রাজনীতি-বটতলা ও আজকের রাজনীতি by ইমতিয়াজ আহমেদ

মধুর ক্যান্টিনের মালিক মধুসূদন দে'কেও পরিবারের কয়েকজন সদস্যসহ হত্যা করা হয়। তার অপরাধ ছিল, 'মধুর ক্যান্টিনে' ছাত্রনেতারা ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা প্রণয়নের জন্য আলোচনায় বসেন এবং বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। একটি ক্যান্টিনের মালিক রাষ্ট্রের সশস্ত্র বাহিনীর প্রবল রোষের শিকার হয়েছে, এমন নজির বিশ্বে বিরল।


তবে তার চেয়েও বিস্ময়কর ঘটনা সম্ভবত কলাভবনের সামনের বটগাছটিকে ২৫ মার্চের পর সমূলে উপড়ে ফেলা। পাকিস্তানি সৈন্যরা নিরস্ত্র ছাত্র ও শিক্ষকদের হত্যা করেছে। ঢাকা শহরকে বধ্যভূমিতে পরিণত করেছে। সমগ্র বাংলাদেশে মাসের পর মাস গণহত্যা চালিয়েছে। কিন্তু একটি নির্বাক বটগাছও তাদের টার্গেট হলো!



বটগাছ। ইংরেজিতে বলা হয় বেনিয়ান ট্রি। বেনিয়া শব্দটি গুজরাটি। বেনে, বেনিয়া বা বণিক শব্দের সঙ্গে আমরা পরিচিত। বটগাছের নিচে বেনিয়ারা আর্থিক লেনদেন করত। সে কারণেই এ গাছের নাম বেনিয়ান ট্রি হিসেবে পরিচিতি পায়।
আমাদের উপমহাদেশে বটগাছ সব ধর্মের মানুষের কাছে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। শ্রীকৃষ্ণ বটের পাতায় চলাফেরা করতেন, এমন মিথ রয়েছে। তিনি বলেছেন, 'আমিই বটগাছ।'
রামায়ণে রাম-সীতাকে নিয়ে একটি আখ্যানে বটগাছই মুখ্য ভূমিকায়। ১৪ বছর বনবাস জীবন শুরুর পরপরই তারা জানতে পারেন, রাজা দশরথের মৃত্যু ঘটেছে। বৌদ্ধ গয়া এলাকা দিয়ে যাওয়ার সময় রাম দেখলেন, এক ব্রাহ্মণ বটগাছের নিচে ধ্যান করছেন। তিনি তার কাছে পিতা দশরথের পারলৌকিক ক্রিয়া সম্পন্ন করায় সাহায্য চাইলে সম্মতি মেলে এবং তার আয়োজনে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। রাম এজন্য জোগাড়যন্ত্রে চলে যাওয়ার পরপরই রাজা দশরথের আত্মা সীতার কাছে এসে বলেন, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পারলৌকিক ক্রিয়া সম্পন্ন করতে না পারায় তিনি মুক্তি পাচ্ছেন না। সীতা প্রথমে অপারগতা প্রকাশ করেন। কিন্তু রাজা দশরথ সীতাকেই এ অনুষ্ঠান সম্পন্ন করার নির্দেশ দেন এবং তাতে ব্রাহ্মণও সম্মত হন। রাম ফিরে এসে ঘটনাটি শুনে বিশ্বাস করেননি। সীতা তখন ব্রাহ্মণকে সাক্ষী মানেন। তিনি রামকে রুষ্ট করতে চাননি এবং পারলৌকিক ক্রিয়া সম্পন্ন করায় সহায়তার কথা অস্বীকার করেন। এতে সীতা রুষ্ট হয়ে অভিশাপ দেন, 'প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে আপনাকে মানুষের কাছ থেকে ভিক্ষা করে জীবন কাটাতে হবে।' এভাবে তুলসী পাতা এবং নদীও জানায়, সীতার কাছে রাজা দশরথের আত্মা আসার বিষয়টি তাদের জানা নেই। তাদেরও সীতা অভিশাপ দেন। হতাশ হয়ে সীতা পুরাতন বটবৃক্ষের কাছে কাতর হয়ে বলেন, 'তুমি তো সব দেখেছ। দয়া করে সত্য প্রকাশ কর।' বটবৃক্ষ ভাবল, সত্য বলা না হলে পাপ হবে। সে যা যা দেখেছে সব অকপটে রামকে বলল। তখন সীতা বটগাছকে আশীর্বাদ করে বর দিলেন, 'প্রবীণ বৃক্ষ, তোমার কখনও মৃত্যু হবে না। তুমি শত শত বছর বেঁচে থাকবে। মানুষ তোমার পূজা করবে। সব সময় তুমি পত্র ও ফল শোভিত থাকবে এবং তোমার সুশীতল ছায়াতলে মানুষ বিশ্রাম নেবে।'
