পাইরেসি প্রতিরোধে চাই কপিরাইট সমিতি by মুহম্মদ নূরুল হুদা

পাইরেসি প্রতিরোধ বা কপিরাইট লঙ্ঘনরোধের একটি প্রধান হাতিয়ার কপিরাইট সমিতি গঠন। উদ্যোগটা নিতে হবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে যারা অধিকারের মালিক তাদেরকেই। সাহিত্য, শিল্প, সঙ্গীত, কম্পিউটার থেকে শুরু করে বিভিন্ন ক্ষেত্রের অধিকারের মালিকদের অবশ্যই একজোট হতে হবে।

তা না হলে মধ্যস্বত্বভোগীরা তাদেরকে ঠকাতেই থাকবে। বর্তমানে মোবাইল ফোন, রেডিও-টিভি ও অন্যান্য মিডিয়ায় সঙ্গীত ও প্রচারযোগ্য বিভিন্ন বিমূর্ত শৈল্পিক সৃষ্টির ব্যবসায়িক মূল্য বেড়ে যাওয়ায় প্রণেতা, স্বত্বাধিকারী ও কন্টেম্লট প্রোভাইডাররা এ সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠেছেন। লেখকরাও তত্পর হতে শুরু করেছেন। সঙ্গীতের ক্ষেত্রেও একাধিক সমিতি গঠনের উদ্যোগ চলছে বলে জানা গেছে। তবে সমিতি গঠন প্রক্রিয়া সম্পর্কে অনেক বিশেষজ্ঞও সংশয়মুক্ত নন। যে কোনো ক্ষেত্রে একটি সমিতি গঠিত ও নিবন্ধিত হলে বিষয়টি খোলাসা হয়ে যাবে। মূল আইনের ধারাগুলোতে (৪১-৪৭) কপিরাইট সমিতির নিবন্ধন (৪১), সমিতি কর্তৃক মালিকদের অধিকার নির্বাহ (৪২), সমিতি কর্তৃক পারিশ্রমিক প্রদান (৪৩), সমিতির ওপর কপিরাইট মালিকদের নিয়ন্ত্রণ (৪৪), রিটার্ন ও প্রতিবেদন (৪৫), হিসাব এবং নিরীক্ষা (৪৬) ও অব্যাহতি (৪৭) ইত্যাদি বিষয় উত্থাপিত, যা কপিরাইট বিধি ২০০৬-তে আরও বিস্তৃত ও সুনির্দিষ্ট। বিধিতে কপিরাইট সমিতি নিবন্ধনের জন্য একটি নির্ধারিত আবেদন ছক (ফরম-৮) ছাড়াও মোট ১৩টি ধারায় (১৪-১৬) কপিরাইট সমিতির কার্যপ্রণালী বিশদভাবে প্রদত্ত হয়েছে, যেমন—অধিকারের ক্ষমতার্পণ (১৫), অধিকারের ক্ষমতা প্রত্যাহার (১৬), লাইসেন্স প্রদান, ফি সংগ্রহ ও এইরূপ ফি বণ্টনের শর্ত (১৭), সমিতি কর্তৃক রেকর্ড সংরক্ষণ (১৮), অডিট ও হিসাব সংরক্ষণ (১৯), বার্ষিক সাধারণ সভা (২০), রেজিস্ট্রারের কাছে সমিতির হিসাব (২১), ট্যারিফ ও বণ্টন ব্যবস্থা (২২), সমিতির সাধারণ সভা (২৩), তদন্ত প্রক্রিয়া (২৪), নিবন্ধন স্থগিত ও প্রশাসনিক নিয়োগ (২৫) ইত্যাদি। আইনে যেসব বিষয় উল্লেখিত ছিল, বিধিতে তা আরও ষমষ্ট। তবে এসব বিষয়ে আরও সহজ ব্যাখ্যা দরকার। আপাতত কপিরাইট সৃষ্টি ও তার বৈধ উপকার-বণ্টন পর্যন্ত চারটি ধাপ শনাক্ত করা যায় : (ক) প্রণেতা বা তার বৈধ স্বত্বাধিকারী, (খ) প্রণেতা বা বৈধ স্বত্বাধিকারীদের সমন্বয়ে কপিরাইট সোসাইটি, (গ) নিবন্ধিত কপিরাইট সোসাইটির কাছ থেকে ব্যবহারের জন্য লাইসেন্স গ্রহীতা (কপিরাইট সোসাইটি না থাকলে সরাসরি প্রণেতা বা বৈধ স্বত্বাধিকারীর কাছ থেকে এই লাইসেন্স নিতে হবে) এবং (ঘ) ব্যবহারকারী। সহজেই অনুমেয়, (খ)-ধাপ অর্থাত্ কপিরাইট সমিতি না থাকলেও ব্যক্তি-স্বত্বাধিকারীর সাময়িক অসুবিধা নেই, কিন্তু বিকশিত বা ক্রমবিকশিত কপিরাইট ব্যবস্থায় এটি অপরিহার্য বলে বিবেচিত। একজন সৃষ্টিশীল ব্যক্তি যদি সর্বক্ষণ তার সৃষ্টির পণ্যমূল্য সংগ্রহে ব্যস্ত থাকেন, তাহলে একপর্যায়ে তার সৃষ্টিপ্রেরণা বাধাগ্রস্ত, এমনকি রহিত হয়ে যেতে পারে। বিদ্যমান আইনে কপিরাইট সমিতি গঠনের মূল উদ্দেশ্য ‘কপিরাইটের দ্বারা