সময়ের প্রতিধ্বনি-জীবনের শেষ প্রান্তে সুরঞ্জিতের কপালে কলঙ্কের তিলক by মোস্তফা কামাল

মন্ত্রী হওয়ার বড় আকাঙ্ক্ষা ছিল সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হওয়ার পর মন্ত্রী হওয়ার জন্য তিনি বেশ চেষ্টা-তদবিরও করেছিলেন। কিন্তু শেখ হাসিনা তাঁকে মন্ত্রী না বানিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা বানিয়েছিলেন। সেই থেকে তাঁর আক্ষেপের শেষ ছিল না।


তারপর রাজনীতিতে নানা চড়াই-উৎরাইয়ের পর আবার আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হলো। কিন্তু মন্ত্রীর পদটি ভাগ্যে জুটল না সুরঞ্জিতের। সেই ক্ষোভে টানা আড়াই বছরই সরকারকে তুলোধুনো করেছেন তিনি। তাঁর মতো একজন কঠোর সমালোচককে শেখ হাসিনা মন্ত্রী করবেন- এটা ছিল সবার চিন্তার বাইরে। অথচ ২০১১ সালের ২৮ নভেম্বর প্রবীণ রাজনীতিক সুরঞ্জিতের জীবনে এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। রেলমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিলেন তিনি। কিন্তু মন্ত্রী হওয়াটাই যেন তাঁর জীবনের জন্য কাল হয়ে দাঁড়াল।
অভিযোগ আছে, রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের ব্যক্তিগত সহকারী ওমর ফারুকই নাকি রেল বিভাগ নিয়ন্ত্রণ করতেন। মাত্র পাঁচ মাসে নিয়োগবাণিজ্য করে তিনি অঢেল অর্থের মালিক হয়েছেন। ওমর ফারুকের অন্যায়-অনিয়মের ব্যাপারে মন্ত্রীর নিকটজনরাও তাঁকে একাধিকবার সতর্ক করেছিলেন। কিন্তু তিনি এপিএসের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেননি। কেন নেননি তা আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়। তবে এটা স্পষ্ট যে রেলের ঘুষের টাকা ওমর ফারুকের মাধ্যমেই লেনদেন হতো। সেই ঘুষের ৭০ লাখ টাকা নিয়ে ৯ এপ্রিল রাতে এপিএস ও রেলের কর্মকর্তা ইউসুফ আলী মৃধা নাকি মন্ত্রীর বাসায় যাচ্ছিলেন!
রেলমন্ত্রীর এপিএসের কপাল মন্দ! তাই তিনি ধরা পড়ে যান বিজিবি সদস্যদের হাতে। তাঁর অর্থ কেলেঙ্কারির ঘটনায় সারা দেশে তুমুল ঝড় শুরু হয়। সেই ঝড় একেবারে লণ্ডভণ্ড করে দেয় রেলমন্ত্রীর সুদীর্ঘ ৫৫ বছরের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার। অনেক চেষ্টা করেও তিনি নিজেকে আর বাঁচাতে পারলেন না। এক সপ্তাহ ধরে নানা নাটকীয়তার পর ১৬ এপ্রিল তিনি সব ব্যর্থতার দায় স্বীকার করে পদত্যাগ করলেন। বাঁচিয়ে দিলেন শেখ হাসিনা সরকারকে। সৈয়দ আবুল হোসেনের পর সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে নিয়ে সরকার মারাত্মক ভাবমূর্তি সংকটে পড়েছিল। তাঁর পদত্যাগের ফলে সরকার কিছুটা স্বস্তি বোধ করছে বলে মনে হয়।
একদা বাম রাজনীতিক সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত নব্বইয়ের দশকে আওয়ামী লীগে যোগ দেন। বরাবরই আমরা তাঁকে একজন সৎ মানুষ হিসেবে জানতাম। তা ছাড়া তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে কখনো কোনো অন্যায়-অনিয়মের অভিযোগ ওঠেনি। তিনি প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী-এমপি, রাজনীতিক- কাউকেই ছেড়ে কথা বলেননি। বিভিন্ন সময় তিনি সংবাদ শিরোনাম হয়েছেন। আবার সংবাদ তৈরি করে গণমাধ্যমে আলোচিত হয়েছেন। গত বছরের ২৮ নভেম্বর রেলমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি সরকারের তুখোড় সমালোচনা করেছেন। তাঁর রসাল এবং ঝাঁঝালো কথায় অনেক রাজনীতিকই কুপোকাত হয়েছেন। অন্যায়, অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে তিনি সর্বদা সোচ্চার ছিলেন। অথচ জীবনের শেষ প্রান্তে এসে তাঁর কপালেই জুটল কলঙ্কের তিলক। তাঁর কলঙ্কের বোঝা তো আর সরকার বহন করতে পারে না! তাই সরকারের নীতিনির্ধারকদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছিল, প্রধানমন্ত্রীর তুরস্ক সফর শেষে দেশে ফেরার পরই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
