বৃক্ষরোপণের নামেও অর্থ সংগ্রহ করছে ডেসটিনি by ফখরুল ইসলাম

সরকারের অনুমোদন না নিয়েই খাস ও ইজারা দেওয়া জমিতে গাছ লাগিয়েছে ডেসটিনি ২০০০ লিমিটেড। আর এই গাছে বিনিয়োগ করতে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করছে তারা। কথিত মাল্টিলেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) পদ্ধতির আওতায় তারা এভাবেই জনগণের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করছে।


‘ডেসটিনি ট্রি প্ল্যান্টেশন লিমিটেড’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন নিয়ে তারা এ কাজ করছে। প্রতিষ্ঠানটি ইসলামি শরিয়াহ মোতাবেক পরিচালিত বলেও দাবি করা হচ্ছে। বিভিন্ন প্যাকেজের আওতায় ডেসটিনিতে বিনিয়োগ করলে নির্দিষ্ট মেয়াদান্তে বিপুল অঙ্কের মুনাফা পাওয়া যাবে বলে সাধারণ মানুষকে বলছে তারা। অথচ গাছ লাগানোর কোনো বৈধতা তাদের নেই।
কয়েক বছর ধরে মানুষের কাছ থেকে এই পদ্ধতিতে বিপুল অঙ্কের অর্থ সংগ্রহের পর বনায়নের অনুমতি চেয়েছে ২০১১ সালে এসে। অনুমতি না দেওয়া হলেও তারা কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। যৌথ মূলধনি কোম্পানি ও ফার্মসমূহের নিবন্ধকের কার্যালয় (রেজসকো) থেকে শুধু কোম্পানি গঠনের নিবন্ধন নেওয়া হয়েছে।
অনুমোদনের আবেদন নাকচ: ২০১১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি ও ১৩ মার্চ তৎকালীন বাণিজ্যমন্ত্রী ফারুক খানের কাছে দুটি আলাদা আবেদন করেন ডেসটিনি ট্রি প্ল্যান্টেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) রফিকুল আমীন। এতে ‘সবুজ বাংলা’ গড়া এবং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষাকল্পে দেশব্যাপী বনায়নের সুযোগ ও সহযোগিতা চাওয়া হয়।
সরকারের অব্যবহূত খাসজমিতে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারির (পিপিপি) ভিত্তিতে এবং ব্যক্তিমালিকানা জমিতে অংশীদারির ভিত্তিতে বনায়ন প্রকল্পে বিরল ও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার কথাও এতে উল্লেখ করা হয়। এতে আরও বলা হয়, ‘২০১২ সালের মধ্যে আমরা দেশব্যাপী ছয় কোটি চারা রোপণ করতে চাই। বিগত কয়েক বছরে দেশের কয়েকটি অঞ্চলে পরীক্ষামূলকভাবে বাণিজ্যিক বনায়ন কার্যক্রম সম্পাদন করেছি এবং ব্যাপক সাড়া পেয়েছি। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে আপনার সহযোগিতা কাম্য।’
তবে আইনকানুন যাচাই করে একই বছরের ২৫ মে এ বিষয়ে অনুমতি দেওয়া যাবে না বলে জানিয়ে দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। তার আগে রেজসকো নিবন্ধক আহমেদুর রহিমের কাছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় জানতে চায়, বৃক্ষরোপণ বাবদ ডেসটিনি কর্তৃপক্ষ কোনো অর্থ আদায়ের এখতিয়ার রাখে কি না। আহমেদুর রহিম বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে জানিয়ে দেন, ডেসটিনি কর্তৃপক্ষ তা পারে না। কারণ হিসেবে বলা হয়, ‘বৃক্ষরোপণ বাবদ অর্থ আদায়-সংক্রান্ত কোনো উদ্দেশ্য ডেসটিনির সংঘস্মারকে নেই।’
