ফি যৌক্তিক হোক, অনিশ্চয়তা কাটুক টেলিকম খাতে-লাইসেন্স নবায়ন নীতিমালা

বাংলাদেশে মুষ্টিমেয় যে কয়েকটি শিল্প খাত দ্রুত বিকাশ লাভ করেছে এবং বিপুল পরিমাণ বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে, টেলিযোগাযোগ খাত এর মধ্যে অগ্রগণ্য। এই খাতের ক্রমাগত সমৃদ্ধি জাতীয় অর্থনীতিতে যেমন গতিসঞ্চার করেছে, তেমনি লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করেছে।


সম্প্রতি মুঠোফোন কোম্পানিগুলো লাইসেন্স নবায়নের ক্ষেত্রে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে সরকারের নানা বিধিনিষেধের কারণে। গত জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) মুঠোফোন কোম্পানিগুলোর লাইসেন্স নবায়নের জন্য একটি খসড়া নীতিমালা প্রকাশ করে। এতে তরঙ্গমূল্য ধার্য হয়েছে ১৪ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে শুধু গ্রামীণফোনকেই সাত হাজার কোটি টাকার বেশি পরিশোধ করতে হবে। বাংলালিংক ও রবিকে তিন হাজার কোটি করে এবং সিটিসেলকে এক হাজার কোটি টাকা দিতে হবে। লাইসেন্স নবায়নের জন্য কেন এত বিপুল পরিমাণ অর্থ গুনতে হবে, তার কোনো ব্যাখ্যা নেই। আবার তরঙ্গের এককপ্রতি দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রেও বৈষম্য সৃষ্টি করা হয়েছে। এই অর্থের জোগান কোথা থেকে আসবে, তাও চিন্তার বিষয়। বাংলাদেশে কোনো একক ব্যাংকের পক্ষে এই পরিমাণ ঋণও দেওয়া সম্ভব নয়; এমনকি কনসোর্টিয়াম করেও দেওয়া যাবে না বলেই বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
২০০৫ সালে পাকিস্তানে দ্বিতীয় প্রজন্মের মুঠোফোন সেবাদাতাদের লাইসেন্স নবায়ন করা হয়, যার নবায়ন ফি ২৯ কোটি ১০ লাখ টাকা। শ্রীলঙ্কায় এর পরিমাণ মাত্র ৫০ লাখ টাকা। পার্থক্যটি লক্ষণীয়। খসড়া নীতিমালায় অনেক বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যা লাইসেন্সের শর্ত হতে পারে না। এ ছাড়া নীতিমালায় এমন কিছু শর্ত আছে, যা কেবল এ চারটি কোম্পানির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, বাকিগুলোর ক্ষেত্রে নয়। এটি বৈষম্যমূলক।
মুঠোফোন কোম্পানিগুলো এমনিতেই সামাজিক দায়বদ্ধতা পালন করে থাকে। এটি শর্ত হিসেবে জুড়ে দেওয়ার যুক্তি নেই। নীতিমালা অনুযায়ী কোম্পানির নিয়োজিত পরিবেশক, খুচরা বিক্রেতা ও বেসামরিক অংশীদারদের ব্যাপারে বিটিআরসির পূর্বানুমতি নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। প্রতিটি বিষয়েই সরকারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা আছে। নিবন্ধনে ভুল তথ্য গেলে তার দায়দায়িত্বও অপারেটরের ওপর চাপানোও ঠিক নয়।
নীতিমালায়শেয়ারবাজারে ৩০ শতাংশ প্রাথমিক শেয়ার ছাড়ার যে বিধান রাখা হয়েছে, তাও যৌক্তিক নয়। এখনো পর্যন্ত একটি ছাড়া অন্য সব কোম্পানিই লোকসান দিচ্ছে। অলাভজনক কোম্পানির শেয়ার বিক্রির অনুমতি কি এসইসি দেবে? বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, ইন্টারনেটের সংযোগ ১০ শতাংশ বাড়লে তা দেশের জাতীয় আয়ে গড়ে ১ দশমিক ২ শতাংশ অবদান রাখবে। এখনো পর্যন্ত বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১ শতাংশ। এর ৯৪ শতাংশই মুঠোফোন-নির্ভর। সে ক্ষেত্রে সর্বত্র নেটওয়ার্কের সুযোগ থাকায় তৃতীয় প্রজন্মের টেলিযোগাযোগ সেবার সুবর্ণ সুযোগ রয়েছে। থ্রিজি প্রযুক্তিতে উত্তরণ হলে রাতারাতি সারা দেশে ব্রডব্যান্ড সেবা পৌঁছানো সম্ভব। কিন্তু টুজিতে উচ্চহারে লাইসেন্স ফি নেওয়া হলে কোম্পানিগুলো থ্রিজিতে বিনিয়োগের অর্থ জোগান দিতে পারবে না।
বিশ্বব্যাংকসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাও মাত্রাতিরিক্ত লাইসেন্স নবায়ন ফির বিরোধী। এতে এ খাতে বিনিয়োগ কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে বিষয়টি সরকার ভেবে দেখবে আশা করি। মুঠোফোন কোম্পানিগুলোর সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে নবায়ন ফি নির্ধারণের ব্যাপারে বিটিআরসি একটি যৌক্তিক সিদ্ধান্তে আসবে বলেইআমাদের প্রত্যাশা।

No comments

Powered by Blogger.