সংরক্ষিত যে কোন ধরনের কর্মের ক্ষেত্রে লাইসেন্স ইস্যু বা মঞ্জুর’ করা এবং সমিতিভুক্ত স্বত্বাধিকারীদের কপিরাইট সম্পর্কিত তাবত্ স্বার্থ প্রত্যক্ষভাবে সুরক্ষা করা। যেহেতু একটি ক্ষেত্রে একাধিক সমিতি নিবন্ধনযোগ্য নয়, সেহেতু একই ক্ষেত্রের যেসব মালিক বা স্বত্বাধিকারী কপিরাইট সমিতির সদস্য নন, পরোক্ষভাবে বা অনুরুদ্ধ হয়ে তাদের স্বার্থরক্ষার বিষয়টিও নিবন্ধিত কপিরাইট সমিতির ওপর বর্তায়। প্রাপ্ত আয় থেকে পরিচালনা পর্ষদের সম্মতিতে সব স্বত্বাধিকারীর জন্য একটি সাধারণ কল্যাণ তহবিল গঠনও এই সমিতির একটি মুখ্য উদ্দেশ্য হতে পারে। উল্লেখ্য, যে কোনো অসদস্য-স্বত্বাধিকারী নির্দিষ্ট ফরমে আবেদন করে সমিতির সদস্যপদ গ্রহণ বা সদস্য-স্বত্বাধিকারী তার সদস্যপদ প্রত্যাহার করতে পারেন। কপিরাইট সমিতি গঠন করতে হলে প্রাথমিক পর্যায়ে ‘তিন বা ততধিক কপিরাইট স্বত্বাধিকারী’ প্রয়োজন হবে। প্রস্তাবিত কপিরাইট সমিতির একটি সঙ্ঘ-স্মারক ও সঙ্ঘবিধি থাকতে হবে। সঙ্ঘ-স্মারকে সমিতির নাম, নিবন্ধিত অফিসের ঠিকানা, উদ্দেশ্যাবলী (প্রধান অপ্রধান সব বিষয়ের বর্ণনা থাকা বিধেয়), কর্মপরিধি ও ভৌগোলিক এলাকা (জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে), আগ্রহী স্বত্বাধিকারীদের নাম ঠিকানা ও স্বাক্ষর থাকতে হবে। সঙ্ঘবিধিতে সমিতি পরিচালনার তাবত্ নিয়ম-কানুন যেমন প্রতিষ্ঠানের ধরন (যথা, সেবামূলক ও লাভালাভহীন), সদস্যদের মাসিক, বার্ষিক বা এককালীন চাঁদার হার, প্রশাসনিক ব্যয় নির্বাহের জন্য সংগৃহীত ফি থেকে অনধিক ২০% কর্তন, পরিচালনা পর্ষদ গঠন ও তাদের কর্মপদ্ধতি, নির্বাচন, সরকারি মনোনয়ন, সমিতি কর্তৃক রেকর্ড সংরক্ষণকল্পে ‘স্বত্বাধিকারী রেজিস্টার’, ‘চুক্তি রেজিস্টার’, ‘ফি রেজিস্টার’ ও ‘অর্থ প্রদান রেজিস্টার’ যথাযথভাবে সংরক্ষণ, বার্ষিক সাধারণ সভা, মাসিক সভা, জরুরি সভা, টারিফ বণ্টনের রূপরেখা, হিসাব ও নিরীক্ষা, বিধি-লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে তদন্ত ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা, পরিচালনা পরিষদের বিভিন্ন কর্মকর্তার ক্ষমতা ও দায়িত্ব, বাজেট প্রণয়ন, ব্যাংক হিসাব খোলা ও পরিচালনা, দায়বদ্ধতা, দায়মুক্তি ইত্যকার যাবতীয় বিষয় সংশ্লিষ্ট বিধিমোতাবেক প্রণীত হতে হবে। মোদ্দাকথা, স্বত্বাধিকারী-সদস্যদের দ্বারা গঠিত এই কপিরাইট সমিতির আসল উদ্দেশ্য তাদের বৈধস্বত্ব থেকে প্রাপ্ত উপকার-বণ্টন; আয়-ব্যয়ের উত্স তাদের চাঁদা ও ফি থেকে প্রাপ্ত আয়ের নির্ধারিত অংশ; এবং প্রতিষ্ঠানের প্রকৃতি সেবামূলক, সহযোগিতামূলক, তবে ব্যবসায়িক দিক থেকে অলাভজনক। কপিরাইট সমিতির নিবন্ধনের জন্য কপিরাইট রেজিস্ট্রার বরাবর আবেদন করতে হবে। রেজিস্ট্রারের কাছে আবেদনের পর নিবন্ধনের প্রযোজ্য শর্তাবলী বিবেচনা করে সরকার তিন মাসের মধ্যে আবেদন গ্রহণ বা বাতিল করতে পারে। যা হোক, এবারের অমর একুশে গ্রন্থমেলায় পাইরেসি প্রতিরোধে এ ধরনের কপিরাইট সোসাইটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।

লেখক : কবি; প্রফেসর; সভাপতি, বাংলাদেশ রাইটার্স কপিরাইট সোসাইটি

No comments

Powered by Blogger.