সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ-দুটি অনন্য বিজয় by হাফিজুর রহমান কার্জন

২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে জনগণের দ্বারা বিপুলভাবে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর পরবর্তী ২/৩ বছর রাজনৈতিকভাবে বিএনপির অবস্থা ছিল নাজুক। কিন্তু রোডমার্চের সময় থেকে বিএনপির সমাবেশে বিপুল জনসমাগম পরিলক্ষিত হতে থাকে।


বিএনপির প্রতি এ জনসমর্থন কতটা তাদের ইতিবাচক কর্মকাণ্ডের জন্য আর কতটা প্রত্যাশা পূরণে সরকারি ব্যর্থতাজনিত হতাশা থেকে সেটা অবশ্য প্রশ্নসাপেক্ষ



মার্চ মাসটি বাঙালির জন্য একটি অনন্য মাস। বাঙালির ২৪ বছরের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক আন্দোলন আকাশস্পর্শী উচ্চতা পেয়েছিল এ মাসে। এ মাসে গর্জে উঠেছিল বাঙালি, গর্জে উঠেছিলেন বঙ্গবন্ধু, দিয়েছিলেন স্বাধীনতার ডাক। উত্তাল মার্চের অগি্নঝরা আন্দোলন দিশেহারা করে দেয় পাকিস্তানি শাসকদের। ২৫ মার্চ রাতের অন্ধকারে ট্যাংক, কামান ও বেয়নেট নিয়ে পাকিস্তানি সৈন্যরা কাপুরুষের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর। সারি সারি লাশের ওপর দাঁড়িয়ে রক্ত-শপথ নিয়ে বাঙালি ঘুরে দাঁড়ায়, ৯ মাসের যুদ্ধে বিপুল এক বিজয় অর্জন করে প্রতিষ্ঠা করে বাংলাদেশ নামের ভূখণ্ড। বাঙালির ইতিহাসে মার্চ মাস সেজন্য অনন্য, এ মাস বাঙালির সংগ্রাম, প্রতিরোধ ও স্বাধীনতা অর্জনের মাস। কিন্তু সেই মার্চে দেশের বড় দুটি জোটের পাল্টাপাল্টি মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে শঙ্কা ও উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছিল চারদিকে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও মহত্তর সব অর্জনকে কি আমরা সম্মিলিতভাবে উদযাপন করতে পারি না? যে সময়গুলো বাঙালির বীরত্ব, প্রতিরোধ ও অতুলনীয় সংগ্রামের সঙ্গে জড়িত, সেই সময়কে কি আমরা সব বাদানুবাদ ও রেষারেষির বাইরে রাখতে পারি না? তবে আশার কথা হচ্ছে, ১৪ মার্চ রাতে আমরা অভূতপূর্ব এক বিশ্বজয়ের সংবাদ পাই। মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নিয়ে বাংলাদেশের যে বিরোধ ছিল, ওই বিষয়ে সমুদ্র আইন বিষয়ক আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল বাংলাদেশের পক্ষে রায় দিয়েছে। স্বাধীনতার পরে আন্তর্জাতিক কোনো বিষয়ে এটি হচ্ছে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অর্জন। এর দু'দিন পরই ১৬ মার্চ বাংলাদেশ ক্রিকেট দল এশিয়ান কাপে পরাজিত করল বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন ভারতকে। ২৮৯ রানের একটি বিশাল লক্ষ্য তাড়া করে বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা এ জয় ছিনিয়ে আনেন। সারাদেশ ভাসতে থাকে আনন্দের বন্যায়। বাঙালির অন্তর্নিহিত শক্তির কারণেই হোক অথবা গ্রহ-নক্ষত্রের যোগাযোগের কারণেই হোক, ঠিক মার্চ মাসেই বিশাল মাপের দুটি বিজয় এ মাসকে অনবদ্য করে তুলেছে।
ফিরে আসি আবার ১২ মার্চ বনাম ১৪ মার্চ প্রসঙ্গে। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি জাতীয় সংসদে না গিয়ে রাজপথে রোডমার্চ ও সমাবেশ করে বেড়াচ্ছে (উলেল্গখ্য, ১৮ মার্চ বিএনপি সংসদ সদস্যপদ রক্ষার জন্য আবার সংসদে ফিরে এসেছে)। ফলে '৯০-পরবর্তী সংসদীয় গণতন্ত্র যে শক্ত ভিত্তি পাওয়ার কথা ছিল, তা আর পাচ্ছে না। ১২ মার্চ বিএনপি ঢাকায় মহাসমাবেশ ডেকেছিল। এটি তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার। এ অধিকার খর্ব হওয়া নাগরিক অধিকার ও গণতন্ত্রের জন্য মোটেই ভালো নয়। কিন্তু তাদের পরিকল্পনা ছিল সারাদেশ থেকে লোক জড়ো করে ঢাকাকে অচল করে দেওয়া। ফলে অনেকেই শঙ্কিত হয়েছেন। উৎকণ্ঠিতদের তালিকায় প্রথমেই ছিল সরকার। সরকার এতটাই শঙ্কিত হয়ে পড়েছিল যে, অনেক ক্ষেত্রেই তারা সংযমের পরিচয় দিতে পারেনি। ফলে দু'পক্ষের বাদানুবাদ ও রেষারেষির চূড়ান্ত মাসুল গুনতে হয়েছে সাধারণ মানুষকে। ওদিকে গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকেও নাশকতার আশঙ্কা করা হয়েছিল। গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্টকে যদি আমরা সরকারি পক্ষপাতদুষ্ট বলেও ধরে নেই, তাহলেও নাশকতার আশঙ্কাকে ভিত্তিহীন মনে করার কোনো কারণ নেই। কেননা, গত ১৮ ডিসেম্বর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে বিএনপির পূর্বনির্ধারিত মুক্তিযোদ্ধা