মিনারের শেষ চিঠি by আদিত্য আরাফাত

গাদাখানেক ঘুমের ট্যাবলেট খেয়ে নিজেকে হত্যা করেছেন সাংবাদিক মিনার মাহমুদ। মৃত্যুর আগের প্রতিটি মুহূর্ত ছিলেন সচেতন। জীবনের যত বেদনার স্মৃতি মৃত্যুর পূর্বক্ষণটিতে ভর করে মিনার মাহমুদের ওপর। যা তাকে আরও মৃত্যুর দিকে টেনে নিয়ে যায়। সচেতনভাবেই তিনি স্ট্রিপ ছিড়ে অনেকগুলো ঘুমের ট্যাবলেট খান।

জীবনের শেষ চিঠিতে সেসব কথাই লিখে গেছেন মিনার মাহমুদ। আশির দশকের আলোড়ন তোলা সাপ্তাহিক বিচিন্তার সম্পাদক মিনার মাহমুদ ২৯ মার্চ আত্মহননের পথ বেছে নেন। রাজধানীর খিলক্ষেতে হোটেল রিজেন্সির একটি কক্ষে তার মরদেহ পাওয়া যায়। মৃত্যুর আগে স্ত্রী লাজুক লতাকে লিখে যান তার শেষ চিঠি। মিনার মাহমুদের সেই চিঠি অনেক গণমাধ্যমে আংশিক, খণ্ডিত এবং কোথাও বিকৃতভাবেও প্রকাশিত হয়েছে। সদ্য প্রয়াত এ সাংবাদিকের হুবহু চিঠিটি নিয়ে কৌতুহল রয়েছে অনেক পাঠকের। ৬৮২ শব্দের চিঠিটি সংগ্রহ করেছেন বাংলানিউজের স্টাফ করেসপন্ডেন্ট আদিত্য আরাফাত। কৌতুহলী পাঠকদের জন্য মিনার মাহমুদের চিঠিটি কোনো ধরনের সম্পাদনা ছাড়া হুবহু প্রকাশ করা হলো।
লাজুক,
আমার এই ৫৩ বছর বয়সী জীবনে অনেক অনেক মেয়েকে দেখেছি। কিন্তু তোমার উদাহরণের বাস্তব ব্যক্তিকে দেখিনি। অবাক হই, সৃষ্টিকর্তা কেন তোমার মতো মানুষকে পৃথিবীতে প্রেরণ করলেন।

সকালে বাসা থেকে বের হওয়ার সময় আমি জানতাম-কোথায় যাচ্ছি, কি করতে যাচ্ছি। বুক ভেঙে কান্না আসছিল। চেষ্টা করেও চেপে রাখতে পারলাম না। এতদিনের চেনাজানা এ বাড়িতে আর ফিরব না। আর দেখা হবে না তোমার সঙ্গে । চেপে রাখা মুখ ঠেলে কান্না এলো। নিজেকে খুন করে ফেলার এ আয়োজনে সবচেয়ে প্রতিবন্ধকতা ছিলে তুমি।

আমার মৃতদেহের ওপর আছড়ে পড়ে তোমার কান্না-ভাবতেই সিদ্বান্ত পরিবর্তন করি। আবার সিদ্বান্ত নিই। লাজুক তুমি এখন নি:সঙ্গ, একাকী।

তোমার মনে প্রথম প্রশ্ন আসবে আমি কেন আত্মহত্যা করলাম? গতকাল দৈনিক আজকের প্রত্যাশা থেকে রিজাইন করেছি বলে? মোটেও না, আসলে নির্দিষ্ট কোন কারণ নেই। কারও প্রতি আমার কোন অভিযোগ নেই। অভিযোগ আছে আমার বাংলাদেশের সার্বিক সমাজ ব্যবস্থায়।

সাংবাদিকতা আমার জীবন বদলে দিয়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স শেষ করলেও মাস্টার্স শেষ করতে পারিনি সাংবাদিকতা সূত্রে মাস্তানদের হুমকির কারণে। ক্যাম্পাস ছিল আমার জন্য নিষিদ্ধ এলাকা। সাপ্তাহিক বিচিত্রা দিয়ে শুরু করেছিলাম। পদত্যাগে বাধ্য করা হলো আমাকে দুর্নীতির অভিযোগে।

লতা হোসেন আমার জীবনের সবচেয়ে আত্মার বন্ধু। তার সহযোগিতায় বিচিন্তা বের করলাম। মোটামুটি সফল। নিষিদ্ধ হলো কিছুদিন পরে। জেল জীবন। তিন বছর বেকার। এরপর এলেন বাংলাদেশের গণতন্ত্রের একমাত্র সোলএজেন্ট খালেদা জিয়া। বিচিত্রা সম্পাদকের বিরুদ্ধে মামলার পর মামলা। তখন সাপ্তাহিক কার্যদিবসের প্রতিটি দিনই হাজির থাকতে হতো কোর্টপাড়ায়। বুঝতে পারছিলাম স্থায়ীভাবে জেল জীবন দেখানোর পরিকল্পনা আছে গণতানি্ত্রক সরকারের। উপায়হীন আমি পালিয়ে গেলাম আমেরিকায়। বিচিত্রা সংশ্লিষ্ট কর্মীরা যাতে বেকার না হয়, বিচিন্তা হস্তান্তর করে গেলাম ইউএনবি এনায়েতুল্লাহ খানের কাছে।

