কুড়িয়ে পাওয়া সংলাপ-দুঃখ আমার সঙ্গে থাকে সুখ যায় সুখ আসে by রণজিৎ বিশ্বাস

অনুবাদের গল্প বলুন। খুব শোনা হয় না এমন গল্প। : এক ভদ্রলোকের ছেলে বিদেশে থাকত। অনেক বছর আগের কথা। অসুখ থেকে সেরে ওঠার খবর জানিয়ে বাবার কাছে সে দুই শব্দের টেলিগ্রাম পাঠাল 'কামিং রাউন্ড'। আমার স্টাইলের 'শিক্ষিত' একজনের কাছে তিনি বার্তাটি পড়াতে গেলেন এবং জবাব নিয়ে ফিরলেন- তোমার ছেলে ঘুরে ঘুরে আসছে।


একবার এক ট্রেনিংয়ে গিয়েছিলাম। আমার আগের চাকরির সময়ের কথা। চাকরির নাম সাংবাদিকতা।
অনুবাদের এক প্র্যাকটিক্যাল সেশনে আমার অফিসের এক সহকারীর অনুবাদের সূত্র ধরে আরো দু-তিনটি গল্প পাওয়া গেল।
: আগে আপনার সহকর্মীরটি শোনান।
: ইংরেজি থেকে বাংলা অথবা বাংলা থেকে ইংরেজির বেলায় তার হাত ছিল চমৎকার। বাংলা থেকে বাংলা রূপান্তরও তার হাতে চমৎকার খুলত।
একদিন সড়ক দুর্ঘটনার রিপোর্টে তিনি শিরোনাম বসিয়েছিলেন 'ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে পাঁচজনের সলিল সমাধি।' সড়কের ওপরে যে 'সলিল সমাধি' হয় না, সেটি বোঝাতে আমরা ঘেমে উঠেছিলাম।
সেই তিনি ট্রেনিংয়ের প্র্যাকটিক্যাল সেশনে 'দ্য ভ্যাসেল ডিসচার্জড ফাইভ টনস অব হুইট'-এর অনুবাদ করেছিলেন- 'জাহাজ পাঁচ টন মাল বরখাস্ত করিয়েছে।'
আমার এক ছাত্র 'প্লে দ্য গিটার'-এর অনুবাদ করেছিল 'গিটারটি খেলো'। তার উপযুক্ত এক বন্ধু আরো এক ধাপ এগিয়ে ছিল। সে তখন কাম-এর অর্থ জানে, 'গৌ'-এর অর্থ তার তখনও শেখা হয়নি। তাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল- 'এখানে আস', ইংরেজি কী হবে? মুখ থেকে কথা পড়ার আগে তার উত্তর করেছিল- কাম হিয়ার। এবার বলো, 'ওখানে যাও' ইংরেজি কী হবে? মিনিটখানেক চিন্তার পর একটি ধমক খেয়ে সে বলেছিল- আমি নিজেই ওখানে চলে যাব, তারপর বলব- 'কাম হিয়ার'।
: এবার পেশাদারি জীবনের গল্প বলুন।
: 'সিচুয়েশন ইজ কা-আ-ম, পুলিশ ইজ পেট্রোলিং অন দ্য স্ট্রিট'-এর অনুবাদ যে হয়েছিল- পরিস্থিতি এখন শান্ত। পুলিশ রাস্তায় রাস্তায় পেট্রোল ঢালিতেছে- সে গল্পে আমি কাউকে নেব না।
আমি নেব রেডিও পাকিস্তানের একটি অনুবাদে। সংবাদ বিভাগের অনুবাদ। ইংরেজি থেকে উর্দুতে।
খবরে একটি বাক্য গেল- অস্ট্রেলিয়া কাল নর্থপোলমে যা রাহাঁহু। খবর শুনে তথ্য মন্ত্রণালয়ের এক কর্তাব্যক্তি রেডিওর নিউজ রুমে ফোন করলেন- ব্যাপারটা তো বুঝলাম না! হঠাৎ করে অস্ট্রেলিয়া উত্তর মেরুতে যাবে কেন?! আমাকে ব্যাপারটা জানান।
কতক্ষণ পর তিনি ফেরত ফোন পেলেন- স্যার গলতি হৌ গ্যয়া। উয়ো হোনা চাইয়ে থা- সাউথ পোল। কেঁউ কি সাউথ পোল অস্ট্রেলিয়াকি নজদিগ হ্যায়। [ভুল হয়ে গেছে স্যার। ওটি 'নর্থ পোল' না হয়ে হওয়া উচিত ছিল 'সাউথ পোল', কারণ উত্তর মেরুর চেয়ে দক্ষিণ মেরু অস্ট্রেলিয়ার কাছে।]'
কর্তার মাথায় আগুনের প্রবাহ নামল। মাথার মালা 'ফাটমফাটম' অবস্থায় তিনি বললেন- তোমাদের সবচেয়ে সিনিয়র লোকটিকে দাও। সিনিয়র লোক হেলেদুলে এসে আর বিরক্ত হয়ে ফোন ধরার পর কর্তার হুঙ্কারে কাঁপতে কাঁপতে বললেন- 'স্যার গলতি ডাবল হৌ গ্যয়া। নর্থ পোল তো উয়ো হোগাই নেহি, সাউথ পোল ভি নেহি হো না চাইয়ে থা। উয়ো হো না চাইয়ে যা বিজলিকা খাম্বা।' [ভুলটা ডাবল হয়ে গেছে স্যার। উত্তর মেরু তো ওটি হওয়াই উচিত হয়নি, হওয়া উচিত ছিল না দক্ষিণ মেরুও। ওটি হওয়া উচিত ছিল বিজলির খাম্বা।]।
: তারপর ওই কর্মকর্তার কী হয়েছিল?
: তিনি সম্ভবত মূর্ছা গিয়েছিলেন।
: আর একটি এগজাম্পল দিয়ে শেষ করতে পারেন।
: করতে পারি, কিন্তু আরো অনেক এগজাম্পল আমার হাতে থেকে যাচ্ছে।
: থেকে যাক, কোনো বিষয়ের ওপর আপনি তো কখনোই কথা শেষ করতে পারেন না। আরেক দিন বলবেন। এখন লাস্টটা বলে শেষ করুন।
: এটি আমার এক রসজ্ঞ সহকর্মী, যার নাম নিয়েই যথেষ্ট কৌতুক হয়, নাম তার অর্ধেন্দু, তার ড্রাইভারের মুখে নামটি আসে না বলে ওর উচ্চারণে হয়ে যায় 'অর্ধ বিন্দু'; ভয়াবহ এই ট্রান্সলেশনটির নমুনা শুনিয়ে গেছেন। অনুবাদটি শোনার পর ইন্টারভিউ বোর্ডের তিনজন তিন রকমের মন্তব্য করেছিলেন। প্রথমজন বলেছিলেন- অসাধারণ!, দ্বিতীয়জন বলেছিলেন- আমার যদি তেমন একজন থাকত!, তৃতীয়জনের উচ্ছ্বাসকাঁপা মন্তব্য ছিল- এমন কঠিন বাক্যের এমন চমৎকার ইংরেজি অনুবাদ আর হতেই পারে না।
: বাক্যটি কী?
: 'দুঃখ আমার সঙ্গে থাকে, সুখ আসে আর যায়।'
: অনুবাদটি কী হয়েছিল?!
: 'মাই ওয়াইফ লিভস উইথ মি অ্যান্ড মাই সিস্টার-ইন-ল কামস অ্যান্ড গোজ।'
লেখক : কথাসাহিত্যিক

No comments

Powered by Blogger.