নিষ্কলুষ আনন্দই আমাদের কাম্য by আতাউর রহমান

মানুষের অসহায়ত্ব অথবা দৈহিক অপারগতা অনেক সময় আমাদের হাসির কারণ হয়। মানুষকে নিয়ে মানুষই হাসাহাসি করে। নোয়াখালীতে আমার নানার বাড়ির সামনে দিয়ে এক নেটিভ ফিরিঙ্গি ভদ্রলোক একটি রুগ্ন ঘোড়ায় চড়ে প্রতি বিকাল বেড়াতে বের হতেন।

অ্যাংলো ইন্ডিয়ান আমরা তখন প্রায়ই দেখতাম, পাশাপাশি স্বদেশি খ্রিস্টানও আমাদের অঞ্চলে কম ছিল না। এরা সব ছিল ধর্মান্তরিত খ্রিস্টান। চট্টগ্রামের ভাষায় এদের বলা হতো ‘মাইট্টা ফিরিঙ্গি’ অর্থাত্ মেটে ফিরিঙ্গি। আমার নানার বাড়ির সামনে দিয়ে যে দেশীয় খ্রিস্টান ঘোড়ায় চড়ে যেতেন তার চেহারা ছিল ভাঙাচোরা, চোখ দুটিতে ছিল ক্লান্তির ছাপ। চেইন লাগিয়ে বুক পকেটের পাশে ঘড়ি রাখার জন্য অতিরিক্ত পকেটে ট্যাক ঘড়ি নিয়ে উনি ঘুরতেন। উনি রাস্তায় বের হলেই মহল্লার ছেলেপেলে উনার পেছনে লেগে যেত। মহল্লার ছেলেরা তাকে চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করত—‘সাব কোগা বাইচ্ছে’, সাহেব টেঁক ঘড়ি বের করে ভালো করে দেখে উত্তর দিতেন ‘ছোয়গা’। দিনের যে কোনো সময় সাহেবের কাছে একই উত্তর পাওয়া যেত। পরে ভেবে বের করেছিলাম, সাহেবের ঘড়ি হয়তো ১০ থেকে ২০ বছর ধরে ৬টা বেজে বন্ধ হয়ে গেছে, তাই নোয়াখালীর ভাষায় তিনি একই উত্তর দিতেন। এই তুচ্ছ উত্তরে ছেলেপেলেরা বেশ মজা পেত, কিন্তু আমরা কেউ তখন শীর্ণ ঘোড়া, ফিরিঙ্গি সাহেবের ততধিক জীর্ণ-শীর্ণ চেহারা এবং অচল ঘড়ির করুণ অবস্থা ভেবে দেখিনি। নোয়াখালী, চট্টগ্রাম ও বরিশালে তখন অনেক মিশনারী পাদ্রীদের দেখা যেত। খ্রিস্টধর্ম প্রচারই ছিল তাদের প্রধান কাজ। আমি আমার তরুণ বয়সে সাদা আলখাল্লা পরা এই মিশনারি সাহেবদের দেখেছি নোয়াখালী অঞ্চলে। এরা বেশির ভাগই শুদ্ধ বাংলা বলতে পারতেন না; কিন্তু আঞ্চলিক ভাষার অনেকটাই শিখে ফেলতেন। একদিন আমার এক খালাত ভাই এক মিশনারি পাদ্রিকে জিজ্ঞেস করেছিল—‘সাব আমনে কোনাই যান’, অর্থাত্ আপনি কোথায় যান? সাহেব ইংরেজি স্বরভঙ্গিতে উত্তর দিয়েছিলেন, ‘দতের আটে’ অর্থাত্ ‘দত্তের হাটে’। তার পরের প্রশ্ন ছিল আপনি এখন ‘কোন দিকে যাইবেন?’ পাদ্রি সাহেব উত্তর দিয়েছিলেন—‘উতুর মুই’ অর্থাত্ উত্তর দিকে। ধর্ম প্রচারের কাজ মিশনারিদের জন্য সব দেশেই কঠিন ছিল, সবচেয়ে কঠিন ছিল আফ্রিকায়। আমি কৈশোরকালে নোয়াখালী ও চট্টগ্রামে মেম সাহেব নামধারী নেটিভ ক্রিশ্চিয়ান নারীকে স্কার্ট এবং পায়ে বেল্ট লাগানো খড়ম পরে পুকুরে চাল ধুতে দেখেছি। কাঠের খড়ম, স্কার্ট এবং পুকুরে চাল ধোয়া এক মজার সমন্বয় সাধন, তবুও তারা ছিলেন মেম সাহেব। চট্টগ্রামের ছেলেপেলেরা এ ধরনের ফিরিঙ্গি মেম সাহেব দেখলে চেঁচিয়ে বলে উঠত, ‘মেম মেম কুরার ডেম’। মুরগিকে চট্টগ্রামের ভাষায় কুরা বলা হয়। ছন্দ মেলাবার জন্য