সাক্ষাৎকার-বাংলাদেশের পণ্যের জন্য ভারতকে নিঃশর্ত বাজার খুলে দিতে হবে by শুভেন্দু দাশগুপ্ত

সাক্ষাৎকার গ্রহণ : অজয় দাশগুপ্ত সমকাল :বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর নজর রয়েছে আপনার। এ বিষয়ে পর্যবেক্ষণ জানতে চাই। শুভেন্দু :সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রচুর পরিবর্তন লক্ষ্য করছি। কৃষিতে অভাবনীয় সাফল্য। শিল্প বাড়ছে। বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক গড়ে উঠছে। বাংলাদেশের আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক_ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া।


সার্কভুক্ত সব দেশেই এখন নির্বাচিত সরকার রয়েছে। প্রায় তিন দশক আগে এ সংস্থার যাত্রালগ্নে এমন পরিস্থিতি ছিল না। তখন কেবল ভারত ও শ্রীলংকায় নিয়মিত নির্বাচন হতো। বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে সামরিক শাসন, নেপাল ও ভুটানে রাজতন্ত্র। আমি মনে করি, সার্ক থেকে অর্থনৈতিক সুফল পেতে এ সংস্থাভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক সম্পর্কের উন্নয়ন অপরিহার্য। পরস্পরের সঙ্গে সহযোগিতার বিষয়ে সচেতনতা চাই। সীমান্ত নিয়েও ভাবতে হবে। উন্মুক্ত সীমান্ত ছাড়া সীমান্ত বাণিজ্য সফল হবে না। অর্থনীতির তত্ত্বে যা 'অবৈধ বাণিজ্য', সীমান্তের উভয় অংশের মানুষের কাছে তা পিপলস ট্রেড। মানুষ বেঁচে থাকার তাগিদে কিংবা আরেকটু ভালো থাকার জন্য এ কাজ করে।
সমকাল :অর্থনৈতিক উন্নয়নের কোন স্তরে রয়েছে বাংলাদেশ?
শুভেন্দু : এখানে শিল্প-বাণিজ্যের উদ্যোক্তাদের সরকারের ওপর নির্ভরশীলতা বেশি বলেই মনে হয়। বুর্জোয়া বিকাশের জন্য এর পরিবর্তন অপরিহার্য। পুুঁজি ও প্রযুক্তি আয়ত্তে আনার জন্য তাদের স্বাধীনভাবে উদ্যোগী হতে হবে। ভারতে আমরা এটা দেখেছি। শিল্প-কারখানার জন্য বিনিয়োগ করতে হবে এবং তা একমুখী হলে চলবে না। বাংলাদেশে তৈরি পোশাক শিল্পের প্রভূত উন্নতি ঘটেছে। লাখ লাখ নারী যুক্ত হয়েছে শিল্প শ্রমিক হিসেবে। কর্মসংস্থান এবং রফতানি আয় উভয় ক্ষেত্রেই এর অবদান অপরিসীম। কিন্তু এ শিল্পের সমস্যা হচ্ছে প্রযুক্তিগত উন্নয়নের সুযোগ সীমিত। বহির্বিশ্বের বাজারের ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল থাকাও উদ্বেগের বিষয়। এ বাজার সহজে মিলেছে এবং দ্রুত বড় হয়েছে। কিন্তু পরিস্থিতির অবনতি নানা কারণে ঘটতে পারে। বাংলাদেশের শিল্প বিকাশের জন্য প্রধান জোর দিতে হবে অভ্যন্তরীণ বাজারের প্রতি। এক্সপোর্ট লেড গ্রোথ নাকি অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণের জন্য সচেষ্ট হওয়া_ কোনটির ওপর বেশি জোর দিতে হবে, এ বিতর্কে আমি যাব না। কিন্তু বাংলাদেশকে মনে রাখতে হবে, তার আমদানি প্রচুর। তৈরি পোশাক শিল্পের জন্যও প্রধান কাঁচামালসহ প্রয়োজনীয় প্রায় সব উপকরণ আমদানি করতে হয়। অথচ তার নিজের লোকসংখ্যা ১৫-১৬ কোটি। মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত লোকের সংখ্যা অনেক। তাদের বিকাশ ঘটছে এবং এ কারণে পণ্য কেনার ক্ষমতা বাড়ছে। ধনবান শ্রেণীকে বিকাশের জন্য এ বাজারের সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হবে। তবে একটি বিষয় আমাকে কিছুটা হলেও শঙ্কিত করছে।
সমকাল : কোন বিষয়টি?
