অনুসন্ধান কমিটি থেকে ইউনূসকে বাদ দিতে নানা কৌশল by জাহাঙ্গীর শাহ

গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগে অনুসন্ধান কমিটি নিয়ে নতুন করে জটিলতা শুরু হয়েছে। নানা ধরনের কৌশল করে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে কমিটি থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। এ জন্য নতুন করে পরিচালনা পর্ষদও গঠন করা হয়। এসব কারণে গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি নিয়োগ দেওয়া যাচ্ছে না।


গ্রামীণ ব্যাংকের সাবেক পরিচালনা পর্ষদ প্রস্তাবিত অনুসন্ধান কমিটিতে গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক অধ্যাপক ইউনূসকে চায় না সরকার। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত নিজেও গতকাল শনিবার এ কথা বলেছেন।
গ্রামীণ ব্যাংক সূত্র জানায়, পরিচালনা পর্ষদ প্রস্তাবিত কমিটির তালিকা মানেননি গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ চেয়ারম্যান মোজাম্মেল হক। তিনি মুহাম্মদ ইউনূসকে সভাপতি করে পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠনের প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছেন। এখন তাঁকেই প্রধান করে নতুন একটি কমিটির নাম প্রস্তাব করা হয়েছে। এখন নতুন কমিটি পাস করিয়ে নেওয়ার চেষ্টা চলছে বলে জানা গেছে।
গ্রামীণ ব্যাংক অধ্যাদেশের ১৪(২) ধারা অনুযায়ী, ব্যবস্থাপনা পরিচালকের শূন্য পদে নিয়োগ দেওয়ার জন্য পরিচালকমণ্ডলী কর্তৃক তিন থেকে পাঁচ সদস্যের একটি অনুসন্ধান কমিটি গঠনের বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
গত বছরের ১২ মে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে ইস্তফা দেন নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস। একই বছরের ২৬ জুলাই নতুন ব্যবস্থাপনা পরিচালক নির্বাচনে একটি অনুসন্ধান বা ‘সিলেকশন কমিটি’ গঠনের উদ্দেশ্যে বৈঠক করেন গ্রামীণ পরিচালনা পর্ষদের সদস্যরা। সেই বৈঠকে পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের প্রস্তাব অনুসারে মুহাম্মদ ইউনূসকে সভাপতি করে পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট কমিটির সদস্যদের নাম প্রস্তাব করা হয়। অন্য সদস্যরা হলেন—সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও গ্রামীণ ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আকবর আলি খান, গ্রামীণ ব্যাংকের সাবেক উপব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহম্মদ খালেদ শামস, পরিচালনা পর্ষদের পরিচালক কামরুল হাসান ও রোজিনা বেগম।
কিন্তু সভার কার্যপত্র খসড়া তৈরির পর প্রস্তাবিত এই কমিটি সম্পর্কে দ্বিমত পোষণ করেন গ্রামীণ ব্যাংকের চেয়ারম্যান মোজাম্মেল হক। খসড়ার ওপর তিনি মত দিয়ে লেখেন, ‘সিলেকশন কমিটি গঠনের প্রক্রিয়ার প্রস্তাবের সাথে সার্বিক আলোচনার মিল না থাকায় উল্লেখিত প্রস্তাব পরবর্তী বোর্ড সভায় উপস্থাপন করা হোক।’ তবে ঋণগ্রহীতা সদস্য হিসেবে পরিচালনা পর্ষদের পরিচালকেরা এর বিরোধিতা করেন। তাঁরা একই খসড়া কার্যপত্রে মত দেন, ‘চেয়ারম্যানের সাথে আমরা একমত নই।’
গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় গ্রামীণ ব্যাংকের চেয়ারম্যান মোজাম্মেল হকের সঙ্গে মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও তাঁকে পাওয়া যায়নি।
এরপর গত ২১ নভেম্বর পরিচালনা পর্ষদের সভায় নতুন অনুসন্ধান কমিটির সদস্যদের নাম প্রস্তাব করা হয়। এই কমিটির সভাপতি হিসেবে থাকেন মোজাম্মেল হক। সদস্য হিসেবে গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য রোজিনা বেগম, জুলেখা বেগম, ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহ এ সারোয়ার ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি সুরাইয়া বেগম। এই কমিটিতে সরকারি প্রতিনিধি মূলত তিনজন। এই প্রস্তাবটির ক্ষেত্রে এখনো অনুমোদন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়নি। অনুমোদন করার জন্য ঋণগ্রহীতা পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের ওপর নানা ধরনের হুমকি-ধমকি দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। এমনকি প্রলোভনও দেখানো হয়েছে। এর পরও কোনো কাজ হয়নি।
এর পরে নতুন পরিচালনা পর্ষদে গঠন করে ঋণগ্রহীতা সদস্য হিসেবে নয়জন নতুন সদস্য নেওয়া হয়। গত ১৯ মার্চ থেকে এই নতুন পর্ষদ কার্যকর করা হয়েছে। পর্ষদ সদস্যদের মেয়াদ তিন বছর। ঋণগ্রহীতা সদস্য হিসেবে নতুন পর্ষদের সদস্যরা হলেন—রেহানা আক্তার, তাহসিনা খাতুন, সালেহা খাতুন, মোছাম্মৎ পারুল বেগম, মোছাম্মৎ সাহিদা বেগম, মোমেলা বেগম, সাজেদা, সুলতানা ও মেরিনা। এ ছাড়া বর্তমান পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান মোজাম্মেল হকের পাশাপাশি নতুন দুজন সরকার মনোনীত সদস্য রয়েছেন। আর গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকও পদাধিকারবলে পর্ষদের সদস্য। পরিচালনা পর্ষদের ওপর ড. ইউনূসের অনুরক্তদের প্রভাব কমানোর জন্যই এটা করা হয়েছে বলে অনেকে মনে করছেন।
মাঝে অবশ্য আরেকবার অনুসন্ধান কমিটি গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। গত ২০ জুলাই গ্রামীণ ব্যাংক ভবনে পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান মোজাম্মেল হকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত নির্বাহী কমিটির বৈঠকে নতুন ব্যবস্থাপনা পরিচালক নির্বাচনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ওই কমিটির দুজন সদস্যের আপত্তিতে সেই উদ্যোগ ভেস্তে যায়।
গ্রামীণ ব্যাংকের কর্মীরা অভিযোগ করেছেন, গ্রামীণ ব্যাংকের মালিকানা গরিব গ্রাহকদের হাতে থাকলেও সরকার নিজের পছন্দের লোককে ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দিতে চায়। তাই প্রস্তাবিত দ্বিতীয় অনুসন্ধান কমিটিতে বেশি সদস্য সরকার-মনোনীত। প্রস্তাবিত প্রথম কমিটিতে সরকার-মনোনীত সদস্য ছিল কম।
প্রসঙ্গত, গ্রামীণ ব্যাংকের সম্পদের ৯৫ শতাংশের মালিকানা গরিব গ্রাহকেরা। আর ৫ শতাংশের মালিক সরকার।

No comments

Powered by Blogger.