেন গত জুলাইয়ে গোপালগঞ্জ জেলা আইনজীবী সমিতি মিলনায়তনে এক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে দেশে বিচারকস্বল্পতার কথা স্বীকার করেন। তিনি বলেন, 'আমাদের বিচারব্যবস্থায় বিচারকদের স্বল্পতা বয়েছে।'

No comments

Powered by Blogger.