দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসের চ্যালেঞ্জ by আহমেদ জামিল

গত ২৬ জানুয়ারি শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। এই নির্বাচনে ২২ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও, মূল নির্বাচনী লড়াই হয় ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট মাহিন্দ রাজাপাকসের সঙ্গে সাবেক সেনাপ্রধান শরত্ ফনসেকার।

দু’জনই শ্রীলঙ্কার সংখ্যাগুরু সিংহলী সম্প্রদায়ের এবং উভয়েই ভারতের মদতপুষ্ট তামিল বিচ্ছিন্নতাবাদী লিবারেশন টাইগার অব তামিল ইলম বা এলটিটিইকে পরাস্ত করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। দু’জনেই তামিল বিদ্রোহ দমনে প্রধান চরিত্র হলেও, নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণে একে অন্যের কঠোর সমালোচক হয়ে ওঠেন। মূলত সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল ফনসেকা প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণের পরই প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসের সঙ্গে তার সম্পর্ক তিক্ত হয়ে ওঠে।
যা হোক, শ্রীলঙ্কার ২৬ বছরের গৃহযুদ্ধে এলটিটিইকে চূড়ান্তভাবে পরাস্ত করার পেক্ষাপটে, ২৬ জানুয়ারির শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচনটি শুধু শ্রীলঙ্কা নয়, আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও বেশ তাত্পর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছিল।
তৃতীয় বিশ্বের আর সব দেশের মতো শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনপূর্ব নানা সহিংসতা দেখা দেয় এবং দুই প্রার্থী একে অন্যের প্রতি ব্যাপক কাদা ছোড়াছুড়ি করে চরিত্র হননের প্রয়াস চালান। প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসে তার সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল ফনসেকার বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগ আনেন। অন্যদিকে ফনসেকার সমর্থকরা রাজাপাকসের বিরুদ্ধে তিনটি অভিযোগ এনে একে নির্বাচনী প্রচারণার ইস্যু করেছিল। এগুলো হলো—দুর্নীতি, দল ও সরকারে পরিবারতন্ত্র কায়েম এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যমূল্যের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি। রাজাপাকসের বিরুদ্ধে এ ধরনের প্রচারণার পাশাপাশি বিরোধীদের রাজনীতিতে একটা মেরুকরণও লক্ষ্য করা যায়। রাজাপাকসে বিরোধী মূল ধারার দলগুলো জেনারেল ফনসেকাকে সমর্থন জানায় এবং নির্বাচনী জোট গড়ে। শুধু তাই নয়, একটা ব্যতিক্রমী দিক হলো তামিলদের সমর্থন এবার জেনারেল ফনসেকার পক্ষে গেছে।
শ্রীলঙ্কার তামিলদের প্রধান দল—তামিল ন্যাশনাল অ্যালায়েন্স বা টিএনএ সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল ফনসেকাকে সমর্থন করে বেশ চমক সৃষ্টি করে। কিছুদিন আগে এই টিএনএ তামিল অধ্যুষিত এলাকায় তামিলদের ওপর মানবাধিকার লংঘনের অভিযোগ এনেছিল প্রেসিডেন্ট রাজা পাকসের পাশাপাশি তত্কালীন সেনাপ্রধান জেনারেল শরত্ ফনসেকার বিরুদ্ধেও। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, তামিল ন্যাশনাল অ্যালায়েন্স বা টিএনএকে এলটিটিই’র রাজনৈতিক শাখা বলে মনে করা হয়। তামিলদের এই সমর্থন প্রাপ্তি সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল ফনসেকার জন্য একটা অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে দেয়। এক সময়ের বিচ্ছিন্নতাবাদী তামিলদের প্রধান ঘাঁটি জাফনায় এবারের নির্বাচনে যে ১৮ শতাংশ তামিল ভোট পড়েছে তার বড় অংশই পেয়েছেন জেনারেল ফনসেকা। বিশ্লেষকদের অভিমত হলো, তামিলরা এই ২০১০ সালে ২০০৫ সালের প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচনের সময়ের ভুলের পুনরাবৃত্তি করেনি।
