স্মরণ-প্রতিবাদের স্ফুলিঙ্গ কর্নেল তাহের by কামাল লোহানী

হে মহান মুক্তিযোদ্ধা, আদর্শের সৈনিক, কালের নির্মম প্রবাহে আমরাও 'জেনে-শুনে বিষপান' করেছি। এ বিষ নামাতে একমাত্র তোমার প্রদর্শিত পথেই চলতে হবে সত্যিকার মুক্তিযোদ্ধাদের। অর্থাৎ মুক্তিযোদ্ধাদের আরেকবার লড়তে হব
কর্নেল তাহের একটি দর্শনকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন বলে দেশকে নির্মোহভাবে ভালোবেসেছিলেন।


তাই প্রাণোৎসর্গ করতে পেরেছিলেন মানুষেরই কল্যাণে, এমন নির্ভীক মুক্তি সংগ্রামী তাহেরকে গোপন বিচারে হত্যা করা হয়েছিল। যে বিচারের পেছনে কোনো আইনগত সমর্থন সৃষ্টি করা ছাড়াই এমন হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করেছিল ক্ষমতালোভী জেনারেল জিয়াউর রহমান। পঁচাত্তরের ৭ নভেম্বর সিপাহি জনতা যে বিপ্লবের সূচনা করেছিলেন, আদর্শিক সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী, মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার, কর্নেল আবু তাহের এবং এই তাহেরেরই নেতৃত্বে সংগঠিত এ বিপ্লব জনগণকে দিয়েছিল তাৎক্ষণিক মুক্তির আস্বাদ। আবু তাহের জনগণকে ভালোবাসতেন, কিন্তু এ কথা জানতেন, জীবন ও জনগণকে ভালোবাসতে হলে লড়াই করেই বাঁচতে হবে। তাই জনগণেই ছিল তার ভরসা। সেনাবাহিনীর সদস্য ছিলেন বলে তাকেই তিনি পরিণত করতে চেয়েছিলেন জনগণের সেনাবাহিনীতে। উৎপাদন প্রক্রিয়ার সুশৃঙ্খল বাহিনী হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন তিনি। সেনাবাহিনীকে জনগণের সেবক হিসেবে রূপান্তর করতে চেয়েছিলেন। তাই সমাজতান্ত্রিক চিন্তাচেতনাই তাকে প্রবল প্রাণের শক্তিধর সংগ্রামী মানুষ হিসেবে গড়ে তুলেছিল। গঠন করেছিলেন 'গণবাহিনী'। নিজ মতাদর্শের মানুষকে সেনাবাহিনীর মধ্যেই সংগঠিত করে সংঘবদ্ধ শক্তির উদ্বোধন ঘটেয়েছিলেন। ৭ নভেম্বর 'সিপাহি জনতার বিপ্লব' ঘটানোর সঙ্গে সঙ্গে কর্নেল তাহের জেনারেল জিয়াকে বন্দিদশা থেকে মুক্তি দিয়ে রাষ্ট্রভার তাকেই দিয়েছিলেন। কিন্তু জিয়াউর রহমান উচ্চাশা পূরণের প্রক্রিয়ার পথকে নিষ্কণ্টক করার উদ্দেশ্যে তাহেরকে ঠাণ্ডা মাথায় ফাঁসিতে চড়িয়ে নির্মমভাবে হত্যা করেছিলেন। সেটা ছিল ২১ জুলাই, ১৯৭৬ সাল। ফাঁসির মঞ্চে গেয়ে গেলেন যারা জীবনের জয়গান, শহীদ আবু তাহের তাদের সারিতে দাঁড়িয়ে সূর্যসন্তানদের আশীর্বাদ দিয়ে যাচ্ছেন আজও, সেই নিঃশঙ্কচিত্ত বীরের মতো, যিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের আরেকবার মুক্তিযুদ্ধ করতে হবে।
যত দিন যাচ্ছে, আমাদের প্রিয়তম স্বদেশে যেন সে দিনই ঘনিয়ে আসছে। মুক্তিযুদ্ধ আজও অসমাপ্ত। তাই মুক্ত স্বদেশেও আমরা আজ উপেক্ষিত। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা মুখে বলে আমরা বহুজনই সেই মহতী চেতনাবোধকে কলঙ্কিত করছি। আর মুক্তিযুদ্ধের অর্জন দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব তুলে দিচ্ছি বিরোধী অপশক্তির হাতে। আমাদের অবহেলা আর নির্লিপ্ততা বাংলাদেশের অভ্যুদয়বিরোধী চিহ্নিত অপশক্তিকেই প্রশ্রয় দিয়েছে নিষ্ঠুরভাবে। সহিংসতার নির্মমতা আমাদের যখন ক্ষতবিক্ষত করতে উদ্যত, তখনই তাহেরের সেই অমরবাণী 'মুক্তিযোদ্ধাদের দ্বিতীয়বার লড়তে হবে' কানে বাজে।