ভগবান বুদ্ধ বটগাছের নিচেই দীক্ষা পেয়েছেন। সম্রাট অশোকেরও বটগাছ প্রিয় ছিল। তার স্ত্রী বটগাছ কেটে ফেললে তিনি আবার তা লাগিয়ে দেন।
ইসলাম ধর্মে আধ্যাত্মিক সুফি সাধক ও ফকিররা বটগাছের নিচে আখড়া গড়ে তোলেন। সেখানে তাদের কাছে আসে নারী-পুরুষসহ সর্বস্তরের মানুষ।
বাংলাদেশের প্রসিদ্ধ সব স্থানের সঙ্গে বটগাছ কমবেশি যুক্ত থাকতে দেখা যায়। দীর্ঘায়ু এ গাছকে কেন্দ্র করেই হাট-বাজার ও মেলা বসে। গ্রামের পথে বিশ্রামের জন্য এর চেয়ে উপযুক্ত স্থানও আর হয় না।
বাংলাদেশের ইতিহাসের সঙ্গে বটগাছ ওতপ্রোতভাবে জড়িত হয়ে আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলা ঐতিহাসিক স্থান হিসেবে গণ্য হয়। কলাভবনের সামনে অবস্থিত বটবৃক্ষের ছায়াতলে অনুষ্ঠিত সমাবেশে অনেক খ্যাতিমান ছাত্রনেতা গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ প্রদান করেছেন। ১৯৭১ সালের ২ মার্চ এ অঙ্গনেই ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতারা বাংলাদেশের যে পতাকা উত্তোলন করেন, দেড় মাসের মধ্যে গঠিত স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার সে পতাকাকেই জাতীয় পতাকা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
পাকিস্তানের শাসকদের প্রবল আক্রোশ ছাত্রসমাজের ওপর, এটাই স্বাভাবিক। ২৫ মার্চ রাতে অপারেশন সার্চলাইট বাস্তবায়নে প্রথম টার্গেট ছিল সার্জেন্ট জহুরুল হক হল, জগন্নাথ হল, এসএম হল ও রোকেয়া হল। ড. জিসি দেব, ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, ড. মনিরুজ্জামানসহ কয়েকজন শিক্ষক ওই ভয়াল রাতে তাদের হাতে প্রাণ হারান। মধুর ক্যান্টিনের মালিক মধুসূদন দে'কেও পরিবারের কয়েকজন সদস্যসহ হত্যা করা হয়। তার অপরাধ ছিল, 'মধুর ক্যান্টিনে' ছাত্রনেতারা ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা প্রণয়নের জন্য আলোচনায় বসেন এবং বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। একটি ক্যান্টিনের মালিক রাষ্ট্রের সশস্ত্র বাহিনীর প্রবল রোষের শিকার হয়েছে, এমন নজির বিশ্বে বিরল।
তবে তার চেয়েও বিস্ময়কর ঘটনা সম্ভবত কলাভবনের সামনের বটগাছটিকে ২৫ মার্চের পর সমূলে উপড়ে ফেলা। পাকিস্তানি সৈন্যরা নিরস্ত্র ছাত্র ও শিক্ষকদের হত্যা করেছে। ঢাকা শহরকে বধ্যভূমিতে পরিণত করেছে। সমগ্র বাংলাদেশে মাসের পর মাস গণহত্যা চালিয়েছে। কিন্তু একটি নির্বাক বটগাছও তাদের টার্গেট হলো!
