হাইতি থেকে বাংলাদেশের শিক্ষা by সাইদ আরমান

ক্যারিবীয় অঞ্চলের দ্বীপ দেশ হাইতি। ক্যারিবীয় সাগরের হুসপ্যানিওলা দ্বীপের পশ্চিমাংশের এক-তৃতীয়াংশ নিয়ে গড়ে উঠেছে হাইতি। হাইতি প্রজাতন্ত্রের আয়তন প্রায় ১০ হাজার ৭০০ বর্গমাইল। আর এর লোকসংখ্যা প্রায় এক কোটি। আটটি প্রধান পার্বত্য এলাকা নিয়ে গঠিত হাইতির শতকরা ১৮-২০ ভাগ ভূমি সমতল।

মোট জনসংখ্যার প্রায় ৭০ ভাগ লোক দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে, যারা দিনে তিনবেলা পেট ভরে খেতে পায় না। এদের প্রতিদিনের আয় দুই ডলারের নিচে। এত দরিদ্রতার পরও দেশটিকে বিশ্ববাসী চিনত না। গত ১২ জানুয়ারি ২০১০ মঙ্গলবারের পর বিবিসি, সিএনএন, আলজাজিরা টেলিভিশনসহ বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের শিরোনাম হয়েছে ক্যারিবীয় দ্বীপদেশ হাইতি। সংবাদ মাধ্যমগুলোর প্রতি মুহূর্তের খবর হচ্ছে হতভাগ্য হাইতি। কারণ ভয়াবহ ভূমিকম্পে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে দেশটির রাজধানী পোর্ট অব প্রিন্স। রিখটার স্কেলে সাত মাত্রার ওই ভূমিকম্পের পর এ পর্যন্ত প্রায় দেড় লাখ মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে বলে জানায় হাইতি কর্তৃপক্ষ। এছাড়া আরও প্রায় দুই লাখ মৃতদেহ ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে আছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। সেটা হলে মৃতের সংখ্যা হবে প্রায় সাড়ে তিন লাখ। বিধ্বস্ত হয়েছে প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মিশনের সদর দফতর, বিশ্বব্যাংকের স্থানীয় কার্যালয়সহ অনেক সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কার্যালয় ও বাড়িঘর। অদ্যাবধি হাইতির জনগণ স্বজন ও সর্বস্ব হারানোর শোকে কাতরাচ্ছে। আহাজারি ও যন্ত্রণার কাতরধ্বনি ছাড়া আর কোনো শব্দ করতে তারা যেন ভুলে গেছে। তাদের চোখে ঘুম নেই, মুখে খাদ্য ও পানি নেই, নেই মাথা গোঁজার মতো একটুখানি আশ্রয়। আহত ও মানবেতর অবস্থায় কাতরাচ্ছে প্রায় ৩০ লাখ মানুষ।
আমার এ বয়সে এত বড় একটা প্রাকৃতিক বিপর্যয় তথা মানবিক বিপর্যয় নিয়ে লিখতে হবে, তা ভাবিনি। তবে হাইতির এ ভূমিকম্প যে পৃথিবীকে একটি অনাগত আশঙ্কার কথা বলে দিচ্ছে এবং তা বিশেষত বাংলাদেশের জন্যই বড় বার্তা, এটা আজ স্বীকৃত সত্য। অতিসম্প্রতি বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে বাংলাদেশের নাম সম্ভাব্য বিপর্যস্ত দেশগুলোর শীর্ষে থাকায় তা নিয়ে আর বিশ্ববাসী প্রতিবাদ করবে না। কোপেনহেগেন সম্মেলনে হাইতি কীভাবে চিহ্নিত হয়েছে তা আমার জানা নেই। তবে বাংলাদেশের পেছনে অবশ্যই। কিন্তু দেশটিতে ভূমিকম্প যেভাবে আঘাত হেনেছে, এই মাত্রার ভূমিকম্প যদি শীর্ষস্থানের দেশটিতে আঘাত হানে তা হলে যে সবচেয়ে ঘনবসতির এ দেশের চিত্র কী হবে তা চিন্তা করতে পারছি না।
বাংলাদেশে অল্পদিনের ব্যবধানে সিডর ও আইলা আঘাত করে গেছে। যে আঘাতের চিহ্ন বাংলাদেশের মাটি থেকে এখনও শুকায়নি। এখনও দক্ষিণাঞ্চলের মানুষগুলো তিনবেলা পেটপুরে খেতে পারছে না। বাসস্থানের অভাবে উদ্বাস্তু জীবন কাটাচ্ছে। রয়েছে বিশুদ্ধ পানির অভাব, চিকিত্সাসেবা তো তাদের স্বপ্নের মতো। নানা রোগব্যাধি নিয়ে জন্ম নিচ্ছে শিশু এবং অভাব-অনাহারে, শরীরে নানাবিধ অসুখ-বিসুখ নিয়ে বড় হচ্ছে আমার দেশের এ অসহায় মানুষগুলো।
বড় দুঃখের বিষয় হচ্ছে, হাইতিসহ বাংলাদেশের মতো দুর্যোগপ্রবণ দেশগুলো নিজেরা দুর্যোগ মোকাবিলায় সম্পূর্ণ অক্ষম। সাহায্যের জন্য হাত বাড়াতে হয় উন্নতি দেশগুলোর কাছে। যারা এ বিপর্যয়ের জন্য প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অনেকটাই দায়ী। বলা বাহুল্য যুদ্ধ, প্রাকৃতিক বিপর্যয়, সামাজিক বিপর্যয় ও মহামারি চিরকালই দরিদ্র জীবনের অংশীদার অর্থাত্ দরিদ্রপ্রেমী। এরই মধ্যে বাংলাদেশ সরকার হাইতির প্রতি সমবেদনা ও সামর্থ্যানুযায়ী সাহায্যের হাত বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে। এটা সত্যিই প্রশংসনীয়। হাইতির ভূমিকম্পে বাংলাদেশের বিপর্যয়ের ঘণ্টা বাজাচ্ছে। আর বড় চিন্তার বিষয় এই অপরিকল্পিত রাজধানী-নগরী ঢাকাকে নিয়ে। যার জনসংখ্যা গড়ে প্রতিদিন বাড়ছে প্রায় দুই হাজারের কাছাকাছি।
