পাহাড়ের নিচে আতঙ্কিত জীবন-নিরুপায় মানুষের পাশে দাঁড়ান

নিরুপায় মানুষ বাছাই করার সুযোগ থাকে না। আর তাই মৃত্যু হতে পারে জেনেও স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বহু মানুষকে ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে বসবাস করতে হয়, এই মুহূর্তে যেমনটা করতে হচ্ছে চট্টগ্রামের অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়গুলোর পাদদেশে। এমন বহু পরিবার সেখানে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে, যারা জানে যেকোনো সময় পাহাড়ধসে তাদের মৃত্যু হতে পারে।


অনেক দিন ধরে এ পরিস্থিতি বিরাজ করছে একরকম প্রতিকারহীনভাবেই। প্রায় প্রতিবছরই সেখানে পাহাড়ধসে অকালে বহু জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটছে। কিন্তু যে রাষ্ট্রে মানুষের মৌলিক অধিকারগুলোর নিশ্চয়তা দেওয়ার কথা, সে দেশে এখন পর্যন্ত তাদের রক্ষায় কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হয়নি। বরং রাষ্ট্রীয় উদাসীনতার সুযোগ নিয়ে কিছু স্বার্থান্বেষী মানুষ পাহাড় এবং এর গাছ কেটে সেগুলো আরো বিপজ্জনক করে তুলছে। গতকাল সোমবার একটি সহযোগী দৈনিকে প্রকাশিত সংবাদ ও আলোকচিত্রে তারই বিশদ বর্ণনা পাওয়া যায়।
২০০৭ সালে চট্টগ্রামে একটি পাহাড়ধসের ঘটনায় ১২৬ জনের মৃত্যু ঘটে। ২০০৮ সালেও চট্টগ্রামে পাহাড়ধসের ঘটনায় মারা যায় ১১ জন। এ ছাড়া ছোটখাটো পাহাড়ধসের অনেক ঘটনা প্রতিবছরই ঘটছে। গত বছরও কঙ্বাজারের টেকনাফ ও উখিয়ায় পাহাড়ধসে ৪৮ জনের মৃত্যু হয়েছিল। ২০০৭ সালের পাহাড়ধসের পর বিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একাধিক কমিটি গঠন করা হয়। তারা ওই পাহাড়ধসকে মানবসৃষ্ট দুর্যোগ হিসেবেই উল্লেখ করে। দেশে পাহাড় কাটা কাগজে-কলমে নিষিদ্ধ হলেও তা কখনো বন্ধ থাকেনি। পাহাড় কেটে সমান করে তাতে স্থাপনা তৈরি করা হয়েছে। ইট তৈরির জন্য পাহাড় কেটে মাটি নেওয়া হচ্ছে। গাছপালা কেটে পাহাড়কে ন্যাড়া করে দেওয়া হয়েছে। ফলে একনাগাড়ে দু-তিন দিন বৃষ্টি হলেই পাহাড়ের ওপরের মাটির স্তর আলগা হয়ে ধসে পড়ে নিচে থাকা ঘরবাড়ির ওপর, মারা যায় অসংখ্য নিরীহ ও নিরপরাধ মানুষ। বিপর্যয় রোধে দুটি বিশেষজ্ঞ কমিটি মোট ৫০ দফা সুপারিশ করেছিল। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, সেসবের বাস্তবায়ন নেই বললেই চলে। পাহাড়ের ১০ কিলোমিটারের মধ্যে ইটখোলা না রাখার সুপারিশ করা হলেও বাস্তবে দেখা যায়, পাহাড়ের গা ঘেঁষেই রয়েছে খোলা। চট্টগ্রামে ভূতাত্তি্বক জরিপের মাধ্যমে পাহাড় ব্যবস্থাপনার একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা তৈরির সুপারিশ করা হলেও সে নীতিমালা এখনো তৈরি হয়নি। বরং পরবর্তী সময়ে পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে 'অনিবার্য প্রয়োজনে' পাহাড় কাটাকে বৈধতা দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। কার স্বার্থে কিংবা কত মানুষের জীবনের বিনিময়ে সেই 'অনিবার্য প্রয়োজন' নির্ধারিত হবে, তা কিন্তু প্রজ্ঞাপন থেকে জানা যায়নি। ফলে আবারও ক্ষমতাবানদের স্বার্থে কিংবা সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তরের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের পকেট ভারী করার বিনিময়ে সেই 'অনিবার্য প্রয়োজন' নির্ধারিত হচ্ছে।
সারা পৃথিবীতেই জনবহুল স্থানে বা নগরের মধ্যে থাকা পাহাড় ব্যবস্থাপনায় সুনির্দিষ্ট নীতিমালা মেনে চলা হয়। প্রতিনিয়ত এত প্রাণহানির পরও আমরা কোনো নিয়মনীতি অনুসরণের তোয়াক্কা করছি না। দিনে-দুপুরে পাহাড় কাটার মাধ্যমে আইন লঙ্ঘন করলেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো তাদের টিকিটিও স্পর্শ করতে পারে না। এ রকম আত্মঘাতী অবস্থা চলতে পারে না, চলা উচিত নয়। সরকার যদি জনগণের স্বার্থরক্ষায় ওয়াদাবদ্ধ হয়ে থাকে, তাহলে বিষয়গুলো তাকে দেখতেই হবে। তা না হলে আসন্ন বর্ষায় হয়তো আমরা আরো বড় কোনো বিপর্যয়ের খবর পাব, আরো বেশি মানুষের মৃত্যুতে আমরা শোকাহত হব; এবং এ ধারা চলতেই থাকবে।

No comments

Powered by Blogger.