মিডিয়া ভাবনা-পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্বাচন ও নির্দল ছাত্রছাত্রীরা by মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে দুটি ভালো খবর সম্প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। ১. আদালত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে অবিলম্বে ‘ডাকসু’ নির্বাচনের জন্য ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়েছেন। ২. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনৈতিক দলনিরপেক্ষ একটি ছাত্রগোষ্ঠী সংঘবদ্ধ হয়েছে ও তারা ডাকসু নির্বাচনের দাবিতে নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।
প্রথম খবরটি অবশ্য পুরোপুরি ভালো খবর নয়। তবে অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এখন আমাদের কাছে আদালতের নির্দেশকেও ভালো খবর মনে হচ্ছে। নইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে আদালতের নির্দেশ দিতে হবে কেন? একটি গণতান্ত্রিক দেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তথা অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাদের কর্তব্য ও ছাত্রদের গণতান্ত্রিক অধিকার হিসেবেই প্রতিবছর ছাত্র সংসদ নির্বাচন আয়োজন করার কথা। কিন্তু নব্বইয়ের পরবর্তীকালে ঢাকাসহ অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন সুবিধাবাদী ও ভীরু নেতৃত্ব বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থান পেয়েছিল, যারা ছাত্র সংসদ নির্বাচন করার সাহস করেনি।
আমরা সবাই কথায় কথায় দাবি করি, নব্বইয়ের পরই বাংলাদেশে প্রকৃত গণতন্ত্রের অভিযাত্রা শুরু হয়েছে। এই দাবি অন্যায় দাবি নয়। কিন্তু নব্বইয়ের পরে দেশের সর্বস্তরে প্রত্যক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্বাচন হতে পারেনি। এ ব্যাপারে শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিদের এককভাবে দায়ী করা যায় না। নব্বই পরবর্তী সব সরকারপ্রধান ও শিক্ষামন্ত্রীরা এ জন্য দায়ী। ১৯৯১ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত যেসব ছাত্রছাত্রী দেশের সব কটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে ডিগ্রি নিয়ে বেরিয়েছেন, তাঁরা যে উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করতে পারেননি, তাঁরা যে নির্বাচিত ছাত্র সংসদের নেতৃত্বে কখনো কো-কারিকুলাম কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে পারেননি তার জবাব কে দেবে? এ জন্য কাকে এখন শাস্তি দেওয়া উচিত?
আরও বিস্ময়ের ব্যাপার, গত ২০ বছরে দেশে বহু রকম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, নির্বাচন নিয়ে নানা আলোচনা ও বিতর্ক হয়েছে, কিন্তু কখনো কোনো রাজনৈতিক দল, পেশাজীবী সংগঠন, নাগরিক সমাজের ফোরাম, মিডিয়া—কেউই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্বাচনের ব্যাপারে সোচ্চার দাবি তোলেনি। দু-একবার কথাটা বলেছে হয়তো, কিন্তু সোচ্চার ও অব্যাহতভাবে এই দাবি নিয়ে দেশে কোনো আলোচনা ও বিতর্কের জন্ম হয়নি। সংবাদপত্র দু-একটি প্রতিবেদন ও সম্পাদকীয় প্রকাশ করে তাদের দায়িত্ব শেষ করেছে।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি শুধু ঢাকা সিটি করপোরেশনের একটা তুলনা দেওয়া চলে। কীভাবে যেন গণতান্ত্রিক সরকার বছরের পর বছর ডিসিসিতে নির্বাচন না দিয়ে পার পেয়ে গেছে। এ জন্য কাউকে কোথাও জবাব দিতে হয় না। এমনকি এ জন্য নির্বাচিত সরকারপ্রধানের খুব বেশি সমালোচনাও হতে দেখা যায় না। সবার ভাবখানা এমন, ‘নির্বাচন দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না, প্রধানমন্ত্রী কী করবেন?’ যথাসময়ে নির্বাচন না দেওয়াটা যে একটা বড় দায়িত্বহীনতার পরিচয়, তা কেউ চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে না।
যাই হোক, এবার আদালত যখন এ ব্যাপারে তৎপর হয়েছেন তখন আশা করা যায়, ঢাকাসহ অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতি বছর (এমনকি তা দ্বিবার্ষিকও হতে পারে) ছাত্র সংসদ নির্বাচন হবে।
