জলবায়ু পরিবর্তন তত্ত্ব সম্পর্কে নতুন তথ্য by মাহফুজ উল্লাহ

দায়টা বেশি বলে জলবায়ু পরিবর্তনের তত্ত্ব ও তথ্য সম্পর্কে উন্নত বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোর মাথাব্যথার অন্ত নেই। অন্যদিকে বাংলাদেশের মতো স্বল্পোন্নত রাষ্ট্র ও দ্বীপরাষ্ট্র যারা জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন তাদের উদ্বেগ ও উত্কণ্ঠা অস্তিত্ব রক্ষা নিয়ে।

তারা জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবেলায় অভিযোজন ও প্রশমন কর্মসূচি নিয়েই অনেক ব্যস্ত। একটা সময় ছিল যখন জলবায়ু পরিবর্তনে মানুষের ভূমিকা সম্পর্কে অনেকেই দ্বিমত প্রকাশ করতেন। সেই সঙ্গে দ্বিমত ছিল জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে কী কী প্রতিক্রিয়া হচ্ছে সে সম্পর্কেও। কিন্তু বৈজ্ঞানিক গবেষণার অগ্রগতির সঙ্গে এবং পৃথিবীব্যাপী আবহাওয়া নিয়ে মানুষের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার আলোকে এ সম্পর্কিত ধ্যান-ধারণার পরিবর্তন সূচিত হয় এবং এ ব্যাপারে যাতে পৃথিবী একটি সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে, সেজন্য অনেকদিন থেকেই চেষ্টা চলে আসছে। এ সমন্বিত প্রচেষ্টার সবচেয়ে বড় নিয়ামক হচ্ছে বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বৃদ্ধি। কেননা এই সঙ্কট গোটা পৃথিবীর এবং জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত অন্যান্য দুর্যোগ মূলত এলাকাভিত্তিক। যেমন, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়লে বাংলাদেশ ও মালদ্বীপ যে পরিমাণ ক্ষতির সম্মুখীন হবে ভারতের ক্ষেত্রে বা পৃথিবীর অনেক দেশের ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য নয়। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট প্রায় সব ক’টি সমস্যা কোনো না কোনোভাবে বাংলাদেশকে আঘাত করবে।
জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত সমস্যা বিশেষ করে এর কারণ ও প্রতিকার দেখার জন্য গঠিত হয়েছিল ‘ইন্টার গভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ’ যা ‘আইপিসিসি’ নামে পরিচিত। এছাড়াও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সমস্যাটি নিয়ে আলোচনা করার জন্য প্রায় প্রতি বছর অনুষ্ঠিত হয় আন্তর্জাতিক বৈঠক যা ‘কনফারেন্স অব দ্য পার্টিস বা কপ’ হিসেবে পরিচিত। অতীতে না হলেও অতি সম্প্রতি বাংলাদেশের মানুষ কপ সম্মেলন সম্পর্কে অনেক কিছু জেনেছেন গত বছর ডিসেম্বর মাসে রাজধানী কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত কপ-১৫ সম্মেলনের কারণে। এর মূল কারণ ছিল পৃথিবীজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ভুক্তভুগীদের সমন্বয়ে এমন একটি পরিবেশ তৈরি করা, যাতে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় পৃথিবীর রাষ্ট্রগুলো একটি যৌথ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। পৃথিবী অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করেছে, কীভাবে ধনী দেশগুলো তাদের স্বার্থ রক্ষায় একাট্টা হয়ে যায়। সেই সঙ্গে পৃথিবীর মানুষ এটাও লক্ষ্য করেছে, উন্নয়নশীল দেশের বন্ধু হিসেবে পরিচিত চীন, ভারত, ব্রাজিল ও দক্ষিণ আফ্রিকা জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় দলছুট হয়ে দূরে চলে যেতে পারে।