শুভেন্দু : বাংলাদেশ এখনও বিকাশের প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। উন্নত দেশের সারিতে যেতে অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। কিন্তু ইতিমধ্যেই সম্পদ ও মূলধন সীমিত কিছু লোকের হাতে পুঞ্জীভূত হওয়ার প্রবণতা স্পষ্ট। ব্যাংকিং খাত নিয়েও নীতিনির্ধারকদের ভাবতে হবে। বেসরকারি খাতের ব্যাংকই এখানে নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায়। অন্যদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যথেষ্ট স্বাধীনভাবে কাজ পরিচালনা করতে পারছে না।
সমকাল : বিষয়টি স্পষ্ট করবেন কি?
শুভেন্দু :ফিনান্সিয়াল সেক্টরকে অবশ্যই একটি নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানের হাতে তুলে দিতে হবে। সরকারের ওপর এ দায়িত্ব থাকতে পারে না। সরকার দলীয় হতে পারে কিংবা অন্তর্বর্তীকালের জন্য কোনো সরকার গঠিত হতে পারে। রাজনৈতিক দলীয় সরকারের অনেক বাধ্যবাধকতা থাকে। কিন্তু ফিনান্সিয়াল সেক্টর তাদের পছন্দমতো চালাতে গেলে সার্বিকভাবে অর্থনীতির ক্ষতি হয়। সম্প্রতি কয়েকটি নতুন ব্যাংক স্থাপনের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এর পেছনে দলীয় রাজনীতি কাজ করেছে, এমন অভিযোগ সংবাদপত্রে দেখেছি। যদি বাংলাদেশ ব্যাংক স্বাধীনভাবে কাজ পরিচালনা করতে পারত এবং অর্থনৈতিক বিবেচনা মুখ্য থাকত, তাহলে এ প্রশ্নের অবকাশ থাকত না।
সমকাল : কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসন কীভাবে নিশ্চিত হতে পারে?
শুভেন্দু : বাংলাদেশ ব্যাংককে মন্ত্রিসভার অধীনে নয়, বরং থাকতে হবে রাষ্ট্রপতির অধীনে। এর নিজস্ব গবেষণা বিভাগ থাকবে, নীতিগত বিষয় নিয়ে তারা কাজ করবে। গভর্নর চলবেন স্বাধীনভাবে, নিজের পরিচালনা পর্ষদের সঙ্গে পরামর্শের ভিত্তিতে। রাজনৈতিক দলের সরকার তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। অর্থমন্ত্রীর পরামর্শ শুনতে তিনি বাধ্য থাকবেন না, চাপ প্রদানের তো প্রশ্নই আসে না। ভারতের রিজার্ভ ব্যাংক এ ধরনের মর্যাদা ভোগ করে। বিশ্ব অর্থনীতিতে সাম্প্রতিক সংকটের ধাক্কা ভারতে কম পড়ার এটা বড় কারণ। ব্যাংকিং সেক্টরে বেসরকারি খাতের ভূমিকার পর্যালোচনাও জরুরি।
সমকাল :স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে ব্যাংকিং খাত ছিল সরকারের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে। এখন চার দশক পর বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলো নিয়ন্ত্রণ করছে আমানত ও ঋণের দুই-তৃতীয়াংশের বেশি। এ বিষয়টিকে কীভাবে দেখছেন?
