বিশুদ্ধ পানির জন্য ছোটাছুটি by অরূপ দত্ত

‘সিদ্ধ করে, এমনকি ফিটকারি দিয়েও কোনো লাভ হয় না, পানির দুর্গন্ধ আর ময়লা যায় না। অনেক দিন ধরে কষ্ট করছি, এখন এই পাম্প, ওই পাম্পে ছোটাছুটি করি।’ বাসাবো ধর্ম মহারাজিক বৌদ্ধবিহারের কল থেকে পানি তুলতে তুলতে এমন মন্তব্য করেন গৃহিণী তসলিমা বেগম। জানালেন, রাজারবাগে তাঁর বাসা। রিকশা ভাড়া বাবদ চলে যায় অনেক টাকা।


তার পরও প্রতিদিন তিনি এই মন্দির অথবা বাসাবো, কদমতলা এলাকার পাম্প থেকেই পানি নেন। প্রতিদিন বিশুদ্ধ পানি নিতে এসব এলাকা ছাড়াও নন্দিরহাট, এমনকি ত্রিমোহনী এলাকা থেকেও মানুষ আসে বৌদ্ধবিহারে। অনেকেই ছোটাছুটি করেন বালুর মাঠসংলগ্ন কদমতলায়, বাসাবো আগমন সিনেমা হলের কাছে, মুগদাপাড়া, মান্ডা, মাদারটেক অথবা গোড়ানে ওয়াসার পাম্প হাউসে। বৌদ্ধবিহারের পানির জন্য কোনো মূল্য দিতে হয় না। ওয়াসার পাম্প হাউসগুলোয় মাঝেমধ্যে কিছু টাকাও গুনতে হয়।
জানা যায়, বাসাবোসহ এসব এলাকায় ওয়াসার পানির সংকট না হলেও ময়লা এবং দুর্গন্ধের জন্য এ পানি পান করা যায় না। অনেকের মতে, এই পানি পান করার অর্থ নিশ্চিত পেটের পীড়ায় আক্রান্ত হওয়া। তাই প্রতিদিন গৃহিণী তসলিমার মতো শত শত মানুষ পানি সংগ্রহ করেন বাসাবো বৌদ্ধবিহার থেকে। ওয়াসার পাম্পগুলোতেও ভিড় জমে শত শত মানুষের। সুপেয় পানির জন্য তাদের বেশি ভরসা বৌদ্ধবিহারের পানির কল।
গভীর নলকূপ থেকে তোলা পানি লাইনে ঢোকার আগে মোটামুটি বিশুদ্ধ থাকে। তাই ওয়াসার পাম্প থেকে পানি নিলে তুলনামূলক বিশুদ্ধ পানি পাওয়া যায়। বলছিলেন কদমতলা পাম্পে জারিকেন নিয়ে হাজির হওয়া মকবুল আহম্মদ। গত এক মাসেরও বেশি সময় ওয়াসার পানিতে দুর্গন্ধ। সেই পানি পান করে প্রথমে তাঁর ১২ বছর বয়সী ছেলে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়। পরে একে একে পরিবারের অন্য সদস্যরাও।
গৃহিণী অনামিকা মাহবুব ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ওয়াসার পানি সিদ্ধ করলে শুধু ফেনা আর দুর্গন্ধ বের হয়। বছরের পর বছর একই সমস্যা। অথচ পানির বিল ঠিকই দিতে হয়।
শুক্রবার দুপুর ১২টার দিকে কদমতলা পাম্পে যখন ভিড় করেছে অনেক মানুষ, হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে যায়। পাম্প অপারেটর জানান, জেনারেটর নেই। বিদ্যুৎ লাইন আছে দুটি। কিন্তু দুটিতেই লোডশেডিং। তাই পাম্প চালু রাখা যাচ্ছে না।
ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিন এ খান গতকাল সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে বলেন, একাধিক বিদ্যুৎ লাইন থাকলেও চেষ্টা করেও চালু রাখা যায় না। সায়েদাবাদ পানি শোধনাগারে প্রাক্-শোধন যন্ত্র (প্রি-ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট) চালু হয়েছে। পানিতে ওষুধ দেওয়া হয় না। তাই সেখানকার সরবরাহ করা পানিতে এখন গন্ধ থাকতে পারে না। ভাঙা পাইপ দিয়ে ময়লা পানি ঢোকায় পানি দূষিত হচ্ছে। তবে সব এলাকায় তা নয়। তিনি জানান, পাম্প হাউস থেকে পানি সংগ্রহের জন্য ওয়াসাও উৎসাহ দেয়।
গতকাল সন্ধ্যায় বৌদ্ধবিহারে গিয়ে দেখা যায়, নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোরদের ভিড়। দুটি কলের সঙ্গে যুক্ত পাইপের সাহায্যে তারা পানি ভর্তি করে কলসি, জারিকেনে। অনেকের হাতে এক বা দুই লিটারের পানির বোতল।
পানি সংগ্রহের স্থানটিতে টানানো সাইনবোর্ডে লেখা, সকাল সাতটা, দুপুর একটা ও রাত আটটায় পানি নেওয়া যাবে। প্রতি বেলায় এক ঘণ্টা করে। কিন্তু এই সময়সূচি রক্ষা করা যাচ্ছে না। বিহারের পানি সরবরাহের একজন তত্ত্বাবধায়ক ভিক্ষু জানান, সব সময় চারদিক থেকে মানুষ এসে ভিড় জমায়। তাই পানি দেওয়ার এখন নির্ধারিত কোনো সময় নেই। রাত ১১টাতেও পানি দেওয়া হয়। কেউ কেউ রিকশা-ভ্যানে করেও পানি নিয়ে যায়।
ওয়াসা সূত্র জানায়, পানি সমস্যা নিরসনে প্রতি সপ্তাহেই রাজধানীর কোনো না কোনো এলাকায় গভীর নলকূপ বসানো হচ্ছে। প্রধানত অনেক পুরোনো পানির পাইপে ছিদ্রপথ তৈরি হওয়ায় সায়েদাবাদের সরবরাহ করা পানি বিশুদ্ধ হলেও ওয়াসার গ্রাহকেরা এখন ওয়াসার ওপর নির্ভর করতে পারছে না।
বৌদ্ধবিহার থেকে জানানো হয়, বৌদ্ধবিহারের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় অনেক বছর আগে বসানো গভীর নলকূপটি এখন পর্যন্ত বিশুদ্ধ পানি দিচ্ছে। ১৯৭২ সাল থেকে তারা জণকল্যাণে পানি সরবরাহ করছে। যারাই আসে কাউকে না করা হয় না।

No comments

Powered by Blogger.