সংবর্ধনা ছিল। কিন্তু ওইদিন ভোরের আলো ফোটার আগেই জামায়াতে ইসলামীর কর্মীরা ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডে তৎপর হয়েছিল। কিন্তু যথাসময়ে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করার ফলে জামায়াতকর্মীরা কোনো বিশৃঙ্খলা তৈরি করতে পারেনি। এ ছাড়া সেনাবাহিনীতে শৃঙ্খলা ভঙ্গের ঘটনায়ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া উস্কানি দিয়েছিলেন বলে অনেকে মনে করেন। উপরন্তু, একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলা এবং জঙ্গিবাদের উত্থানের সঙ্গে বিএনপির সংশ্লিষ্টতার বিষয়টিও সাম্প্রতিক নাশকতার আশঙ্কাকে দৃঢ় ভিত্তি দিয়েছে। ওদিকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলছে। অভিযুক্তদের তালিকায় রয়েছেন জামায়াতে ইসলামী ও বিএনপির শীর্ষ নেতারা। ফলে বিএনপি-জামায়াত জোট নানাভাবে এ বিচারকে নস্যাৎ করার চেষ্টা করছে। এ রকম পরিস্থিতিতে সরকারি বাহিনীর সতর্কতা এবং ১৪ দলের রাজনৈতিক কর্মসূচিকে যথার্থ বলে মনে হয়। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরকারি বাহিনীর অসংযমী হয়ে ওঠা এবং সরকারি দলের কোনো কোনো সহযোগী সংগঠনের অতিরিক্ত তৎপরতা পরিস্থিতিকে যেমন নাজুক করেছে, তেমনি তা জনগণের জন্য নানা ভোগান্তির সৃষ্টি করেছে। নানা ধরন ও মাত্রার বাধা তৈরির পরও ১২ মার্চ বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট যে মহাসমাবেশ করেছে তা ছিল সফল। ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে জনগণের দ্বারা বিপুলভাবে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর পরবর্তী ২/৩ বছর রাজনৈতিকভাবে বিএনপির অবস্থা ছিল নাজুক। কিন্তু রোডমার্চের সময় থেকে বিএনপির সমাবেশে বিপুল জনসমাগম পরিলক্ষিত হতে থাকে। বিএনপির প্রতি এ জনসমর্থন কতটা তাদের ইতিবাচক কর্মকাণ্ডের জন্য আর কতটা প্রত্যাশা পূরণে সরকারি ব্যর্থতাজনিত হতাশা থেকে সেটা অবশ্য প্রশ্নসাপেক্ষ। সেনাবাহিনীর গর্ভ থেকে জন্ম নেওয়া একটা দল হওয়ার পরও বিএনপি বারবার যেভাবে জনগণের সমর্থনে অভিষিক্ত হয়েছে, তা এ দলটির গণভিত্তিকে প্রমাণ করে। কিন্তু এরপরও প্রশ্ন জাগে, দৃঢ় গণভিত্তি থাকার পরও কেন দলটি অসাংবিধানিক পথে ক্ষমতায় যেতে চায়? সেনাবাহিনীতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি, জঙ্গিবাদের উত্থান ও ২১ আগস্টের বোমা হামলার সঙ্গে কেন বিএনপির নাম বারবার উচ্চারিত হয়?
দুর্ভাগ্যজনকভাবে দুটি প্রধান জোটের মধ্যে যে বিষয়টি নিয়ে বিরোধ চলছে, সেটি হচ্ছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন। অনেক চড়াই-উৎরাই ও রক্তক্ষরণ শেষে ১৯৯৬ সালে আমরা বিষয়টি মীমাংসা করেছিলাম। যতদিন না গণতন্ত্র দৃঢ় ভিত্তি পায়, রাজনৈতিক দল ও রাজনীতিবিদদের মধ্যে যতদিন না একটা কার্যকর আস্থার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়, ততদিন জাতীয় নির্বাচনগুলো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই হতে পারত। কিন্তু প্রথম থেকেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার নামক প্রতিষ্ঠানটিকে বিএনপি হয় প্রভাবিত অথবা অকার্যকর করতে চেয়েছে। পরিণতিতে ২০০৬ সালে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসে এবং এর ফল দেশের রাজনীতি ও অর্থনীতির ওপর হয় নেতিবাচক। ফলে বর্তমান সরকার পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধানকে সংবিধান থেকে বিলুপ্ত করে দেয়। কিন্তু বিরোধী দল বিএনপি তা মানতে নারাজ, যদিও একসময় তারাই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ঘোর বিরোধী ছিল। বর্তমান পরিস্থিতিতে দু'পক্ষকেই তাদের অবস্থান পুনর্বিবেচনা করে একটি সমাধানের পথ খুঁজে বের করতে হবে। বর্তমান নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করে, কমিশনের অবকাঠামো শক্তিশালী করে ও লোকবল বাড়িয়ে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশনের অধীনে পরবর্তী জাতীয় নির্বাচন হতে পারে। অথবা অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধানে পরিবর্তন এনে নিরপেক্ষ-নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেও পরবর্তী নির্বাচন হতে পারে।

হাফিজুর রহমান কার্জন :সহযোগী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
hrkarzon@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.