শুভেন্দু :ভারতের অভিজ্ঞতা আগে বলি। ১৯৬৯ সালে ইন্দিরা গান্ধীর সরকার ব্যাংক জাতীয়করণের ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এভাবে বেসরকারি সব ব্যাংক রিজার্ভ ব্যাংকের তত্ত্বাবধানে চলে আসে। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সরকার উদারীকরণ নীতি গ্রহণ করলে বেসরকারি খাতের কয়েকটি ব্যাংক অনুমোদন পায়। একই সঙ্গে বিদেশি কয়েকটি ব্যাংকও কাজ করছে। এর ফলে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো তাদের সেবার মান বাড়ানোর বিষয়ে সচেতন থাকতে বাধ্য হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে যে সংকট সৃষ্টি হয়েছে তার মূলে রয়েছে কিছু বেসরকারি খাতের ব্যাংকের বেপরোয়া বিনিয়োগ। তাদের কাছে সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন নয়, মুনাফাই আসল। আমি মনে করি, দেশ গঠনের ভার রাষ্ট্রের হাতেই থাকা উচিত এবং এ ক্ষেত্রে তাদের গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হচ্ছে ব্যাংক। রাষ্ট্র কীভাবে গঠিত ও বিকশিত হবে, সেটা নিয়ে বেসরকারি খাতের অনেক উদ্যোক্তারই মাথাব্যথা থাকে না বা কম থাকে। তাদের কাছে মুনাফাই আসল। যেহেতু বেসরকারি খাতের ব্যাংকের হাতেই এখন অর্থের বড় উৎসের চাবিকাঠি, এ কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসন আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। অন্যথায়, এসব ব্যাংক কোথা থেকে কী করে বসবে, নীতিনির্ধারকদের অনেকেরই সেটা জানা থাকবে না। অসতর্কতা কিংবা ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে বিশেষ আনুকূল্য দেখাতে গিয়ে বিপর্যয় নেমে আসতে পারে; কিন্তু যখন তা ধরা পড়বে তখন প্রতিকারে অনেক দেরি হয়ে যাবে।
সমকাল :বাংলাদেশে ব্যাংকিং খাতের বাইরেও অনেক প্রতিষ্ঠান সঞ্চয় গ্রহণ করছে। বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?
শুভেন্দু :সঞ্চয়ের ওপর অবশ্যই রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ থাকতে হবে। বাংলাদেশে অবস্থানকালে 'ডেসটিনি' প্রসঙ্গটি সংবাদপত্রে দেখেছি। টিভি টক শোতেও এটি আলোচনার বিষয়। এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের কারণে ব্যাংকের কাজে সমস্যা হয়। তারা অধিক মুনাফার প্রতিশ্রুতি দিয়ে সাধারণ মানুষকে প্রলুব্ধ করতে পারে। এটা মনে রাখতে হবে, শিল্প-কৃষি-সেবা প্রভৃতি খাতের উন্নয়নের জন্য প্রচুর পুঁজি দরকার এবং এ ক্ষেত্রে অগ্রাধিকারের প্রশ্নও রয়েছে। সঞ্চয়ের ওপর রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব থাকলে এ কাজ সহজ হয়ে যায়।
সমকাল :ব্যাংকগুলো কীভাবে তাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করবে?
শুভেন্দু : ব্যাংকের শাখা দেশের সর্বত্র, বিশেষ করে গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে দিতে হবে। এ জন্য প্রতিটি ব্যাংক যেমন উদ্যোগ নেবে, তেমনি বাংলাদেশ ব্যাংককেও সর্বক্ষণ তৎপর থাকতে হবে। আমি একটি তথ্য জেনে অবাক হয়েছি যে, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান তিন বছর আগে দায়িত্ব গ্রহণের পর ঢাকার বাইরে অন্তত ৭৫টি স্থানে সফর করেছেন। এর অর্থ হচ্ছে প্রতি মাসে তিনি অন্তত দুু'বার বাইরে গিয়েছেন। এ তথ্য তো গিনিস বুকে স্থান পাওয়ার মতো। বরিশালের গৈলায় অবস্থানকালে জেনেছি যে, তিনি আশপাশের ১৯টি ব্যাংকের শাখা প্রধানদের নিয়ে মতবিনিময় করেছেন। কীভাবে তারা আমানত বাড়াতে পারে এবং কোন কোন খাতে বিনিয়োগের সম্ভাবনা সে বিষয়ে তাদের মতামত শুনেছেন এবং পরামর্শ দিয়েছেন। ডেসটিনির মতো প্রতিষ্ঠান মানুষের বাড়ি বাড়ি যায়। ব্যাংককেও সেটা করতে হবে। ব্যাংকগুলোর কেউ নারী উদ্যোক্তাদের জন্য প্রকল্প গ্রহণে বেশি উদ্যোগী হবে। কেউবা ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প খাতকে প্রাধান্য দেবে। কারও নজর থাকবে শস্যঋণে, কেউবা বেছে নেবে হাঁস-মুরগি ও মাছের খামার। কৃষিভিত্তিক শিল্প অনেক ব্যাংকের জন্য হয়ে উঠবে প্রধান বিনিয়োগের ক্ষেত্র। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর যেভাবে কাজ করছেন, সরকারি ও বেসরকারি সব ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তাদের একই পথে চলতে হবে।
সমকাল :ভারতে কি ডেসটিনির মতো প্রতিষ্ঠান কাজ করছে?