২০০৫-এর নির্বাচনে এলটিটি’র ডাকে সাড়া দিয়ে শ্রীলঙ্কার তামিলরা নির্বাচন বয়কট করায় তাদের পছন্দের প্রার্থী রানিল বিক্রমাসিংগেকে মাত্র ২ শতাংশ ভোটের ব্যবধানে হারিয়ে রাজাপাকসে প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত হতে পেরেছিলেন। রাজাপাকসের মতো সাবেক সেনাপ্রধান ফনসেকা দু’জনই তামিল টাইগারদের পরাজিত করার কৃতিত্ব দাবি করা সত্ত্বেও সংখ্যালঘু তামিলদের বড় অংশের ভোট ফনসেকার পক্ষে আসায় এবং ২০০৫-এর প্রায় শূন্য শতাংশ ভোটের চেয়ে এবারের নির্বাচনে ১৮ শতাংশ তামিল ভোট প্রদানকে যথেষ্ট গুরুত্ববহ ও তাত্পর্যপূর্ণ বলে মনে করা যেতে পারে। তামিলদের অনেকেই যে এখন শ্রীলঙ্কার মূল ধারার রাজনীতিতে ফিরে আসতে চাইছে এটি তারই একটি প্রাথমিক ঈঙ্গিত হিসেবে ধরে নেয়া যেতে পারে। এর পাশাপাশি আরও একটি ঘটনা প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসের দ্বিতীয় মেয়াদে জয়ের পথে বেশ অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করেছিল।
আর সেটি হলো ক্ষমতাসীন জোটের অন্যতম শরিক দল শ্রীলঙ্কান ফ্রিডম পার্টি নেত্রী এবং সাবেক প্রেসিডেন্ট চন্দ্রিকা কুমারাতুঙ্গা বিরোধী প্রার্থী শরত্ ফনসেকাকে সমর্থন করায় রাজাপাকসে এবং তার সমর্থকরা বেশ অস্বস্তিকর অবস্থার মধ্যে পড়ে যান। অন্যদিকে তামিল বিচ্ছিন্নতাবাদী লড়াইয়ের মদতদাতা সম্প্রসারণবাদী ভারত তার ভূ-রাজনৈতিক ও সামরিক কৌশলগত স্বার্থের নিরিখে ফনসেকাকেই মিত্র বা কাছের মানুষ বলে মনে করেছে। তামিল সংগঠনগুলোর ফনসেকার অনুকূলে সমর্থন পাইয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে ভারতের নেপথ্য ভূমিকা থাকতে পারে বলে অনেকেই মনে করেন। তামিল বিচ্ছিন্নতাবাদী বিদ্রোহ দমন স্থগিত করার জন্য ভারতের চাপের কাছে নতি স্বীকার না করে প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসে নিজ সিদ্ধান্তে অটল থেকে চূড়ান্ত বিজয় হাসিল করায় তিনি ভারতের আধিপত্যবাদী শাসকদের চক্ষুশূলে পরিণত হয়েছেন। তাই ভারত রাজাপাকসে নয়, ফনসেকার বিজয় কামনা করেছে।
জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এ ধরনের নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসে দক্ষতার সঙ্গে নির্বাচনী প্রচারকার্য চালিয়েছেন। তিনি দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ও স্বজনপ্রীতি সম্পর্কে তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের যুক্তিসঙ্গত জবাব দিয়েছেন নির্বাচনী প্রচার কার্যের সময়। যা ভোটারদের বড় অংশের কাছে বিশ্বাসযোগ্যতা পেয়েছে। শ্রীলঙ্কার সংখ্যাগুরু সিংহলী ও তামিলদের মধ্যে জাতিগত বিভক্তি যে এখনও প্রবল তার প্রতিফলন লক্ষ্য করা গেছে এবারের প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচনে। তামিলদের বড় অংশ বিশেষ করে এলটিটির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা তথা তাদের রাজনৈতিক শাখা বলে বিবেচিত টিএনএ’র সমর্থন ফনসেকার পক্ষে যাওয়ায় সংখ্যাগুরু তামিলদের বৃহত্ অংশ রাজাপাকসের অনুকূলে ভোটদানে উত্সাহিত হয়। তাছাড়া জেনারেল ফনসেকা সেনাপ্রধানের ইমেজ ঝেড়ে ফেলে নিজেকে রাজনীতিবিদ হিসেবে উপস্থাপন করার কাজে বেশি সময় ব্যয় করেছেন।
বিভিন্ন স্থানে তার নির্বাচনী প্রচারণার কৌশল ভোটারদের মনে দাগ কাটতে পারেনি এবং ফুটে ওঠেনি তার জননেতার ছাপ। সাধারণ ভোটারদের বড় অংশ তার বক্তব্যকে একজন জেনারেলের হুকুম দানের মতো বলে মনে করেছে। তাছাড়া তার প্রতি ভারতের নেপথ্যে আশীর্বাদকেও শ্রীলঙ্কার শক্তিশালী দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী সুনজরে দেখেনি। তাদের বড় অংশের কোনো সমর্থনই ছিল না এই সাবেক সেনাপ্রধানের প্রতি। নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার পর তিনি কলম্বোর যে হোটেলে অবস্থান করছিলেন তাতে দলত্যাগী ৪০০ শ্রীলঙ্কান সেনা জড়ো হওয়ার সংবাদ পেয়ে শ্রীলঙ্কার সেনা ও কমান্ডোবাহিনী হোটেলটির চারপাশে অবস্থান নেয়। তখন গুজব রটে যে, সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল ফনসেকাকে শ্রীলঙ্কার সৈন্যরা গ্রেফতার করছে। এ সময় শ্রীলঙ্কার সেনাবাহিনীর মুখপাত্র ব্রিগেডিয়ার উদয়ানা নায়েকেরা স্থানীয় গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, জেনারেল ফনসেকার ওই হোটেল এবং আশপাশে চার শতাধিক দলত্যাগী সেনা জড়ো হওয়ায় গোলযোগের আশঙ্কায় সেখানে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে।
