শোকে-ক্ষোভে চিরবিদায়

‘আমার মায়েরে য্যামনে ঘাড় মটকে, পা ভাইঙে কার্টনে ঢুকাইছে; আমি ওগো ত্যামন মৃত্যু চাই।’ বিলাপ করে কথাগুলো বলছিলেন রুনা বেগম। ছয় দিন ধরে কাঁদতে কাঁদতে তাঁর চোখে পানি নেই। গত বুধবার নিখোঁজ হওয়া তাঁর ছোট মেয়ে জান্নাতুল ফেরদৌসের লাশ মিলেছে ট্রেনের বগিতে কাগজের কার্টনের ভেতরে।

বুধবার গভীর রাতে জামালপুর স্টেশনে ঢাকা থেকে যাওয়া ব্রহ্মপুত্র এক্সপ্রেস ট্রেনের বগিতে ওই কার্টনটি পাওয়া যায়। বৃহস্পতিবার বিকেলে শিশুটির লাশ বেওয়ারিশ হিসেবে জামালপুর পৌর কবরস্থানে দাফন করা হয়। এরপর আদালতের নির্দেশে গতকাল সোমবার ওই কবরস্থান থেকে তার লাশ তুলে ঢাকায় আনা হয়। সন্ধ্যায় লাশ ঢাকার কাওলা আমবাগ কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। দাফনের সময় এলাকায় মানুষের ঢল নামে। সবাই হত্যাকারীদের ফাঁসি দাবি করে।
গতকাল সন্ধ্যায় নিহত জান্নাতুল ফেরদৌসদের আশকোনার ভাড়া বাসায় গিয়ে দেখা যায় মানুষের ভিড়। মেয়েটির মা রুনা বেগম বিছানায় বসে আছেন। ছোট বোনকে দাফন করে ফিরে এলেন বড় ভাই কামরুজ্জামান। তাঁকে জড়িয়ে ধরে মা আবেগাপ্লুত হয়ে বলতে থাকেন, ‘বাবা রে, বোনডারে তো ফিরায়া আনতি পারলি না।’ মায়ের চোখে পানি নেই। শুধু ক্ষোভ। তিনি বলেন, ‘বুধবার বিকেল পাঁচটার দিকে জান্নাতুলের হাতে কয়েকটি চকলেট আর ১৫ টাকা দেখে ধমক দিয়ে বলি, এগুলো কে দিয়েছে? জান্নাতুল বলে, চারতলার আরিফ তাকে কিনতে দিয়েছে। আমি ধমক দিয়ে বলি, যা, তাড়াতাড়ি দিয়ে আয়। আর পাঁচতলার ছাদ থেকে কাপড় নামিয়ে আনিস। জান্নাতুল ছাদ থেকে কাপড়গুলো এনে রেখেছে ঠিকই। কিন্তু এর পর থেকে সে লাপাত্তা।’
রুনা বেগম জানান, সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে তিনি মেয়ের খোঁজে যান চারতলায় আরিফের ফ্ল্যাটে। অপরিচিত দুই যুবক দরজা সামান্য ফাঁকা করে তাঁকে জানিয়ে দেন, জান্নাতুল এখানে নেই। এরপর বিভিন্ন জায়গায় খুঁজেও মেয়েকে না পেয়ে দক্ষিণখান থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন জান্নাতুলের বাবা উত্তরা মডেল স্কুলের শিক্ষক মোশাররফ হোসেন। রুনা বেগম বলেন, ‘বুধবার সারা রাইত দরজা খুইলে বইসা ছিলাম। যদি আমার মায় আসে। কিন্তু শয়তানগুলা আমার মায়েরে সন্ধ্যার ট্রেনেই তুইলে দিছিল।’
শুক্রবার পত্রিকার সংবাদ ও ছবি দেখে জান্নাতুল ফেরদৌসের লাশ শনাক্ত করে জামালপুর রেলওয়ে থানার পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করেন স্বজনেরা। শুক্রবার রাতেই রেলওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) খন্দকার শাকের আহমেদের নেতৃত্বে পুলিশের একটি দল ঢাকায় এসে দুজনকে গ্রেপ্তার করে। তাঁরা হলেন বাড়ির মালিকের ছেলে কাজী মহিউদ্দিন মোহন (২৮) ও চারতলার ভাড়াটে আরিফ বিল্লাহ (২৫)।
ওসি শাকের আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, পলিথিনে পেঁচিয়ে শিশুটির লাশ জোড়া লাগানো দুটি কার্টনের ভেতরে ঢোকানো হয়েছিল। চাপ দিয়ে ঘাড় ভেঙে বুকের কাছে আনা হয়েছে, পা দুটি শিশুটিরই সালোয়ার দিয়ে বেঁধে ঘাড়ের ওপরে ওঠানো হয়েছে, মুখও ছিল বাঁধা। মৃত্যুর আগে শিশুটিকে ধর্ষণ করা হয়েছে।
ওসি বলেন, আরিফের ফ্ল্যাটে গিয়ে চকলেট, কার্টনের ওপরে লেখার সাইন পেন, পলিথিন, কাগজের টুকরো পাওয়া যায়। এতে পুলিশ নিশ্চিত হয়, ঘটনার সঙ্গে আরিফ বিল্লাহ জড়িত ছিলেন। এরপর পুলিশ ওই বাড়ির মালিকের ছেলে আরিফের বন্ধু মোহনকেও গ্রেপ্তার করে। ওসি জানান, তাঁদের এখনো জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়নি। তাঁদের ১১ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আদালতে আবেদন করা হয়েছে। আগামীকাল বুধবার রিমান্ডের শুনানি হবে।

No comments

Powered by Blogger.