প্রতিষ্ঠার পর থেকে আইপিসিসি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানীদের নিয়ে একটি প্যানেল তৈরি করেছে এবং এই প্যানেলের কাজ হচ্ছে আইপিসিসির পক্ষ হয়ে রিপোর্ট তৈরি করা যা জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কে মানুষকে বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি তথ্য যোগাবে। এই প্যানেলে ক’জন বাংলাদেশীও আছেন। এতদিন মনে করা হতো আইপিসিসি খুব ভালো কাজ করছে এবং এ কারণে আইপিসিসি নোবেল পুরস্কারও পেয়েছে। আইপিসিসি’র সর্বশেষ প্রকাশিত ২০০৭ সালের রিপোর্ট সম্পর্কে এখন নতুন বিতর্ক শুরু হয়েছে এবং সমালোচকরা বলছেন, হিমবাহের বরফ গলে যাওয়া সম্পর্কে বিশেষ করে হিমালয়ের বরফ গলা সম্পর্কে আইপিসিসি রিপোর্টের তথ্য হচ্ছে নতুন বৈজ্ঞানিক জালিয়াতি।
আইপিসিসি’র চতুর্থ রিপোর্টের দশম অধ্যায়ে বলা হয়েছে পৃথিবীর অন্য যে কোনো অঞ্চলের তুলনায় হিমালয়ের বরফ অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে গলে যাচ্ছে। এর অর্থ দাঁড়াবে ভারত, চীনসহ এশিয়ার বিরাট অঞ্চলজুড়ে বন্যা এবং পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গের অবলুপ্তি। আইপিসিসি’র এই হিসাব এই অঞ্চলের মানুষকে ঘাবড়ে দেয়। গবেষকরা আরও বলছেন, আইপিসিসি’র ওই রিপোর্টে হিমালয়ের হিমবাহের পরিমাণ সম্পর্কে ভুল তথ্য দেয়া আছে। সেখানে বলা হয়েছে, ২০৩৫ সালের মধ্যে হিমবাহের পরিমাণ পাঁচ লাখ বর্গকিলোমিটার থেকে কমে এক লাখ বর্গকিলোমিটারে দাঁড়াবে। অথচ বাস্তবে হিমালয়ের হিমবাহের পরিমাণ ৩৩ হাজার বর্গকিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত। একই সঙ্গে আইপিসিসি তার অংকের হিসাবে আরও কিছু ভুল করেছে। আইপিসিসি বলছে, ১৮৪৫ থেকে ১৯৬৫ সালের মধ্যে হিমালয়ের পিন্ডারি হিমবাহের হিমবাহ দুই হাজার আটশত চল্লিশ মিটার কমে যায়। এর অর্থ হচ্ছে, প্রতি বছর ২৩.৫ মিটার হারে সংকোচন। অথচ আইপিসিসি বলছে এটা ১৩৫.২ মিটার। এই পরিপ্রেক্ষিতে পৃথিবীজুড়ে বিজ্ঞানীরা আইপিসিসি রিপোর্টের অন্যান্য ভ্রান্তি খুঁজে বের করার চেষ্টা করছেন।
ভালোভাবে অনুসন্ধান না করে আইপিসিসি কেমন করে এই ভুল করল? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আইপিসিসি’র বুদ্ধিমান লেখকরা ১৯৯৯ সালে নিউ সাইন্টিস্ট পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রবন্ধ থেকে তথ্য ধার করে এই ভ্রান্তির শিকার হয়েছেন। নিউ সাইন্টিস্টের সেই রিপোর্টে ভারতের জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের হিমবাহ বিশেষজ্ঞ সৈয়দ হাসনাইনের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, ২০৩৫ সালের মধ্যে হিমালয়ের মধ্য ও দক্ষিণ অঞ্চলের সব হিমবাহ হারিয়ে যেতে পারে। হাসনাইন যখন এই মন্তব্য করেন তখন তিনি ছিলেন হিমালয়ের হিমবাহ সম্পর্কে গঠিত আন্তর্জাতিক কমিশনের চেয়ারম্যান। তিনি অবশ্য পরবর্তী পর্যায়ে মন্তব্য করেছেন তার এই বক্তব্য ছিল অনুমাননির্ভর। কিন্তু ততদিনে সর্বনাশ যা হওয়ার তা হয়ে গেছে।
