চিকিৎসাশিক্ষা-ভালো চিকিৎসক কাকে বলব by এ কে আজাদ খান ও ফরিদ কবির

ভালো চিকিৎসার জন্য ভালো ডাক্তার দরকার। কিন্তু কাকে আমরা ভালো ডাক্তার বলব? একজন ভালো ডাক্তারের কী কী গুণ ও দক্ষতা থাকলে আমরা বলব, এই ডাক্তার ভালো! প্রশ্নটা সরল, কিন্তু উত্তরটা তত সরল নয়। কেউ কেউ বলতে পারেন মেধা, দক্ষতা ও পেশাদারি যাঁর মধ্যে আছে, তিনিই ভালো ডাক্তার।


আমরা মনে করি, ভালো ডাক্তারের আরও দুটো জিনিস থাকতেই হবে। মানসিকতা (অ্যাপটিচিউড) ও সহমর্মিতা। রোগীর প্রতি ডাক্তারের মমত্ববোধ চিকিৎসার ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আমাদের দেশে মেডিকেলে ভর্তির সময় একজন শিক্ষার্থীর যোগ্যতা যাচাইয়ের ক্ষেত্রে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার ফল দেখা হয়। এর মাধ্যমে একজন শিক্ষার্থীর মেধা কিছুটা যাচাই করা গেলেও তাঁর মানসিকতা বা অ্যাপটিচিউড ও রোগীর প্রতি তাঁর মমত্ববোধ কী রকম হবে, তা যাচাই করা যায় না! লিখিত পরীক্ষার যে ব্যবস্থা আছে তাতেও একজন শিক্ষার্থীর জ্ঞান যাচাই করা যায়, বুদ্ধির নয়; অ্যাপটিচিউড তো নয়ই। আর এই জ্ঞান অনেকটাই স্মৃতিশক্তির ওপর নির্ভরশীল। আগে যেসব তথ্য একজন ডাক্তারকে আবশ্যিকভাবে মনে রাখতে হতো, এর অনেক কিছু এখন তাঁর মনে না রাখলেও চলে। যেমন—তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে প্রয়োজনের সময় তিনি সেটা ইন্টারনেট বা মুঠোফোনের কল্যাণে সহজেই জেনে নিতে পারেন। অথচ চিকিৎসার ক্ষেত্রে ডাক্তারের অ্যাপটিচিউড অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এর ওপরই তাঁর মানসিকতা, রোগীর প্রতি তাঁর সহমর্মিতা নির্ভর করে।
বস্তুতপক্ষে ডাক্তারি পেশা মেধার চেয়ে দক্ষতার ওপর বেশি নির্ভরশীল। শল্যচিকিৎসা তো প্রায় পুরোপুরিই দক্ষতার ওপর নির্ভরশীল। শুধু বই পড়ে শল্যচিকিৎসায় ব্যুৎপত্তি অর্জন করা যায় না। এর জন্য অবশ্যই দরকার হাতে-কলমে শিক্ষা।
বাংলাদেশের মেডিকেল কলেজগুলোও সব ক্ষেত্রে মানসম্পন্ন নয়। অনেক ক্ষেত্রেই মেডিকেল কলেজগুলোকে অনুমতি দেওয়ার সময় এটা দেখা হয় না যে তাতে শিক্ষার সব ধরনের ব্যবস্থা আছে কি না। সব ধরনের ব্যবস্থা মানে, ভালো শিক্ষক, প্রয়োজনীয় শিক্ষার উপকরণ, শিক্ষার যথাযথ পরিবেশ, পরীক্ষা নেওয়ার সঠিক পদ্ধতি, সর্বোপরি দক্ষতা অর্জনের জন্য প্রয়োজনীয়সংখ্যক রোগী। আমাদের দেশে অনেক মেডিকেল কলেজই সে অর্থে মানসম্পন্ন নয়। কোনো মেডিকেল কলেজে রোগীর সংখ্যা এতই অপ্রতুল যে একজন শিক্ষার্থীর যথাযথ দক্ষতা অর্জনের জন্য তা যথেষ্ট নয়।
তা ছাড়া একটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শুধু বিশেষায়িত শিক্ষাদান করাই যথেষ্ট নয়, সেখানে একজন শিক্ষার্থীর ইতিবাচক এবং মানবিক মানসিকতা তৈরি করে দেওয়ারও সুযোগ থাকতে হবে। অবশ্য আমাদের সব ধরনের শিক্ষা পদ্ধতিতেই সম্ভবত একটা বড় ত্রুটি রয়ে গেছে, আমরা ছেলেমেয়েদের অনেক কিছু শেখালেও তাদের কতটা মানুষ হতে শেখাই সেটা প্রশ্নসাপেক্ষ। তা ছাড়া তিন ঘণ্টায় পরীক্ষা নেওয়ার যে ব্যবস্থা চালু আছে, তা-ও শিক্ষার্থীদের মেধা যাচাইয়ের জন্য যথেষ্ট নয়।
আজকের দিনে মানুষের মূল্যবোধের যে একটা বড় রকমের পরিবর্তন ঘটে গেছে তার একটা বড় কারণ এই যে, কি বাড়িতে, কি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আমরা ছেলেমেয়েদের ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে ব্যর্থ হচ্ছি।