শুভেন্দু :হ্যাঁ। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগকারীদের জন্য তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে এসেছে। আবার পিয়ারলেসের অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং বলা যায় সফল। তারা অনেক মানুষের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করে উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ করেছে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মতো খাতও বাদ যায়নি। এভাবে অর্জিত লাভ থেকে তারা বিনিয়োগকারীদের কাছে দেওয়া প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে পারছে। 'টাকা দিয়ে টাকা বানানো'_ এ কনসেপ্ট কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
সমকাল : বিষয়টি একটু ব্যাখ্যা করুন।
শুভেন্দু : কৃষি-শিল্পে বিনিয়োগ হলে লাভ আসে ধীরে ধীরে। এর লাভের অর্থ আসল অর্থের সঙ্গে যোগ করে কারখানা সম্প্রসারণ করা হয়। অন্যদিকে, টাকা দিয়ে টাকা বানানো হলে অর্থনীতি উন্নত হয় না, চাকরির ব্যবস্থা হয় না। এভাবে সমাজে নতুন পণ্যের চাহিদা সৃষ্টি হয় না। এখানে রাষ্ট্রকে ঢুকতে হবে। মানুষের কাছে যে অর্থ আছে সেটা নিতে হবে এবং বিনিয়োগ করতে হবে। রাষ্ট্র যদি গরিবের কাছ থেকে, মধ্যবিত্তের কাছ থেকে অর্থ নিয়ে প্রকৃত বিনিয়োগ করে, তাহলে অর্থনীতি তার সুফল পাবে। ব্যাংকগুলো নিজেদের মধ্যে বসবে। অর্থনীতির খাত ও অঞ্চল ভাগ করে নেবে। চিটিং ফান্ডওয়ালারা যে অর্থ সংগ্রহ করে, সেটা ব্যাংকে নিয়ে আসতে হবে। মানুষ যদি একবার বুঝতে পারে যে রাষ্ট্রের হাতে বা ব্যাংকের হাতে তুলে দিলে স্বল্পমেয়াদি লাভ মেলে, আবার দীর্ঘমেয়াদে লাভ আরও বেশি তাহলে তারা দ্বিধা করবে না।
সমকাল : ব্যাংকের সঙ্গে লেনদের মানেই তো সিকিউরিটির প্রশ্ন, অনেক দলিল-দস্তাবেজ...।
শুভেন্দু :ব্যাংককে অবশ্যই মহাজনি ধারণার বাইরে চলে আসতে হবে। সিকিউরিটি যতটা সম্ভব কমিয়ে রাখার চেষ্টা করতে হবে। মানুষকে সঞ্চয়মুখী করার জন্য অনেক ধরনের স্কিম চালু করতে হবে।
সমকাল : বাংলাদেশের কৃষি এগিয়ে চলেছে...।
শুভেন্দু :১৫-১৬ কোটি লোকের একটি দেশে চাল আমদানি করতে হয় না, এটা বড় অগ্রগতি। এর পেছনে সরকারের অবদান আছে। চাষিদের অবদান আছে। তবে মনে রাখা দরকার, চাষিরা সরল প্রকৃতির হয়। তাদের ঠকানো সহজ। সার, বীজ, কীটনাশক ইত্যাদি আগাম জোগানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাদের ঠকানোর প্রবণতা বাড়তে পারে বলে আমার আশঙ্কা। কন্ট্যাক্ট ফার্মিং বিপজ্জনক হতে পারে। কোনো কোম্পানি হয়তো অনেক কৃষককে ভুট্টা চাষের জন্য চুক্তিবদ্ধ করল। কিংবা কেউ টমেটো বা অন্য ফসল চাষের প্রস্তাব করল। এ জন্য উপকরণ ও অর্থ জোগান দেওয়া হলো। ভুট্টা থেকে কোম্পানি কয়েক ধরনের পণ্য উৎপাদন করবে দেশের এবং বিদেশের চাহিদা পূরণের জন্য। নিশ্চিত বাজারের আকর্ষণে চাষিরা এদিকে যেতে পারে। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজার যদি পড়ে যায়? কোনো কারণে ওয়ালমার্টের মতো প্রতিষ্ঠান ভুট্টার বদলে চাল বা গমের দিকে ঝুঁকে পড়ে? রফতানি বাজারে ধস নামার কারণে যদি দেশের এজেন্ট কোম্পানি কৃষকদের ফসলের কম দাম দিতে চায়? কৃষকদের এ ধরনের জিম্মি হতে দেওয়া যায় না। আরও একটি বিষয়। আমরা খাদ্য নিরাপত্তার কথা বলি। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে দরকার খাদ্য সার্বভৌমত্ব। দেশের খাদ্য দেশে হতে হবে। ভুট্টার ফলন বাড়িয়ে তা রফতানি করে প্রয়োজনে চাল আমদানি, এ নীতি সঠিক হবে না। আবার দেশের মধ্যেও বিভিন্ন অঞ্চলকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে তোলার কথা ভাবতে হবে।
সমকাল : কৃষি থেকে ফের আসি বাংলাদেশের শিল্পের প্রসঙ্গে। আপনার নিজেরও এ বিষয়ে আগ্রহ রয়েছে।
শুভেন্দু :বাংলাদেশের উদ্যোক্তাদের অভ্যন্তরীণ বাজারের প্রতি আরও বেশি মনোযোগী হওয়ার সুযোগ রয়েছে। তৈরি পোশাক থেকে ভালো লাভ আসছে। কর্মসংস্থানের সুযোগ প্রচুর। কিন্তু অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য কেবল বিশ্ববাজারের ওপর নির্ভরতা বিপজ্জনক। এ বাজারে ওঠানামা রয়েছে। চাহিদা কমে গেলে হঠাৎ করেই বিপদ নেমে আসতে পারে। শেয়ারবাজারে বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট হলে কী লাভ? তারা আজ কিনে কাল শেয়ার বিক্রয় করে লাভ নিয়ে চলে যাবে। আর ধরা খাবে, যারা চড়া বাজার দেখে সর্বস্ব বিনিয়োগ করেছিল।
সমকাল : বাংলাদেশ-ভারত বাণিজ্য সম্পর্ক নিয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ জানতে চাই।
শুভেন্দু : প্রথম এবং শেষ কথা হচ্ছে ভারতকে তার বাজার বাংলাদেশের জন্য শর্তহীনভাবে খুলে দিতে হবে। এ জন্য রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত চাই। ভারতের অর্থনীতি এখন যথেষ্ট সবল এবং সে তুলনায় বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে। তাই বাংলাদেশ তার পণ্যে ভারতীয় বাজার ছয়লাব করে সে দেশের অর্থনীতিতে ধস নামাবে, এমন সম্ভাবনা নেই। দ্বিতীয়ত, উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলো যেন বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে স্বাধীনভাবে তাদের অর্থনীতি গড়ে তুলতে পারে। এখানে ভূগোল গুরুত্বপূর্ণ। দিলি্ল-ঢাকার ওপর সবকিছু নির্ভর করে থাকলে চলবে না। আলোচনা ও সিদ্ধান্ত হতে হবে ঢাকা-গৌহাটি, ঢাকা-আগরতলার মধ্যে। ভারতের পশ্চিম ও দক্ষিণাঞ্চলের রাজ্যগুলোতে থেকে উত্তর-পূর্বাঞ্চলে পণ্য পাঠাতে যে বিপুল ব্যয়, সেটা অবশ্যই বিবেচনায় রাখা চাই। এ কারণে আমি বলব, ট্রানজিট সূত্রে দূরের রাজ্য থেকে পণ্য আনা-নেওয়া বড় কথা নয়, বরং উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলো যেন বেশি বেশি করে বাংলাদেশি পণ্য পায় সেটা নিশ্চিত করতে হবে। এর ফলে আসাম-ত্রিপুরা-মণিপুর-মেঘালয়বাসী অনেক কম দামে পণ্য পাবে, আর দ্রুত এগিয়ে যাবে বাংলাদেশের অর্থনীতি। বড় দেশের ছাড় দেওয়ার ক্ষমতা বেশি এবং এ পথে চললে রাজনৈতিক ও মনস্তাত্তি্বক লাভেরও অঢেল সম্ভাবনা। সীমান্তে অবাধ বাণিজ্য চললে বিজিবি ও বিএসএফ মোতায়েনের জন্য বিপুল ব্যয়ের বোঝাও কমে আসবে।
সমকাল : আপনাকে ধন্যবাদ
শুভেন্দু : সমকাল পাঠকদের শুভেচ্ছা।

No comments

Powered by Blogger.