কেন গাছটির ওপর তাদের এমন আক্রোশ? এর কারণ বুঝতে আমাদের সমস্যা হয় না। এখানে ছাত্রনেতারা বছরের পর বছর মানুষের কথা বলেছেন। বঞ্চিত-নিপীড়িত মানুষের প্রত্যাশা ও স্বপ্ন তুলে ধরেছেন। নতুন একটি দেশ চায় বাংলাদেশের মানুষ, সেটা ব্যক্ত করেছেন অকুতোভয়ে। এখানে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের দিনগুলোতে প্রতিদিন ছাত্রছাত্রীরা সমবেত হতো। একাত্তরের ১ মার্চ মধ্যাহ্নে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদ অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করলে মধুর ক্যান্টিন ও বটতলাতেই তার প্রথম প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়। পরদিন এখানেই ঢাকা শহরের হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী ছুটে আসে নতুন একটি দেশের পতাকা উত্তোলন প্রত্যক্ষ করার জন্য। এ বটগাছের প্রতিটি ডালপালা এমনকি পাতাও যেন তার সাক্ষী হয়ে আছে। এ কারণেই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী গাছটিকে সহ্য করতে রাজি ছিল না।
বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে অগণিত নারী-পুরুষের আত্মদানের বিনিময়ে। ১৯৭২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি নতুন করে ক্লাস শুরু হলো। দেখা গেল, ছাত্রছাত্রীরা ভুলে যায়নি বটবৃক্ষের কথা। বিশ্ববিদ্যালয় খোলার এক সপ্তাহ যেতে না যেতেই বাংলাদেশ সফরে আসেন যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি, যিনি একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন পরম বন্ধুর মতো। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষমতাসীন ছিল রিপাবলিকান দলীয় সরকার। কেনেডির দল ডেমোক্রেটিক পার্টি ছিল বিরোধী আসনে। কিন্তু বাংলাদেশের পক্ষে এ দলের ভূমিকা ছিল দ্ব্যর্থহীন। কলাভবন প্রাঙ্গণে ২৫ মার্চের পর উপড়ে ফেলা বটগাছটি, যাকে যথার্থভাবেই বলতে পারি বাংলাদেশের স্ট্যাচু অব লিবার্টি_ তার উপড়ে পড়া স্থানে আরেকটি বটের চারা রোপণের জন্য এডওয়ার্ড কেনেডির চেয়ে উপযুক্ত ব্যক্তি আর কেইবা হতে পারতেন। আমি সে সময়ে ঢাকার একটি স্কুলে দশম শ্রেণীতে পড়তাম। এর কয়েক মাস আগে হানাদার বাহিনী অধ্যুষিত দুর্গম ও বিপদসংকুুল পথ পাড়ি দিয়ে ছুটে গিয়েছি সশস্ত্র যুদ্ধের ট্রেনিং গ্রহণের জন্য। এডওয়ার্ড কেনেডি বটতলায় আসছেন এবং নতুন একটি গাছ লাগাবেন জেনে বন্ধুদের সঙ্গে আমিও সেখানে ছুটে আসি। শুধু বটতলা নয়, গোটা ক্যাম্পাস তখন লোকে লোকারণ্য।
