নারী উন্নয়ন নীতি-ছেলেসন্তান মেয়েসন্তান by মশিউল আলম

গত সাধারণ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ তার নির্বাচনী ইশতেহারে অঙ্গীকার করেছিল, দলটি ক্ষমতায় গেলে ১৯৯৭ সালে প্রণীত নারী উন্নয়ন নীতি পুনর্বহাল করবে। মহাজোটের অন্য শরিকদের সঙ্গে নিয়ে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ করেছে।


তার দুই বছর দুই মাস পর গত মার্চে তারা নারী উন্নয়ন নীতি ২০১১ ঘোষণা করেছে। দেখা যাচ্ছে, এই নতুন নীতিতে ১৯৯৭ সালের নারীনীতির একটি খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। সেই নীতিতে ‘উর্পাজনের সুযোগ, সম্পত্তির উত্তরাধিকার, ভূমির ওপর অধিকারের ক্ষেত্রে নারীকে পূর্ণ ও সমান সুযোগ দেওয়া’র কথা ছিল। নতুন ঘোষিত নারীনীতিতে নানা ক্ষেত্রে নারীর সমানাধিকারের কথা বলা হয়েছে, কিন্তু সম্পত্তির উত্তরাধিকারে সমানাধিকারের কথা উল্লেখ করা হয়নি।
তাই অনেকে বলছেন, আওয়ামী লীগ সরকার তার অন্যতম নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণ করেনি। নারী অধিকার নেত্রী হামিদা হোসেন প্রথম আলোয় এ বিষয়ে একটি নিবন্ধে সে কথা স্পষ্ট ভাষায় লিখেছেন। গত মঙ্গলবার নারী অধিকার সংগঠন উইমেন ফর উইমেন আয়োজিত নারীনীতি বাস্তবায়নে করণীয়বিষয়ক এক আলোচনা সভায় বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা সুলতানা কামালও একই ধরনের মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছেন, আওয়ামী লীগ ১৯৯৭ সালের নারীনীতি পুনর্বহাল করবে—এই নির্বাচনী অঙ্গীকারের প্রতি আস্থা রেখে জনগণ তাদের ভোট দিয়েছে। কিন্তু এখন নারীনীতি নিয়ে সরকারের কণ্ঠস্বর নিম্নগামী। ‘সরকার করুণভাবে ডিফেন্সিভ’, মানে আত্মরক্ষামূলক আচরণ করছে। তিনি আরও মন্তব্য করেছেন, সরকারের ধর্মভিত্তিক রাজনীতি করার কোনো প্রয়োজন নেই।
তিনি সম্ভবত বলতে চেয়েছেন, আওয়ামী লীগের ধর্মভিত্তিক রাজনীতি করার প্রয়োজন নেই। কিন্তু দলটির জন্য বাস্তব পরিহাস হচ্ছে, ধর্ম প্রসঙ্গে তাদের কখনো কখনো বেশ বেকায়দায় পড়তে হয়। বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে আমরা সেটা দেখতে পাচ্ছি। ধর্মের কারণেই সেখানে স্ববিরোধী জোড়াতালি লক্ষ করা যাচ্ছে। নারীনীতির বিষয়ে এই সরকারের মুশকিল হয়েছে দ্বিমুখী। বাংলাদেশ দুটি ধারা বাদ রেখে সিডও সনদে স্বাক্ষর করেছে। এই আন্তর্জাতিক ফোরামের চাপ হলো, তাদের বিধানগুলো বাংলাদেশ মেনে চলুক। সব ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের সমান অধিকার নিশ্চিত করার তাগিদ সে কারণেই। কিন্তু আওয়ামী লীগ একটি জনভিত্তিক রাজনৈতিক দল, জনসমর্থনই তাদের মূল শক্তি। তারা এমন কাজ করতে চায় না যাতে জনসমর্থন কমে যায়। তাই নতুন নারীনীতিতে সম্পত্তির উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের সমান অধিকারের কথা বলা হয়নি। তবু কিছু ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠী এই নারীনীতিতে যা নেই, তা নিয়ে প্রবল প্রতিবাদ জানাচ্ছে, দেশ অচল করে দেওয়াসহ নানা রকম হুমকি দিচ্ছে। তারা এই প্রচারণা চালাচ্ছে যে, সরকার কোরআনবিরোধী নীতি করেছে। তাদের এমন প্রচারণায় অনেক মানুষ বিভ্রান্ত হচ্ছে।