প্রধানমন্ত্রী দেশে ফেরেন ১৪ এপ্রিল। পরদিন ১৫ এপ্রিল সারা দিন তিনি দলের সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। দুর্নীতির বিরুদ্ধে তিনি তাঁর কঠোর মনোভাবের কথা তাঁদের জানান। রাতে রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে গণভবনে তলব করেন। প্রধানমন্ত্রী রেলমন্ত্রীকে সরাসরিই বললেন, নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করুন, নইলে পদত্যাগ করুন। ওই রাত থেকেই মন্ত্রীর পদত্যাগের গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে। তাঁর পদত্যাগের কথা উল্লেখ করে ১৬ এপ্রিল কোনো কোনো পত্রিকায় হেডলাইনও করা হয়।
পরিস্থিতি যে রূপ নিয়েছে, তাতে শিগগিরই রেলমন্ত্রী নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে পারবেন না। যদিও অর্থ কেলেঙ্কারির ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ওমর ফারুককে চাকরিচ্যুত এবং রেলের পূর্বাঞ্চলীয় জিএম ইউসুফ আলী মৃধা ও রেল নিরাপত্তা বাহিনীর কমান্ড্যান্ট এনামুল হককে সাময়িক বরখাস্ত করেছেন। তাঁরা তিনজনই স্বীকার করেছেন যে বস্তাভর্তি টাকা নিয়ে তাঁরা রেলমন্ত্রীর বাসভবনে যাচ্ছিলেন। রেলমন্ত্রীও নাকি তাঁদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। মোবাইল ফোনে বেশ কয়েকবার ফোন করে তাঁদের খোঁজখবর নিয়েছেন। এসব তথ্য পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ড্রাইভার আলী আজম মন্ত্রীর বাসার দিকে না গিয়ে কেন বিজিবির সদর দপ্তরে গাড়ি নিয়ে ঢুকে পড়লেন? তাঁকে কি কেউ পেছন দিক থেকে ধাওয়া করেছিল? নাকি বিশেষ কারো ইঙ্গিতে সেখানে গাড়িটি ঢোকানো হয়েছে? এর নেপথ্যে নিশ্চয়ই কোনো রহস্য লুকিয়ে আছে। ড্রাইভারকে জিজ্ঞাসাবাদ করলেই অনেক রহস্য উন্মোচিত হতে পারে।
অপরদিকে ১০ এপ্রিল তড়িঘড়ি করে সুরঞ্জিত সেন কেন সংবাদ সম্মেলন ডাকলেন? তিনি বললেন, 'আটক অর্থ ওমর ফারুকের ব্যক্তিগত। ব্যক্তিগত টাকা তিনি বাড়িতে রাখবেন না গাড়িতে রাখবেন, সেটা তাঁর ব্যাপার।' অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, মন্ত্রীর এই আগাম বক্তব্যই তাঁর জন্য বুমেরাং হয়েছে।
১৬ এপ্রিল সকালে রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকে যোগ দেননি। দুপুরে তিনি রেল ভবনে সংবাদ সম্মেলন ডেকে ৯ এপ্রিলের ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে পদত্যাগের ঘোষণা দেন। যদিও ওই ঘটনার সঙ্গে তাঁর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই বলে তিনি উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, 'দায়িত্বে থাকলে তদন্তকাজে ব্যাঘাত ঘটতে পারে। তাই পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছি।' সংবাদ সম্মেলনে তিনি এও বলেন, 'সব ব্যর্থতার দায় আমারই। এর দায় সরকার, আওয়ামী লীগ কিংবা প্রধানমন্ত্রী- কারো ওপরই বর্তাবে না।'
বাংলাদেশের ইতিহাসে কোনো মন্ত্রীর পদত্যাগের ঘটনা নজিরবিহীন এবং সুরঞ্জিত মন্ত্রিসভা থেকে পতদ্যাগ করে সরকারকে সহায়তাই করলেন। সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে এখন সরকারের উচিত উচ্চপর্যায়ের বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন করা। অবশ্যই ওই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত হতে হবে। সরকারের ভাবমূর্তির স্বার্থেই অত্যন্ত নিরপেক্ষতার সঙ্গে তদন্তকাজটি সমাপ্ত করতে হবে। উদ্ঘাটন করতে হবে আসল রহস্য। এত টাকা কোথা থেকে এলো, কোথায় যাচ্ছিল তা দেশবাসীকে জানাতে হবে।