বাংলা মায়ের দুরন্ত দামাল ছেলে অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল আবু তাহের জীবনের যে জয়গান গেয়ে ফাঁসির দড়ি গলায় পরেছিলেন, আজ তাই বুঝি ক্রমে প্রচণ্ড হয়ে বাজছে দেশবাসীর সামনে। মুক্তিযুদ্ধ শেষে বিধ্বস্ত দেশকে গড়ে তোলার যে দায়িত্ব বর্তায় মুক্তিফৌজের ওপর, দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধা আবু তাহের সে দায়িত্বই মাথায় তুলে নিয়ে মুক্তিবাহিনীকে যথার্থই মুক্তিসেনা দলে পরিণত করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী হয়েও জিয়া নিজেকে 'সর্বেসর্বা' ভাবনার প্রয়াসে আত্মমগ্ন হয়ে স্বৈরমানসিকতায় ডুবে গিয়ে খলনায়কেরই ভূমিকা পালন করে গেছেন। আর কর্নেল তাহের বলেছিলেন, 'নিঃশঙ্কচিত্তের চেয়ে জীবনে আর বড় কোনো সম্পদ নেই।'
আজ যখন সম্মুখসমরে আমরা প্রতিক্রিয়ার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে চাইছি দেশবাসী, তখন তাহেরের জীবনে উচ্চারিত দুটি বাক্য আমাদের বলছে, কোন পথে এগোতে হবে। তার সেই অমরবাণী মুক্তিযোদ্ধাদেগু 'আরেকবার অস্ত্র হাতে তুলে নিতে হবে' আজ যেন বস্তুতই সত্য হয়ে ফুটে উঠেছে। সাম্রাজ্যবাদী পরাশক্তির আহ্লাদে লালিত মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক অপশক্তির আস্ফালন আমাদের বিরুদ্ধে সহিংসতা আর সন্ত্রাসের যে নৃশংসতা এনে দিয়েছে জীবনে, তাকে প্রতিহত করতে হলে তাহেরের সেই নির্দেশকেই পালন করতে হবে।
মুক্তিযুদ্ধে সার্বক্ষণিক উচ্চারিত স্লোগান চারটির একটি 'ধর্মনিরপেক্ষতা' রাষ্ট্রেরই মূল স্তম্ভ হিসেবে চার মূলনীতিতে পরিণত হয়েছিল। এ স্লোগানেই লাখো শহীদের প্রাণ উৎসর্গ হয়েছিল। তবু আমরা বাংলার মানুষ আমাদের ঐতিহ্য-সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি এবং ধর্মনিরপেক্ষতাকে কোনো দিন ভুলতে পারিনি। কিন্তু ২০০৮ সালে জনমানুষের বিপুল ভোটে যখন মহাজোট সরকার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নিল তিন-চতুর্থাংশ আসনের শক্তি নিয়ে, তখন কী করে বিসমিল্লাহ, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ও ধর্মীয় রাজনীতির অনুমোদন দেওয়া হলো '৭২-এর সংবিধান পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে?
এমনই বিপন্নতায় যখন আমরা, তখনই কর্নেল তাহেরের ঐতিহাসিক অমোঘ বাণী নির্দেশ হয়ে দেখা দিয়েছে_ মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত বাংলাদেশ, যার অন্যতম স্লোগান ও ঐতিহ্য হলো 'ধর্মনিরপেক্ষতা', তাকে যদি বস্তুতই বহাল রাখা হয়ে থাকে মূলনীতি হিসেবে, তবে তাকে প্রতিহত করার দায়িত্ব দেশবাসীর, যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় যথার্থই বিশ্বাস করেন।
আজ কর্নেল তাহেরকে মনে পড়ছে তার এই ৩৫তম মৃত্যুবার্ষিকীতে_ হে মহান মুক্তিযোদ্ধা, আদর্শের সৈনিক, কালের নির্মম প্রবাহে আমরাও 'জেনে-শুনে বিষপান' করেছি। এ বিষ নামাতে একমাত্র তোমার প্রদর্শিত পথেই চলতে হবে সত্যিকার মুক্তিযোদ্ধাদের। অর্থাৎ মুক্তিযোদ্ধাদের আরেকবার লড়তে হবে। আমরা তো মানুষে বিশ্বাস করি। মানুষই প্রধান শক্তি। তাদের সংগঠিত করতে হবে।

কামাল লোহানী : সাস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও সাবেক মহাপরিচালক, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী
 

No comments

Powered by Blogger.