গাছ রোপণের দুই প্যাকেজ: দুটি প্যাকেজের মাধ্যমে ডেসটিনি অর্থ সংগ্রহ করে। একটি প্যাকেজ হলো ১২ বছর মেয়াদি সুপার সিলভার প্যাকেজ। এতে ১০ হাজার টাকা বিনিয়োগ করতে হয়। বিনিময়ে ৩০টি এক বছর মেয়াদি গাছ দেওয়ার কথা বলা হয়। এটি শুধু নতুন পরিবেশক হওয়ার ক্ষেত্রে। মেয়াদান্তে পাওয়া যাবে ৫০ হাজার টাকা মুনাফাসহ ৬০ হাজার টাকা।
আরেকটি প্যাকেজের নাম পাওলোনিয়া রুট প্যাকেজ। এটিই ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে মূলত দেশব্যাপী। সাত হাজার ৫০০ টাকার বিনিময়ে আট বছর মেয়াদি এই প্যাকেজের আওতায় রয়েছে ১৫টি গাছের চারা। প্রতিটি গাছ ছয় থেকে আট বছর পর বিক্রির উপযোগী হবে বলে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। বলা হচ্ছে, এই পাওলোনিয়া প্যাকেজ থেকে সীমাহীন, অর্থাৎ মেয়াদান্তে, নগদ, স্থায়ী এবং স্বত্ব আয়ের সুযোগ রয়েছে। একেকটি গাছের দাম ১০ হাজার টাকা ধরে মেয়াদান্তে মোট বিক্রিমূল্যের ৮০ শতাংশ টাকা দেওয়ার কথা প্রশিক্ষণকেন্দ্রগুলোতে বলা হচ্ছে।
মেয়াদান্তে আয়: সূত্র জানায়, ডেসটিনি এভাবে বিপুল পরিমাণ আয়ের কথা বলছে। যেমন, একটি প্যাকেজে ১৫টি গাছে সাত হাজার ৫০০ টাকা বিনিয়োগে এক লাখ ৫০ হাজার টাকা বিক্রিমূল্য এবং মেয়াদান্তে আয় দাঁড়াবে এক লাখ ২০ হাজার টাকা। তিনটি প্যাকেজে ৪৫টি গাছে তিন লাখ ৬০ হাজার টাকা, সাতটি প্যাকেজে ১০৫টি গাছে ৫২ হাজার ৫০০ টাকা বিনিয়োগে আট লাখ ৪০ হাজার টাকা, ১৫টি প্যাকেজে ২২৫ গাছে এক লাখ ১২ হাজার ৫০০ টাকা বিনিয়োগে ১৮ লাখ টাকা, ৬৭টি প্যাকেজে ১০০৫ গাছে পাঁচ লাখ দুই হাজার ৫০০ টাকা বিনিয়োগে ৮০ লাখ ৮৪ হাজার টাকা, ১৩৫টি প্যাকেজে ২০২৫ গাছে ১০ লাখ ১২ হাজার ৫০০ টাকা বিনিয়োগ করলে এক কোটি ৬২ লাখ টাকা এবং সর্বশেষ এক হাজার ৬৮০টি প্যাকেজে ২৫ হাজার ২০০টি গাছে এক কোটি ২৬ লাখ টাকা বিনিয়োগ করলে আয় হবে ২০ কোটি ১৬ লাখ টাকা।
মেয়াদান্তে আয়ের পাশাপাশি এক হাজার ৬৮০টি প্যাকেজে নগদ আয় ৫৫ লাখ ৯৩ লাখ ৪০০ টাকা, স্থায়ী আয় ৭৫ কোটি ৬০ লাখ টাকা এবং প্রতি মাসে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা স্বত্ব আয় (রয়্যালটি) করা সম্ভব বলেও ডেসটিনি হিসাব দিচ্ছে।