আমাদের দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্বাচনই একমাত্র সমস্যা নয়। তবে নিঃসন্দেহে এটা একটা বড় ইস্যু। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি (এ মুহূর্তে জাহাঙ্গীরনগরে এক দল শিক্ষক ভিসির বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে।), শিক্ষক নিয়োগ ও পদোন্নতিতে রাজনৈতিক বিবেচনা, আবাসিক হলে শিক্ষকদের বদলে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র নেতাদের কর্তৃত্ব, ক্ষমতাসীন ছাত্র নেতাদের টেন্ডার বাণিজ্য, বিভিন্ন বিভাগে (সব ক্ষেত্রে নয়) শিক্ষার পরিবেশ বিনষ্টসহ বহুবিধ সমস্যায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আক্রান্ত। সব বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্যা এক রকম নয়। কমবেশি রয়েছে। তবে দলীয় বিবেচনায় শিক্ষক নিয়োগ এখন প্রায় ক্যানসারের মতো সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় আক্রান্ত। তবে বলাবাহুল্য, তা একশো ভাগ ক্ষেত্রে নয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমাজে একটা কথা প্রচলিত রয়েছে: ‘এখন শিক্ষক নিয়োগ হয় না, ভোটার নিয়োগ হয়।’ কারণ, বিভিন্ন কমিটিতে ও পদে শিক্ষকদের প্রায়শ ভোট দিতে হয়। কিন্তু প্রতিবছর এত ‘ভোটার’ (পড়ুন শিক্ষক) নিয়োগ দিলেও বর্তমানে একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েও নির্বাচনের মাধ্যমে ভাইস চ্যান্সেলর নিয়োগ হয়নি। এ ব্যাপারে অনির্বাচিত ভিসিদের কোনো অপরাধবোধ আছে বলেও মনে হয় না। সরকারও এ ব্যাপারে নির্বিকার। যেন এমনই তো হওয়ার কথা!!
সরকারের আচরণ দেখে মনে হয় দেশের সর্বত্র নির্ধারিত সময়ে নির্বাচন হওয়াটা গণতান্ত্রিক সরকারের দায়িত্ব, শুধু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া। হাইকোর্টের নির্দেশনার সূত্রে সম্প্রতি বিবিসি বাংলার এক অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনির্বাচিত ও রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগপ্রাপ্ত উপাচার্য অধ্যাপক আরেফিন সিদ্দিক বলেছেন, ‘ডাকসু নির্বাচন দিলে বিশ্ববিদ্যালয়ে গোলযোগ দেখা দিতে পারে। এর ফলে একাডেমিক সেশন ব্যাহত হতে পারে। তিনি মনে করেন, ছাত্রদের একাডেমিক সেশন নির্বিঘ্ন রাখা তাঁর প্রধান বিবেচনা।’ (হুবহু উদ্ধৃতি নয়, স্মৃতি থেকে উদ্ধৃত)।
প্রফেসর আরেফিনের এই বক্তব্য আপাত দৃষ্টিতে যথেষ্ট যুক্তিসংগত মনে হতে পারে। কিন্তু এই যুক্তির পেছনে নানা যুক্তি দেওয়া যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্বাচন হলেই একাডেমিক পরিবেশ বিনষ্ট হবে কেন? এটা নির্ভর করে নির্বাচন ব্যবস্থাপনা, নির্বাচন পরিচালনায় নিরপেক্ষতার নিশ্চয়তা ও ছাত্র নেতাদের সঙ্গে সমঝোতার ওপর। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিনষ্ট হওয়ার আশঙ্কা দেশের যেকোনো নির্বাচনের জন্যই প্রযোজ্য। এই অজুহাতে ৯১ থেকে এ পর্যন্ত দেশে কোনো নির্বাচনই বন্ধ রাখা হয়নি। ডিসিসির নির্বাচন বিলম্বিত হয়েছে শুধু ক্ষমতাসীন দলের কৌশলের কারণে। অন্য কোনো কারণে নয়। কাজেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির এই বক্তব্য একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়। তিনি নিজে অনির্বাচিত বলে নির্বাচন সম্পর্কে আগ্রহী নন। এবার আশা করি, আদালতের নির্দেশে তিনি ডাকসু নির্বাচন দিতে বাধ্য হবেন। তবে সেটা তাঁর জন্য সম্মানজনক হলো না।