ডিমকে ডেম বলা হতো। দিন কয়েক আগে এক বন্ধুর পুত্রের বৌ-ভাতে গিয়েছিলাম। আমরা কয়েকজন লাস্ট ব্যাচে খেতে বসেছিলাম। আমার সঙ্গে সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক ও তার স্ত্রী আনোয়ারা সৈয়দ হক ছিলেন। আমরা তিনজন আহার সম্পন্ন করে একসঙ্গে বের হচ্ছিলাম। বিয়ের সমৃদ্ধ খাবার আমাদের বয়সের কারও জন্য উপযোগী নয়, তবু না খেয়ে পারা যায় না। শুধু হাজিরা দিয়ে চলে আসা যায় না। সমৃদ্ধ খাবার খেতে ভয় লাগে, আবার লোভও হয়। অন্তত সামান্য কিছু না খেলে দাওয়াতদাতা অসন্তুষ্ট হন। যাই হোক, বের হওয়ার মুখে দূরের এক টেবিলে বসা এক ভদ্রলোকের সঙ্গে সৈয়দ হক পরিচয় করিয়ে দিলেন। ভদ্রলোক বয়সে প্রবীণ। পরিণত বয়স। স্যুট পরিহিত, কালের যাত্রায় চেহারাটা ভাঙাচুরা হয়ে গেছে। গায়ের রংও কৃষ্ণ। স্যুট পরিহিত ছিলেন তিনি। কুশল বিনিময় করে আমরা যার যার মতো চলে গেলাম। যাওয়ার সময় সৈয়দ হক বললেন, এই ভদ্রলোকের গায়ের রং এক সময় খুব ফর্সা ছিল। বাসায় ফেরার পথে আমরা কৈশোরে নোয়াখালীতে দেখা সমান্তরাল চেহারার এক লোকের মুখ ছবির মতো ভেসে উঠল। নোয়াখালীর সেই ভদ্রলোককে আমার দুষ্টু মামারা ‘মঁসিয়ে দলাদিয়া’ বলে ডাকত। আবার সঙ্গে সঙ্গে বলে দিল দলাদিয়া মানে দলা ধরি গেছে অর্থাত্ তালগোল পাকিয়ে গেছে। সেই লোক সবসময় লুঙ্গি-গেঞ্জি পরে চলতেন, অবশ্য কাঁধে একটা গামছা থাকত। ফরাসি মিস্টারের প্রতিশব্দ মঁসিয়ের সঙ্গে শব্দদ্যোতনায় মিল রেখে ফরাসি নামের মতো মনে হয়, এমনটি মনে করে মামারা তার ‘দলাদিয়া’ নাম রেখেছিলেন। এভাবে আমরা বধির, ল্যাংড়া, খোঁড়া, বোবা, কানা লোকদের নিয়ে রসিকতা করি। দৈহিক বৈকল্য নিয়ে ঠাট্টার সময় এসব কথা আমাদের মনে থাকে না। এরকম দৈহিক অবস্থা আমাদেরও হতে পারত, রসিকতা করার সময় আমাদের বেশিরভাগ মানুষের সেই কথাটি মনে থাকে না। একের অসহায়ত্ব অন্যের কাছে হাসির বিষয় হতে পারে, এটা আমাদের অস্থায়ী জীবনের আরেক পরিহাস। আমাদের সামনে কোনো মানুষ আছাড় খেলে আমরা হাসিতে ভেঙে পড়ি এবং যে আছাড় খায় সেও লজ্জা পায়। নোয়াখালীতে আমার ছোট চাচার সামনে এক লোক পিছলা মাটিতে আছাড় খেয়ে পড়ে লজ্জা পেয়ে বলেছিলেন—‘আঁইতো জীবনে আছাড় খাই না, এ হইলা খাইলাম।’ উনি জীবনে কখনও আছাড় খাননি, এই প্রথম খেলেন। ওই লোক আছাড় খেয়ে ব্যথাও পেয়েছিলেন। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছিলেন। অথচ এ ঘটনা এখনও আমাদের পরিবারের অনেককে হাসায়। ইংরেজিতে বললে বলতে হয়—টু লাফ অ্যাট দ্য কস্ট অব আদারস। আমরা সংবেদনশীল হওয়ার চেষ্টা করেও পারি না, অনেক সময় দয়া-মায়াহীন হয়ে পড়ি। অন্যের দুঃখ-কষ্টে আমরা হাসাহাসি না করলে পৃথিবীটা অনেক বেশি বাসযোগ্য হবে।
লেখক : অভিনেতা ও নাট্যনির্দেশক

No comments

Powered by Blogger.