১৮ বছর দাসত্বের জীবন কাটিয়েছি আমেরিকায়। ১৮ হাজার প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছি, কত কোটি টাকায় বিক্রি করেছ বিচিত্রা? সবাই শুধু বিকৃত মানসিকতার একটি বিষয়ই বিবেচনা করেছে। কিন্তু দেশে ফিরে ২০১০ সালে যখন এনায়েতুল্লাহ খানের কাছ থেকে বিচিন্তা ফিরিয়ে নেই একজনও প্রশ্ন করেনি কত টাকায় ফেরত নিলাম।

লাজুক, সাংবাদিকতা পেশায় মেধাহীন আমি শ্রমই দিয়েছি। নিউজপ্রিন্টের ওপর বলপয়েন্ট দিয়ে ক্রমাগত লিখে যাওয়া- হাত ফুলে উঠতো, লাইট বাল্বের উত্তাপ দিয়ে সেক দেওয়া। আবার লেখা। নিজের কাছে প্রশ্ন করি, সাংবাদিকতা পেশার নাম বিনিয়োগ করে কখনও আমি কি কোন সুবিধা নিয়েছি? নিজের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে এখন চার হাজার টাকা। কোন বাড়ি অথবা দেশের কোথাও এক ইঞ্চি জমি নেই। আক্ষরিক অর্থে সর্বহারা। একটা সময়ে বাংলাদেশকে আমি দেখেছি পর্বতের উচ্চতা থেকে। নিজের জন্য সম্পদ মাথায় আসেনি।

যে কথাটা বলতে চাইনি- নিউ নিউইয়র্কে আমার জীবন-যাপন ছিল আত্মকেন্দ্রিক। বিচ্ছিন্ন ছিলাম দেশ এবং বাংলা ভাষা থেকে। নেটলাইনে কৃষ্ণকলির গানগুলো শুনতাম, এমন স্থির, কনফিডেন্স। বাংলাদেশ আবার বিজয় হয়ে আসে জীবনে। আর ঠিক এই সময়ে তুমি অপরাজিতা। নেটলাইনে পরিচয়, শুনি তোমার অসাধারণ জীবন্ত গান। সিদ্ধান্ত ছিল বাংলাদেশে আমার মৃতদেহও যাবে না। তাই শরীরের সবকিছু অগ্রিম দান করে রেখেছিলাম হাসপাতালে। তুমি বদলে দিলে সবকিছু।

লাজুক, আমি সিদ্ধান্ত নিই, ফিরে যাব দেশে। প্রথম দেখা হয় তোমার সঙ্গে বিমানবন্দরে। দীর্ঘ দেহী, শ্যামলা। আশ্চর্য চোখ তোমার। কথা বলে চোখের ভাষায়। তোমার আমার প্রথম দেখা, বিয়েসহ সব সিদ্ধান্ত ইতিমধ্যে আমরা চূড়ান্ত করে ফেলেছি। তুমি দাঁড়িয়েছিলে চেনা অথবা অচেনা মানুষটার জন্য। আমি তোমাকে দেখি সবটুকু। চারদিকে কোন কিছু কেয়ার না করে কাছে টেনে বুকে নেওয়ার ইচ্ছে হয় তোমাকে।

এখন শোনো লাজুক। আমি সর্বহারা। ‘কিছু নেই` একজন মানুষ। বিচিত্রা আবার প্রকাশ করেছিলাম, পাঠকরা নেইনি। পরে একটি চাকরির জন্য কত চেনা অচেনা পত্রিকা মিডিয়ায় চেষ্টা করেছি কেউ নেইনি। অবাক হয়েছেন নিয়মিত লেখা এক সাংবাদিক। হাজিরা দেব, নিয়মিত লিখব, মাস শেষে একটা বেতন কোথাও হয়নি। কাউকে অভিযোগ করিনি।

লাজুক, বেশ কয়েক দিন ধরে চিন্তা করেছি- মৃত্যু। তারপর কোথায়? এরপর কি জীবনের আর কোন ফিরে পাওয়া। খুব অবাক হয়েছি, বাংলাদেশের কোন দৈনিক পত্রিকায় আমার স্থান হলো না।
বিচিত্রা শুরু করেছিলাম একদল তরুন নিয়ে। বিরাট এক ঝুঁকি। কোন পত্রিকা নেয় না। আমি নিয়ে নিয়েছিলাম। কারণ নতুন সাংবাদিক আনতে। খুব, খুব কষ্ট পেয়েছি, অপমানিত হয়েছি। যুগকে জিজ্ঞাসা করো, বাংলাদেশে সাংবাদিকতার নতুন ধারা যারা তৈরি করেছে তাদের একজন আমিও।
আমি মিনার, যখন আমেরিকা থেকে যখন দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত নিই, শুনে সবাই অবাক। প্রশ্ন করে, বাংলাদেশে কেন ফিরে যাচ্ছি। আমি অবাক হই, নিজের দেশে ফিরে যাচ্ছি - এটা নিয়ে প্রশ্ন কেন? কোথায় যাব আমি তাহলে?

লাজুক আমি নিজেকে খুন করে ফেললাম। কোন বিকল্প না পেয়ে। কাগজপত্রে আমি একজন আমেরিকাবাসী এখন। তুমি যেতে চাওনা। বিদায় তোমাকে। তুমি চাওনি আমি আমেরিকা যাইনি। দয়া করে বেঁচে থেকো লাজুক। প্লিজ,প্লিজ, প্লিজ, প্লিজ,প্লিজ, প্লিজ, প্লিজ,প্লিজ, প্লিজ, প্লিজ,প্লিজ, প্লিজ, প্লিজ,প্লিজ, প্লিজ, প্লিজ,প্লিজ, প্লিজ, প্লিজ, আমি এখন ট্যাবলেট খাচ্ছি...।

No comments

Powered by Blogger.