যে আরেকটি সুখবর সম্প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে তা হলো, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একদল নিরপেক্ষ ছাত্র সংগঠিত হচ্ছে (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী অধিকার মঞ্চ)। এ ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য আমাদের হাতে নেই। এটুকু তথ্যই যথেষ্ট ইতিবাচক। এখানে ‘নিরপেক্ষ’ বলতে বলা হচ্ছে, তারা দেশের কোনো রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তি করে না। এই তথ্যটি বর্তমান ছাত্ররাজনীতির প্রেক্ষাপটে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রধান রাজনৈতিক দলের লেজুড় ছাত্র সংগঠনগুলো বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বহুদিন ধরে কাজ করছে। গত দুই দশকে ছাত্ররাজনীতিতে বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তাদের অবদান কী বা কতটুকু তা দেশবাসী জানে। প্রায় প্রতি সপ্তাহে সংবাদপত্রে তাদের নানা কুকীর্তির খবর ও ছবি ছাপা হয়েছে। ছাত্ররাজনীতিকে কলুষিত করার পেছনে প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলই মূলত দায়ী। দুঃখের বিষয়, এই কলুষিত পটভূমিতে অন্য ছোট ছাত্র সংগঠনগুলো ঐক্যবদ্ধভাবেও তেমন কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারেনি। কেন পারেনি তা নিয়ে বিতর্ক করে লাভ নেই। পারেনি এটাই হলো বাস্তবতা। এই পটভূমিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একদল নির্দল ছাত্র ডাকসু নির্বাচনের দাবিতে সংঘবদ্ধ হচ্ছে—এটা খুবই আশার কথা। এখন তারা শুধু নির্বাচনের দাবি নিয়ে কর্মসূচি দিচ্ছে। তাদের চিন্তা বা পরিকল্পনা কী তা আমাদের জানার কথা নয়। তবে এ ব্যাপারে আমাদের পরামর্শ হবে, তারা সাধারণ ছাত্রদের সংঘবদ্ধ করে ‘নির্দল’ (লেজুড়হীন) ব্যানারে ডাকসু ও বিভিন্ন আবাসিক হল সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারে। ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে সিরিজ আলোচনা করে তারা কয়েকটি দাবির ভিত্তিতে নির্বাচনে অংশ নিতে পারে। তারা নির্বাচিত হলে কী কী বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করবে তা ছাত্র সমাজকে জানাতে পারে। এভাবে ডাকসু নির্বাচনের দাবি ও পাশাপাশি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য একটি শক্তিও তারা হয়ে উঠতে পারে। শুধু লেজুড় ছাত্র সংগঠনই ছাত্রদের প্রতিনিধিত্ব করবে, এমন ভাবার কোনো কারণ নেই। নির্দল (লেজুড়বিহীন) ছাত্ররাও সংঘবদ্ধ হয়ে নির্বাচনে অংশ নিতে পারে। সংঘবদ্ধ হওয়া ও নির্বাচন করা প্রত্যেক ছাত্রছাত্রীর গণতান্ত্রিক অধিকার।
নির্দল ছাত্রদের সংঘবদ্ধ হওয়ার এই মডেল অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েও চালু করা যায়। যদি সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা আগ্রহী হয়। নির্বাচনেই দেখা যাবে সাধারণ ছাত্ররা টেন্ডারবাজ ছাত্র নেতাদের দলকে ভোট দেয় না নির্দল ছাত্রদের ভোট দেয়। নির্বাচনের চেয়ে বড় পরীক্ষা আর কিছু হতে পারে না। অবশ্য সেই নির্বাচন যদি সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হয়।
ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবছর ছাত্র সংসদ নির্বাচন কর্তৃপক্ষের একটি পবিত্র দায়িত্ব। দেশে এখন একটি গণতান্ত্রিক সরকার রয়েছে। যথাসময়ে নির্বাচন যাতে নিশ্চিত হয় তা দেখা শিক্ষা মন্ত্রণালয়েরও দায়িত্ব। শিক্ষামন্ত্রীকে সবাই নানা কারণে সাধুবাদ দেন। কিন্তু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্বাচনসহ ও বিভিন্ন ক্ষেত্রে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে তিনি যে ব্যর্থ হয়েছেন তা তেমন আলোচনা হয় না। প্রাইমারি স্কুলে শান্তি বজায় রাখা সহজ। এ জন্য তাঁকে সাধুবাদ দেওয়া হয়। কিন্তু তাঁর আমলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র নেতাদের টেন্ডার বাণিজ্য যেভাবে বিকশিত হয়েছে তা অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। মনে হয় এ ব্যাপারে তাঁর করণীয় কিছু নেই। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় কি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বাইরে? একেবারেই স্বাধীন? পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা ব্যর্থতার দায়িত্ব কে নেবে? চ্যান্সেলর? ইউজিসি? শিক্ষা মন্ত্রণালয়? এটাও তো আরেক রহস্য দেখছি।
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: উন্নয়ন ও মিডিয়া-কর্মী।

No comments

Powered by Blogger.