উইমেন ফর উইমেনের সেদিনের আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য দিয়েছেন মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী শিরীন শারমিন চৌধুরী। সুলতানা কামালের অভিযোগের প্রতিবাদে তিনি বলেছেন, সরকার জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি নিয়ে কোনোভাবেই দুর্বল অবস্থানে নেই। নীতিতে কী আছে, তা না দেখেই যে ধূম্রজাল সৃষ্টি করা হয়েছে, তা দূর করার জন্যই বিভিন্ন ব্যাখ্যা দেওয়া হচ্ছে। এটা সরকারের দুর্বলতা নয়। আমরা লক্ষ করেছি, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীকেও নারীনীতি সম্পর্কে ব্যাখ্যাদানে অংশ নিতে হয়েছে। কিন্তু সিডও কমিটির কাছে সরকারের পক্ষ থেকে কী ব্যাখ্যা দেওয়া হবে, সেটাও একটা বড় প্রশ্ন। এত দিন সরকার বলে এসেছে: আমরা বিষয়টি ‘বিবেচনা করছি’, এবং ‘সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করছি’।
বিষয়টি নিয়ে রাজনীতি চলবে হয়তো আরও কিছুদিন। বিরোধী দলগুলো তো কোনো ইস্যু খুঁজে পাচ্ছে না, যা নিয়ে মাঠ গরম করার কথা ভাবতে পারে। নারীর সমান অধিকারের প্রশ্নটি নিয়ে রাজনীতি করা উচিত নয়। জনসংখ্যার অর্ধেকই নারী; নিজেদের অধিকার সম্পর্কে তাঁরা কী ভাবেন, কী চান, কী চান না—তা জানা ও বোঝার চেষ্টা কোনো পক্ষেই নেই। এক পক্ষ তো মনে করে, মেয়েরা কী চায়, কী চায় না সেটা কোনো বিষয় নয়। বিষয় হচ্ছে ধর্মে যেভাবে বলা আছে, সেভাবেই উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া সম্পত্তি ভাগবাটোয়ারা করতে হবে। এবং এই আলোচনায় আছেন শুধু মুসলমান নারী। এই দেশে যে অন্য ধর্মাবলম্বী নারীরাও আছেন, তাঁদেরও যে অধিকারের প্রশ্ন আছে, তাঁরাও যে এই দেশের পরিপূর্ণ নাগরিক—এসব সত্য যেন সবাই বিস্মৃত হয়েছেন। জীবনের সর্বক্ষেত্রে ধর্ম, বর্ণ, নৃতাত্ত্বিক পরিচয়নির্বিশেষে সব নারীর সমান অধিকার প্রতিষ্ঠার পক্ষে রাষ্ট্রের নীতিগত অবস্থান ব্যক্ত করা একটি আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের পক্ষে স্বাভাবিক—এই বোধের ঘাটতি যদি সমাজে প্রকট হয়, তবে সেই সমাজের স্বভাব ট্রাইবাল। আমরা হয়তো এখনো সভ্যতার সেই ধাপেই রয়ে গেছি।
কিন্তু ট্রাইবাল সমাজও তো এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে না। বিধিবিধান দিয়ে না হোক, রীতি-প্রথার ক্রমপরিবর্তনের মধ্য দিয়ে সমাজ সামনে এগোয়। ছেলেসন্তান ও মেয়েসন্তান সম্পর্কে বিভিন্ন সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি অনেক বদলে গেছে। একসময় মেয়েসন্তানের জন্ম অনাকাঙ্ক্ষিত ছিল; কোনো কোনো সমাজে তাদের জন্মের পরপরই জীবন্ত কবর দেওয়া হতো। কিন্তু এখন