এ গাছটি চার দশকে পূর্ণতা পেয়েছে। তার ছায়াতলে শিক্ষার্থীরা বসে থাকে। পাখি সারাবছর খাবার পায়। কিন্তু আজকের ছাত্র রাজনীতি কি আর আগের মতো আছে, এ প্রশ্ন অনেকের। এখনকার শিক্ষার্থীদের মধ্যে একাত্তরের সেই চেতনা কেন লক্ষ্য করি না? আশির দশকে এইচএম এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ছাত্রসমাজ ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা নিয়ে এগিয়ে এসেছিল। বিশেষ করে ১৯৯০ সালের কয়েকটি মাস তাদের কর্মকাণ্ড দেশবাসীর মনে আশার সঞ্চার করে। কিন্তু গত দুই যুগ ধরে বটতলা যেন নিষ্প্রাণ। সেখানে আর জাতির বিবেক ধ্বনিত হয় না। এজন্য কাকে দোষী করব_ বটগাছ নাকি ছাত্রসমাজকে বিশেষ করে ছাত্র সংগঠনগুলোকে? আমার তো মনে হয়, এদের কাউকেই এজন্য দোষী করা যায় না। বরং দায় চাপানো যায় রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর, যারা কলাভবনের বটগাছটিকে দারুণ ভয় পায়, যেমন ভয় পেত পঞ্চাশের দশকে পুরনো কলাভবনের সামনের আমতলাকে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি এ অঙ্গন থেকেই দলে দলে ছাত্রছাত্রীরা গুলি-টিয়ার গ্যাস-লাঠিচার্জ উপেক্ষা করে রাজপথে নেমে এসেছিল।
এখন রাজনীতির অঙ্গন যারা নিয়ন্ত্রণ করেন তারা চান না যে ছাত্রসমাজ গণতন্ত্রের চেতনায় সমৃদ্ধ হোক, অন্যায়-অসত্যের বিরুদ্ধে তারা গর্জে উঠুক। এ কারণে তারা প্রলোভনের ফাঁদ পাতে। বটতলায় নয়, ছাত্রনেতাদের ব্যস্ত রাখতে চায় অন্যত্র। এ কারণে বটতলার আর আগের মতো ব্যবহার দেখি না।
শিক্ষকদেরও দায় কম নেই। সাধারণভাবে তারাও ছাত্রদের অবাধ মতপ্রকাশের পৃষ্ঠপোষকতা করতে উৎসাহী নন। অনেক প্রবীণ শিক্ষক পর্যন্ত সচেষ্ট থাকেন রাজনৈতিক দলের নানা পর্যায়ে আনুকূল্য লাভের জন্য। তারা গণমানুষের অধিকারের সপক্ষে কথা বলতে বটতলায় সমবেত হন না। বরং তাদের দেখা যায় প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলের কার্যালয়ে কিংবা গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের বাসভবনে। ব্যক্তিস্বার্থ এখানে মুখ্য এবং এ জন্য ইঁদুর দৌড়ে অনেকেই শামিল হয়ে পড়েন। ক্ষমতার কত কাছে গিয়ে কত বেশি ব্যক্তিগত সুবিধা আদায় করা যায়, সেটা মুখ্য হয়ে উঠলে বটতলা অপাঙ্ক্তেয় হবেই।
কিন্তু বটগাছ রাজনীতি, অর্থনীতি, ধর্ম ও সমাজের সঙ্গে সম্পর্কিত, তাই এ থেকে চাইলেও দূরে সরে থাকা যাবে না। ছাত্ররা যখনই সুযোগ পাবে আবারও সমবেত হবে আমাদের স্ট্যাচু অব লিবার্টি বটবৃক্ষের নিচে। তারা মুক্তির কথা বলবে, মূক-মূঢ়দের হয়ে কথা বলবে। সমাজের সর্বত্র যখন বাক ও শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা, তখন তারা অকুতোভয়ে এগিয়ে আসবে। কেউ চাইলেই এ বটতলাকে চিরকাল উপেক্ষিত রাখা যাবে না।

ড. ইমতিয়াজ আহমেদ : রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
imtiazalter@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.