আইপিসিসি তার রিপোর্টে সূত্রের উদ্ধৃতি দিতে গিয়ে ২০০৫ সালে প্রকাশিত ‘ডব্লিউ ডব্লিউ এফ’-এর একটি রিপোর্ট উল্লেখ করেছে। আর ‘ডব্লিউ ডব্লিউ এফ’র রিপোর্টের ভিত্তি ছিল নিউ সাইন্টিস্টের উল্লিখিত রিপোর্ট। এই হিমবাহের গলনের ঝুঁকি সম্পর্কে আইপিসিসি রিপোর্টে মন্তব্য করা হয়েছে এই বিষয়টি অত্যন্ত বিপজ্জনক, যা আইপিসিসি’র ভাষা অনুযায়ী শতকরা ৯০ ভাগের বেশি।
এই প্রেক্ষাপটে পৃথিবীজুড়ে বিজ্ঞানীদের মনে যেসব প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, তা সংবাদপত্রের পাতায়ও প্রকাশিত হয়েছে। এ বছরের ২০ জানুয়ারি মার্কিন বার্তা সংস্থা ‘এপি’ গিয়র্গ কেসারের একটি মন্তব্য প্রকাশ করেছে। কেসার আইপিসিসি রিপোর্টের একজন অন্যতম প্রণেতা। বার্তা সংস্থার কাছে তিনি বলেছেন, ‘২০০৬ সালেই আমি বলেছিলাম ২০৩৫ সালের সংখ্যাটি স্পষ্টত ভুল। আইপিসিসি’র রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার আগেই আমি এ কথা বলেছিলাম এবং সব দায়িত্বশীল ব্যক্তি বিষয়টি জানেন।’ এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে, এ বিষয় সম্পর্কে লেখালেখির জন্য আইপিসিসি যাদের দায়িত্ব দিয়েছেন, সেই দ্বিতীয় ওয়ার্কিং গ্রুপকে পুনর্গঠিত করতে হবে। অপরদিকে আইপিসিসি রিপোর্টের একজন ভারতীয় প্রণেতা হিমবাহ বিশেষজ্ঞ মুরারি লাল নিউ সাইন্টিস্ট পত্রিকার সাক্ষাত্কারে বলেছেন, এ ব্যাপারে যদি কোনো ভুল হয়ে থাকে তাহলে তার দায়িত্ব ড. হাসনাইনের, আইপিসিসি’র রিপোর্ট প্রণেতাদের নয়। এরই পাল্টা জবাব হিসেবে ড. হাসনাইন নিউ সাইন্টিস্টকে বলেছেন, ‘আমার কোনো গবেষণাপত্রে ২০৩৫ সংখ্যাটি ব্যবহৃত হয়নি। আইপিসিসি’র উচিত হয়নি কোনো জনপ্রিয় ম্যাগাজিন বা পত্রিকা থেকে তথ্য সংগ্রহ করা।’
ভারত সরকার অবশ্য হিমালয়ের বরফ গলা নিয়ে খুব একটা উদ্বিগ্ন বলে মনে হয় না।
গত বছরের নভেম্বর মাসে ভারত সরকার হিমবাহ বিশেষজ্ঞ বিজয় রানা’র যে লেখা প্রকাশ করেছে তাতে বলা হয়েছে, হিমালয়ের হিমবাহ সংকুচিত হওয়ার বিষয়টি অস্বাভাবিক বা উদ্বেগজনক নয়। আইপিসিসি অবশ্য দাবি করে তারা খুব কঠোর বৈজ্ঞানিক নিয়ম-কানুন মেনেই তথ্য প্রকাশ করে। তথ্যের কেলেঙ্কারি প্রকাশিত হওয়ার পর আইপিসিসি এক বিবৃতিতে ভ্রান্তির কথা স্বীকার করলেও এ বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলেনি। কিন্তু নতুন সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছেন আইপিসিসি’র চেয়ারম্যান রাজেন্দ্র পাচুরী।
সম্প্রতি দুবাইয়ে অনুষ্ঠিত এনার্জি কনফারেন্স শেষে তিনি গার্ডিয়ান পত্রিকার সাংবাদিককে বলেছেন, ‘তারা বিজ্ঞানকে আক্রমণ করতে পারে না বলে আমাকে আক্রমণ করেছে।’ সমালোচকরা বলছেন, রাজেন্দ্র পাচুরীকে কিছুটা আত্মরক্ষামূলক অবস্থান নিতেই হবে। কেননা, তিনি অতি সম্প্রতি কার্বন নিঃসরণের বিষয় নিয়ে নতুন এক কেলেঙ্কারীতে জড়িয়ে পড়েছেন, যা তার ব্যবসায়িক স্বার্থের সঙ্গে সম্পর্কিত।

No comments

Powered by Blogger.