দায় স্বীকারে করে কোনো মন্ত্রী, এমপি, আমলার পদত্যাগের সংস্কৃতি বাংলাদেশের ইতিহাসে ছিল না। কয়েক মাস আগেও আমরা দেখেছি, সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ করে বিশ্বব্যাংক। ব্যাংকটির কর্মকর্তারা সরকারকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানান, আবুল হোসেনকে যোগাযোগ মন্ত্রণালয় থেকে না সরালে পদ্মা সেতুতে তাঁরা ঋণ সহায়তা দেবেন না। বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখে পড়ে সরকার। বিষয়টি দেশীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে একের পর এক সংবাদ শিরোনাম হতে থাকে। বিষয়টি সুরাহার জন্য সরকার বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে অনেক দেনদরবারও করে। কিন্তু তাতে কোনো কাজ হয়নি।
বিশ্বব্যাংকের দুর্নীতির অভিযোগের পর পরই আবুল হোসেন যদি সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে সরে দাঁড়াতেন, তাহলে হয়তো পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পটি মুখ থুবড়ে পড়ত না। তিনি তো পদত্যাগ করলেনই না, উপরন্তু তিনি বললেন, তাঁর বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে তা সত্য নয় এবং বিশ্বব্যাংকই মিথ্যা অভিযোগের জন্য একসময় লজ্জিত হবে। আমরা যদি মন্ত্রীর এই বক্তব্য সত্যও ধরে নিই, তাহলেও বলব, অভিযোগ ওঠার সঙ্গে সঙ্গে তিনি পদত্যাগ করলে বিশ্বব্যাংক ঋণ সহায়তা প্রদান থেকে সরে দাঁড়াত না। সরকারকেও বিব্রত হতে হতো না।
বিশ্বব্যাংকের অব্যাহত চাপ এবং সরকারের ভাবমূর্তির কথা চিন্তা করেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আবুল হোসেনকে যোগাযোগ মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে যোগাযোগমন্ত্রীর দায়িত্ব দেন ওবায়েদুল কাদেরকে। আর যোগাযোগ মন্ত্রণালয় থেকে রেল বিভাগকে আলাদা করে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে দায়িত্ব দেন। শুরুটা বেশ ভালোই চলছিল। রেল এবং যোগাযোগ মন্ত্রণালয় কিছুটা নড়েচড়ে বসছিল। অবশ্য আবুল হোসেনকে সরানোর পরও বিশ্বব্যাংক ঋণ সহায়তা পুনর্বিবেচনা করেনি।
সৈয়দ আবুল হোসেন এখনও মন্ত্রিসভায় বহাল রয়েছেন। তিনি এখন বলছেন, তিনি নাকি ষড়যন্ত্রের শিকার। তিনি নিজেকে একজন পরিপূর্ণ সৎ মানুষ বলে দাবি করেন। একই কথা শোনা গেল সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের মুখেও। তিনিও বললেন, তিনি ষড়যন্ত্রের শিকার। এপিএসের ওই অর্থের সঙ্গে তাঁর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কোনো সম্পৃক্ততা নেই। তদন্তে যদি মন্ত্রীর সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পাওয়া না যায়, তাহলে আমরা অবশ্যই মন্ত্রীকে সাধুবাদ জানাব। একই সঙ্গে সরকারের কাছে অনুরোধ জানাব, তিনি নির্দোষ প্রমাণিত হলে তাঁকে যেন মন্ত্রিত্ব ফিরিয়ে দেওয়া হয়।
রেলমন্ত্রী যে ষড়যন্ত্রের কথা বললেন, তা তদন্তের মাধ্যমেই উদ্ঘাটিত হোক। কে বা কারা ষড়যন্ত্র করেছে, ষড়যন্ত্রকারীদের উদ্দেশ্য কী তা খুঁজে বের করতে হবে। এ ঘটনার সঙ্গে শুধু সরকারের ভাবমূর্তিই নয়, দেশের গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎও নির্ভর করছে।
সরকারের ভেতরে ও বাইরে যে ষড়যন্ত্র হচ্ছে, তা প্রধানমন্ত্রী নিজেও উপলব্ধি করতে সক্ষম। ষড়যন্ত্রকারীরা যাতে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে না পারে, সেদিকেও সতর্ক থাকতে হবে।
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
mostofakamalbd@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.