এদিকে চলতি বছর থেকেই একটি প্যাকেজের আওতায় মুনাফা বিতরণ করা হবে বলে ডেসটিনি কর্তৃপক্ষ বলছে। কাকরাইল ও পল্টনের কয়েকটি কেন্দ্রে প্রশিক্ষণে অংশ নিয়ে দেখা গেছে, ডেসটিনি বর্তমানে ট্রি প্ল্যান্টেশনের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহে জোর দিচ্ছে। নতুনদের উৎসাহিত করা হচ্ছে ডেসটিনি ২০০০-এর প্রশিক্ষক ও ডেসটিনি মাল্টি পারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেডের উদ্যোক্তা পর্ষদের সদস্য আজাদ রহমানের লেখা বই কেনার জন্য।
ডেসটিনি ট্রি প্ল্যান্টেশনের মাধ্যমে জনগণের কাছ থেকে কত টাকা উত্তোলন করা হয়েছে, তা জানাতে রাজি হয়নি ডেসটিনি কর্তৃপক্ষ। জানা গেছে, ছাত্র, যুবক, গৃহিণী ও বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা ছোট ছোট প্যাকেজে বিনিয়োগ করলেও সরকারি অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও কলেজশিক্ষকদের মধ্যে বড় বিনিয়োগকারীর সংখ্যাই বেশি। তাঁদের বিনিয়োগের পরিমাণ এক থেকে দুই লাখ টাকা।
জমি নিজেদের নয়: ডেসটিনি কর্তৃপক্ষ বান্দরবান, ফটিকছড়ি, চট্টগ্রাম, পঞ্চগড়, কুয়াকাটাসহ সারা দেশে ৩০টি প্রকল্পের মাধ্যমে সাত কোটি বৃক্ষ রোপণ করবে বলে মানুষকে বলছে। এ জন্য দরকার ৭০ হাজার একর জমি। কিন্তু পাহাড়ি এলাকায় এ ধরনের জমি কেনার সুযোগ নেই। অন্যের কাছ থেকে ভাড়া করে বনায়ন করলেও বিক্রির ক্ষেত্রে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের অনুমতি লাগে। সেই অনুমতিও তাদের দেওয়া হয়নি।
তবে ডেসটিনির এমডি রফিকুল আমীন প্রথম আলোকে বলেন, সরকারের কাছ থেকে ইজারা নিয়ে যারা বনায়ন করছে, তাদের সঙ্গে চুক্তি করেছে ডেসটিনি। উদাহরণ হিসেবে তিনি চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে রমজান আলী এস্টেটের ছয়টি বাগানের কথা বলেন।
সূত্র জানায়, পাঁচ বছর ধরে কাজ করার পর রেজসকো থেকে ডেসটিনি ট্রি প্ল্যান্টেশনের নিবন্ধন নেওয়া হয়েছে ২০১১ সালের জানুয়ারিতে। অথচ রেজসকোতে জমা দেওয়া প্রকল্পের পরিচিতি অংশে বলা হয়েছে, ২০০২ সাল থেকেই তারা বৃক্ষ রোপণ করছে এবং এ পর্যন্ত আড়াই কোটি চারা রোপণ করেছে।
এদিকে গত শুক্রবার ডেসটিনির মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান বৈশাখী টেলিভিশনের কার্যালয়ে ডেসটিনি ট্রি প্ল্যান্টেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রফিকুল আমীন প্রথম আলোকে বলেন, গাছ লাগানো শুরু হয়েছে ২০০৬ সাল থেকে এবং মানুষের কাছে এ পর্যন্ত বিক্রি করা হয়েছে দেড় কোটি গাছ।
মানুষের কাছ থেকে টাকাপয়সা তুলে নিয়ে সরকারের বনায়নের কাছে অনুমতি চাইলেন, সরকার আবার তা দিলও না, তার পরও বলছেন ডেসটিনি আইনকানুন মেনেই ব্যবসা করছে—এমন প্রশ্নের জবাবে রফিকুল আমীন বলেন, বনায়নে এখন আর কোনো মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নেওয়ার দরকারই নেই। ব্যক্তি পর্যায়ে চুক্তির মাধ্যমে তা করা হবে।

No comments

Powered by Blogger.