এ ঘটনার পেছনে ভারতের হাত থাকার সন্দেহ করছেন অনেকেই। আল জাজিরা ইংরেজি টিভি এ সম্পর্কে খবর পরিবেশন করতে গিয়ে জানায়, সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল ফনসেকা ভারতের প্রোটেকশনে রয়েছেন। ধারণা করা যায়, এ কারণে তিনি গ্রেফতার এড়াতে সক্ষম হয়েছেন। নির্বাচনে ভারতীয় হস্তক্ষেপ ও প্রভাব সৃষ্টির প্রয়াস প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসের দ্বিতীয় মেয়াদে জয় অনেকটা নিশ্চিত করে দিয়েছে বলে অনেক পর্যবেক্ষক মনে করেন। সর্বোপরি সংখ্যাগুরু সিংহলীরা তামিল টাইগারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয়ের মূল নায়ক হিসেবে প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসেকেই দেখে থাকে। তার দক্ষ নেতৃত্বের কারণেই তামিল টাইগারদের বিরুদ্ধে অধরা চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়। যে কারণে আত্মবিশ্বাসী হয়ে প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসে মেয়াদ পূরণের দু’ বছর আগেই নির্বাচনের ঘোষণা দিয়ে রাজনৈতিক ঝুঁকি গ্রহণ করেন। আর তাতে তিনি সফলকামও হয়েছেন। প্রতিপক্ষকে তিনি প্রায় ৪৬ লাখ ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করে দ্বিতীয় মেয়াদে ৬ বছরের জন্য প্রেসিডেন্ট পদে পুনঃনির্বাচিত হয়েছেন।
উল্লেখ্য, শ্রীলঙ্কার তালিকাভুক্ত ১ কোটি ৪০ লাখ ৮৮ হাজার ৫০০ ভোটারের মধ্যে ৭০ শতাংশ ভোটার এবারের শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচনে ভোট দিয়েছেন। প্রতিপক্ষ ফনসেকা শিবিরের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়, প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসে সরকারি গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার স্বার্থে ব্যবহার করেছেন। তবে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করতে আসা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা গুরুতর অনিয়মের কোনো অভিযোগ তোলেনি। বরং নির্বাচনের আগে যে ধরনের ব্যাপক সহিংসতা দেখা গিয়েছিল, নির্বাচনের দিন তা ছিল না বললেই চলে। এটিকে শ্রীলঙ্কার দীর্ঘদিন ধরে টিকে থাকা গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থার জন্য ইতিবাচক ঘটনা বলতে হবে। তবে ফনসেকা নির্বাচনে তার পরাজয় মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে আদালতের শরণাপন্ন হওয়ার যে ঘোষণা দিয়েছেন তা শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে কিছুটা হলেও অনিশ্চয়তার সৃষ্টি করেছে। যা হোক, অভিযোগ যতই থাকুক না কেন প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসে যে তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীর চেয়ে ভালো ভোটের ব্যবধানে জিতেছেন এটিই হলো বাস্তবতা। দ্বিতীয় মেয়াদে দায়িত্ব গ্রহণ করে প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসেকে অনেক কঠিন চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে হবে। শ্রীলঙ্কার দীর্ঘদিনের বিরাজমান সিংহলী ও তামিলদের মধ্যে জাতিগত বিভক্তি দূরীকরণের দুরূহ কাজটি তাকে সম্পন্ন করতে হবে। তামিল টাইগারদের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের পর তিনি জাতীয় ঐক্য গড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তামিলদের মূলধারার রাজনীতিতে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে তাকে আন্তরিকভাবে উদ্যোগী হতে হবে। প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন প্রদান তার অন্যতম নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল, তা বাস্তবায়নে বদ্ধপরিকর থাকতে হবে তাকে। দ্রব্যমূল্য সহনীয় পর্যায়ে আনার ব্যাপারেও তাকে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। সর্বোপরি বৈরী প্রতিবেশী ভারত রাজাপাকসের বিজয়কে তাদের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক পরাজয় হিসেবে দেখছে। শ্রীলঙ্কায় নতুন করে রাজনৈতিক অশান্তি এবং জাতিগত সংঘাত সৃষ্টিতে ভারতের ভূমিকার ব্যাপারে তাকে সতর্ক থাকতে হবে। সুতরাং এখন দেখতে হবে দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এসে প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসে এসব কঠিন চ্যালেঞ্জ কতটা দক্ষতার সঙ্গে মোকাবিলা করেন।
লেখক : কলেজ শিক্ষক ও কলাম লেখক

No comments

Powered by Blogger.