বর্তমান বাজার অর্থনীতির যুগে ছেলেমেয়েরাও এমন ‘ক্যারিয়ার’ বেছে নিতে চায়, যাতে সে ভালো উপার্জন করতে পারে। প্রায় সব যুগেই ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার বিষয়টিকে ভালো ক্যারিয়ার হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। বর্তমানকালেও অনেক ছেলেমেয়ে চিকিৎসা পেশার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে এই পেশায় আসছে। কিন্তু আমরা কি তাদের যোগ্য চিকিৎসক হিসেবে গড়ে তুলতে পারছি?
আমাদের দেশে সরকারি মেডিকেল কলেজগুলো এখনো বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলোর তুলনায় ভালো। কারণ, সেখানে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর সমাবেশ দেখা যায়। হাসপাতালগুলোতে রোগীর সংখ্যাও তুলনায় বেশি। ফলে শিক্ষার্থীদের দক্ষতা অর্জনের সুযোগও বেশি।
অধিকাংশ বেসরকারি মেডিকেল কলেজেই রোগীর সংখ্যা সরকারি মেডিকেল কলেজগুলোর চেয়ে কম। ফলে দক্ষতা অর্জনের জন্য প্রয়োজনীয়সংখ্যক রোগী এসব হাসপাতালে পাওয়া কঠিন। উন্নত দেশে আজকাল মানবদেহের বদলে মানবদেহের ‘ডামি’ ব্যবহার করা হয়। সেগুলো অনেক কার্যকরী। এমন অনেক রোগ আছে, যা সচরাচর দেখা যায় না। সেসব ক্ষেত্রে উন্নত দেশে মানবদেহের ‘ডামি’ ব্যবহার করা হয়। এ রকম ডামিতে হূৎপিণ্ডের শব্দ পর্যন্ত শোনার ব্যবস্থা আছে! আমাদের মেডিকেল কলেজগুলো এ ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারে। নতুন প্রযুক্তির ব্যবহারকে অনেকে ব্যয়বহুল মনে করলেও আসলে তা নয়। সঠিক সময়ে সঠিক প্রযুক্তি বেছে নেওয়ার বিষয়টি অবশ্যই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে বিবেচনা করতে হবে।
আমাদের দেশে মেডিকেল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে একই ক্যাম্পাসে কলেজ ও হাসপাতাল থাকা বাধ্যতামূলক। আমরা মনে করি, এর কোনো যৌক্তিকতা নেই। আমাদের মতো দেশে যেখানে শহরে খালি জমি প্রায় নেই, সেখানে একই ক্যাম্পাসে কলেজ ও হাসপাতাল রাখার ব্যাপারে বাধ্যবাধকতা তুলে নেওয়া উচিত। এতে করে উদ্যোক্তারা শহরের ভেতরে হাসপাতাল রেখে শহরের আশপাশে তাঁদের কলেজ ক্যাম্পাস প্রতিষ্ঠা করতে পারেন। ফলে তাঁরা শহরেই অপেক্ষাকৃত বড় হাসপাতাল গড়ে তোলার সুযোগ পাবেন। পার্শ্ববর্তী দেশ নেপালেও এ রকম ব্যবস্থা রয়েছে।
এমন নিয়মও থাকতে পারে, যাঁরা জমি বা আর্থিক কারণে কলেজ প্রতিষ্ঠা করতে পারলেও হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করতে পারছেন না, তাঁরা একই শহরের অন্য কোনো হাসপাতালকে তাঁদের ক্যাম্পাস হিসেবে ব্যবহার করতে পারবেন। উন্নত অনেক দেশেই এমন ব্যবস্থা আছে। মিয়ামিতে নোভো ইউনিভার্সিটিতে মেডিকেল কলেজ থাকলেও তাদের নিজস্ব কোনো হাসপাতাল নেই। তারা অন্য ব্যক্তিমালিকানাধীন হাসপাতালকে তাদের ‘অ্যাক্রিডিটেড’ হাসপাতাল হিসেবে ব্যবহার করে। এতে দুই পক্ষেরই সুবিধা! কলেজের নিজস্ব হাসপাতাল না থাকায় তাদের শিক্ষার ব্যয় স্বাভাবিকভাবেই অনেক কম হওয়ার কথা। অন্যদিকে অন্য একটি মেডিকেল কলেজের তরুণ ডাক্তাররা এসে রোগী দেখার কারণে হাসপাতালের চিকিৎসার খরচও কম হবে।
আসল কথা, আমাদের মেডিকেল শিক্ষা খাতটি নিয়ে আরও অনেক কিছু ভাবার সুযোগ আছে। এ ব্যাপারে সঠিক সিদ্ধান্ত যত দ্রুত নেওয়া যাবে, ততই তা দেশ ও জাতির জন্য মঙ্গল। ভালো ডাক্তার গড়ে তুলতে হলে উপযুক্ত শিক্ষাপদ্ধতি যেমন দরকার, তেমনি দরকার যথাযথ শিক্ষার উপকরণও। আর যেহেতু এটি একটি অনন্য পেশা, কাজেই একজন শিক্ষার্থীর স্মৃতিশক্তি ও মেধা যাচাইয়ের পাশাপাশি তার অ্যাপটিচিউড যাচাইয়ের সুযোগও রাখতে হবে।
 অধ্যাপক এ কে আজাদ খান: চিকিৎসাবিজ্ঞানী ও সমাজকর্মী। সভাপতি, বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি।
 ফরিদ কবির: কবি ও প্রাবন্ধিক। যুগ্ম পরিচালক, বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি।

No comments

Powered by Blogger.