হুমকির মুখে বোরো চাষঃ সময় থাকতে সমন্বিত পদক্ষেপ নিন

এবার দেশের উত্তর ও দক্ষিণ অঞ্চলের স্থানবিশেষে বোরো আবাদে দেখা দিয়েছে দু’ধরনের সঙ্কট। উত্তরাঞ্চলের পাবনা জেলায় হাজার হাজার গভীর-অগভীর নলকূপ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ভেঙে পড়েছে সেচ ব্যবস্থা। এখন আবাদের ভরা মৌসুম। মাঘ মাস থেকে বোরো আবাদ শুরু হয় এবং শেষ হয় চৈত্রের মাঝামাঝি।

এ সময়ে পর্যাপ্ত সেচের বিকল্প নেই। আর এ জন্য কৃষকরা প্রধানত গভীর-অগভীর নলকূপের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু প্রয়োজনের সময় বিপুলসংখ্যক নলকূপ অকেজো পড়ে আছে। এদিকে বরিশালের গৌরনদী উপজেলায় ইরি-বোরো ধানের চারার সঙ্কট দেখা দেয়ায় কৃষকরা পড়েছে বিপাকে। ফলে সেচ সঙ্কট ও চারা সঙ্কট মিলে সংশ্লিষ্ট এলাকায় বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
জানা গেছে, পাবনা জেলায় বর্তমানে ৪৪১টি গভীর ও পাঁচ হাজারেরও বেশি অগভীর নলকূপে পানি তোলা বন্ধ রয়েছে। কাগজে-কলমে জেলায় মোট ১ হাজার ৪৫টি নলকূপ থাকলেও চালু করা সম্ভব এমন নলকূপ রয়েছে মাত্র ৮৬৫টি। সচল ৪৪১টি গভীর নলকূপও নানা জটিলতায় বন্ধ থাকায় বোরো আবাদ এখন হুমকির সম্মুখীন। অভিযোগ আছে, এগুলো বন্ধ থাকার পেছনে কাজ করছে বিআরডিবি, কৃষি বিভাগ, বিএডিসিসহ অন্যান্য প্রশাসনিক জটিলতা। এছাড়া গভীর নলকূপ সমিতির অভ্যন্তরীণ কোন্দল, বকেয়া বিদ্যুত্ বিল, ব্যাংকঋণসহ নানা ধরনের অমীমাংসিত ঝামেলাতো রয়েছেই। অগভীর নলকূপের প্রধান সমস্যা ডিজেলের চড়া দাম। জেলার প্রায় ১৬ হাজার অগভীর নলকূপের মধ্যে অব্যবহৃত পড়ে আছে পাঁচ হাজার। বেশিরভাগ নলকূপ ডিজেলচালিত হওয়ায় খরচ পোষাতে হিমশিম খাচ্ছে কৃষকরা। এ অবস্থায় চলতি বোরো মৌসুমে পাবনা জেলার নয়টি উপজেলায় প্রায় ৬০ হাজার ৫০০ হেক্টর জমি বোরো চাষ এবং তা থেকে দুই লাখ ১ হাজার ৪৫০ মেট্রিক টন বোরো ধান উত্পাদনের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। কারণ বোরো ফসলের আবাদের সাফল্য প্রধানত নির্ভর করে পর্যাপ্ত সেচ ও সার ব্যবহারের ওপর। সার সঙ্কট কাটানো সম্ভব হলেও নলকূপের সমস্যা কাটাতে না পারলে কৃষকদের নির্ভর করতে হবে বৃষ্টির ওপর। এদিকে বরিশালের গৌরনদীতে ধানের চারার সঙ্কট সৃষ্টি করেছে এবারের বৈরী প্রকৃতি। তীব্র শীত ও ঘনকুয়াশায় কৃষকদের অধিকাংশ বীজতলা নষ্ট হয়ে গেছে। ধানের দাম কম থাকায় বোরো আবাদে নিরুত্সাহিত হয়ে অনেকেই এবার বীজতলা করেনি। বর্তমানে দাম বাড়ায় তারা আবার চাষের দিকে ঝুঁকেছে। কিন্তু বীজতলা তৈরি না করায় তারাও চারা কেনার চেষ্টা করছে। এতে চারার চাহিদা বাড়ায় শুধু দামই চড়েনি, চারার অভাবও প্রকট হয়েছে। এর ওপর রয়েছে পর্যাপ্ত সেচের সমস্যা। এ অবস্থায় উপজেলা কৃষি বিভাগ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ব্যাপারে সংশয় প্রকাশ করছে।
সেচ, সার ও চারা সঙ্কট নতুন কিছু নয়। ফি বছর আবাদি মৌসুমে বিশেষত উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় বোরো আবাদ পর্যাপ্ত সেচ ও সারের অভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় খরার সময়ে পানি ওঠে না গভীর-অগভীর নলকূপে। পাশাপাশি বিদ্যুত্ ও ডিজেলের অভাবে প্রয়োজনীয় সেচ দেয়া সম্ভব হয় না। বীজতলা তৈরি থেকে আবাদ শেষ হওয়া পর্যন্ত এসব সঙ্কটের মোকাবিলা করতে হয় কৃষককে। এবারও এসব বিড়ম্বনার আলামত সৃষ্টি হচ্ছে। এ অবস্থা মোকাবিলার জন্য সংশ্লিষ্ট সব সরকারি সংস্থাকে সমন্বিতভাবে কাজ করা দরকার। কাগুজে লক্ষ্যমাত্রা তৈরির সঙ্গে সঙ্গে সেচ ব্যবস্থার হালহকিকত খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। মাঠ পর্যায়ে নলকূপ সমিতির অভ্যন্তরীণ সমস্যা মেটাতেও এসব সংস্থা বিশেষত উপজেলা কৃষি বিভাগের তত্পরতা জরুরি। চারা সঙ্কট মেটানোর ক্ষেত্রেও উপজেলা কৃষি বিভাগ তত্পর হতে পারে। কাজেই স্থানীয় সমস্যা স্থানীয়ভাবে সমাধানের জন্য কৃষকদের সঙ্গে শলাপরামর্শের প্রয়োজন রয়েছে।
এবার বিদ্যুতের অভাবে বোরো চাষ বিঘ্নিত হবে না বলে একাধিকবার ঘোষণা দিয়েছেন কৃষিমন্ত্রী। প্রয়োজনে শহরে বিদ্যুত্ সরবরাহ কমিয়ে কৃষি জমির সেচ নিশ্চিত করার কথাও বলেছেন তিনি। পর্যাপ্ত সারের জোগান সম্পর্কেও একই কথা বলেছেন। কিন্তু প্রশাসনিক জটিলতাসহ বিভিন্ন কারণে নলকূপ অকেজো থাকলে সব ধরনের উদ্যোগই বাধাগ্রস্ত হবে। কাজেই বিআরডিবি, কৃষি বিভাগ, বিএডিসি, উপজেলা কৃষি বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে মাঠ পর্যায়ে তদারকি করে খুঁজে বের করতে হবে সমস্যার যথাসম্ভব সমাধান। আবাদের ভরা মৌসুমে এ নিয়ে কালক্ষেপণের অবকাশ নেই।

No comments

Powered by Blogger.