বাংলাদেশের এই বড় শহরটির অবস্থান ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকার মধ্যে। এক জরিপে দেখা যায়, ঢাকার প্রায় দুই লাখ ভবন ভূমিকম্পে ঝুঁকিপূর্ণ। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) বলেছে, ঢাকার বেশির ভাগ ভবনই ভূমিকম্প সহনীয় প্রযুক্তিতে নির্মিত নয়। এর প্রায় ৫৪ শতাংশ ভবন দুর্বল অবকাঠামোর ওপর স্থাপিত। ঢাকার ৪১ শতাংশ ভবন নড়বড়ে এবং ৩৩ শতাংশ ভবনের অবকাঠামো (কলাম ও থাম) দুর্বল। পুরান ঢাকার ভবনগুলোর এমনিতেও হেলে পড়ার অভ্যাস রয়েছে।
হাইতির ইতিহাস দেখলে আমরা দেখব, একসময় বনজ ও খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ হলেও হাইতিতে বর্তমানে আর সে অবস্থা নেই। দেশটির বনজ সম্পদ শতকরা প্রায় দুই ভাগে এসে দাঁড়িয়েছে। বনশূন্যতার কারণে ব্যাপক ভূমিক্ষয় ও প্রাকৃতিক ভারসাম্যহীনতার সৃষ্টি হয়েছে। মাইলের পর মাইল এলাকা এখন ন্যাড়া পাহাড়। এহেন পরিবর্তন আজ তাদের এ বিপর্যয়ের বড় কারণ। ঢাকায় যেভাবে জনসংখ্যা বাড়ছে, বিল-খাল দখল করে বাড়িঘর নির্মাণ করা হচ্ছে, গাছগাছালি যে কতকাল ধরে ধ্বংস করা হচ্ছে তা আজ নগরবাসীর মনে নেই। শব্দ দূষণ, বায়ু দূষণ, নদীর পানি দূষণ এখন ঢাকাবাসীর নিত্যসঙ্গী।
কী আবাসিক এলাকা, কী বাণিজ্যিক এলাকা কিংবা শিল্প এলাকা—কোথাও কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করার এক বড় প্রতিযোগিতায় আমরা লিপ্ত। অল্প জায়গায় বেশি ভবন তৈরি, অতিমাত্রায় পানি তুলতে থাকায় পাতালস্তরে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে। আবাসন সংস্থাগুলো ভবন তৈরি করে দায়িত্ব শেষ করছে। এগুলো ভূমিকম্প সহ্য করতে পারবে কিনা তা তাদের বিবেচ্য নয়।
প্রায় দেড় কোটি জনসংখ্যার এ ঢাকা শহর নিজের অস্তিত্ব নিয়েই আতঙ্কিত। বাংলাদেশের ভেতরে ও বাইরে রয়েছে ভূমিকম্পের বড় চারটি উত্স। এদের সর্বনিম্ন মাত্রা ৭।
এ দেশে ৮ দশমিক ৭ মাত্রার একটি ভূমিকম্প ঘটেছিল ১৮৯৭ সালে। সেই ভূমিকম্পে ঢাকার বেশির ভাগ ভবন ধসে পড়ে। এরপর আরও অনেকবার ছোট-বড় মাত্রার ভূমিকম্প ঢাকায় হয়েছে। গত বছরের সেপ্টেম্বরে ৬ মাত্রার কাছাকাছি দুটি ভূমিকম্প হয়েছে বাংলাদেশে। বড় উদ্বেগের বিষয়, জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, তেহরানের পর ঢাকাই সবচেয়ে বেশি ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে। ভয় হয়, ৭/৮ মাত্রার ভূমিকম্প ঝুঁকিতে বাস করা ঘনবসতির এই নগরের কোটি মানুষের ভাগ্য নিয়ে ভাবতে। অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলে মৃত্যুর সংখ্যা কত হবে তা জানা কঠিন। পাশাপাশি যারা বেঁচে থাকবে তাদের উদ্ধার করা ও বাঁচানো কঠিন হয়ে পড়বে। সরু রাস্তাঘাট, বাড়িঘর ভেঙে রাস্তায় পড়া এবং দক্ষ লোকজনের অভাব, আধুনিক যন্ত্রপাতির কমতি, সর্বোপরি সবাই যখন বিপন্ন তখন একজন আরেকজনকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হবে।
গল্পে শুনেছি এক ভাইয়ের মৃত্যুতে আরেক ভাই যখন কাঁদছে, তখন একজন এসে সান্ত্বনা দেয়, ভাই আর কেঁদো না। কেঁদে তো আর লাভ নেই। যে যাওয়ার সে তো চলেই গেছে। কান্নারত ব্যক্তি কান্না থামিয়ে বলেন, ভাইয়ের মৃত্যুর জন্য তো আর কাঁদছি না। কাঁদছি এ জন্য যে, আজরাইল ফেরেশতা তো বাড়ি চিনে গেল। সে যে আবার যে কোনো সময় বাড়িতে এসে ঢুকে যাবে। তেমনি হাইতির জন্য সমবেদনার পাশাপাশি নিজেদের জীবন নিয়ে আতঙ্ক ঠেকাতে পারছি না।
লেখক : সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.