আর সে রকম কিছু কল্পনাও করা যায় না। আমাদের এই সমাজেই একটা সময় ছিল যখন অনেক মা-বাবা মেয়েসন্তানদের বিদ্যালয়ে পাঠাতেন না। পড়াশোনা করবে শুধু ছেলেরা, চাকরিবাকরি আয়-উপার্জন করবে শুধু ছেলেরা, মেয়েদের ভূমিকা সন্তান লালন-পালন আর রান্নাবান্নার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে—এমন দৃষ্টিভঙ্গি অনেক বদলে গেছে। মেয়েদের মেধা ছেলেদের চেয়ে কম নয়, এর প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে লেখাপড়ায়, বিজ্ঞান-প্রযুক্তিতে, গবেষণায়, ব্যবসা-বাণিজ্যে, ব্যবস্থাপনাসহ আরও নানা ক্ষেত্রে। ডাক্তারি, শিক্ষকতা ইত্যাদি পেশায় ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা বেশি ভালো করছে—এমন তথ্যও মিলেছে অনেক গবেষণায়। নারীর প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির এসব বিবর্তন ঘটে চলেছে সমাজ বিকাশের স্বাভাবিক নিয়মে। এবং এই প্রক্রিয়া সব সময়ই সচল থাকবে।
বিভিন্ন বয়সের কয়েকজন নারীর সঙ্গে কথা হলো বাবার সম্পত্তির ভাগবাটোয়ারা প্রসঙ্গে। কেউ বললেন, ভাইয়ের সমান ভাগ তিনি চান। কেউ বললেন, নিজের ভাগটা তিনি ভাইকে দিয়ে দেবেন। কেউ বললেন, সমান ভাগ পেলে মন্দ হতো না, কিন্তু নিয়ম যদি না থাকে, তাহলে আর কী করা? কেউ বললেন, তাঁর পাওয়ার কথা ভাইয়ের অর্ধেক; কিন্তু তা থেকেও তাঁকে বঞ্চিত করা হয়েছে। কিন্তু তিনি এর জন্য মামলা-মোকদ্দমায় যেতে উৎসাহ পাননি। এমন কিছু পরিবারের কথা জানি, যেখানে ভাইবোনেরা মা-বাবার সম্পত্তি ভাগ করে নিয়েছেন সমান ভাগে। বাবা, বা মা যদি স্থির করেন যে তাঁর সম্পত্তি তিনি ছেলেসন্তান ও মেয়েসন্তানদের মধ্যে সমান ভাগে ভাগ করে দেবেন, এবং ভাইয়েরা যদি স্থির করেন, মা ও বাবার সম্পত্তির যে ভাগ তিনি পাবেন, বোনকেও তার সমান ভাগ দেবেন—এতে সমস্যা কী। আমাদের আদর্শ হওয়া উচিত সেই সব পরিবার, যারা এভাবে ছেলেসন্তান ও মেয়েসন্তানের মধ্যে এমন সমতা সৃষ্টি করছে। নারী ও পুরুষের মধ্যে সামগ্রিক সমতা সৃষ্টির মধ্য দিয়ে একটি সুখী, সুন্দর, স্নেহমমতায় ভরা সমাজ গড়ে তোলার পথ এই পরিবারগুলো দেখাচ্ছে। উত্তরাধিকার সম্পত্তি ভাগবাটোয়ারায় ছেলেসন্তান ও মেয়েসন্তানের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা নারীনীতিতে যুক্ত করতে যাঁরা ধর্মীয় কারণে দ্বিধান্বিত, তারা নিজেরা, অর্থাৎ এই সরকার, সরকারি দল ও মহাজোটের সব শরিক দলের নেতা-কর্মীরা নিজেদের পরিবারে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারেন। প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্যরা সবার আগে এগিয়ে আসুন। সেই সঙ্গে নারী অধিকারের পক্ষে আন্দোলনরত সব সংগঠন এবং প্রগতিশীল নাগরিক সমাজের সবাই, প্রতিটি পরিবার যদি অঙ্গীকার করে যে তারা নিজেদের ছেলেসন্তান ও মেয়েসন্তানের মধ্যে সব সম্পত্তি সমান ভাগে ভাগ করে দেবে, এবং বাস্তবে তা-ই করে, তাহলে আক্ষরিক অর্থে নয়, বাস্তবিক জীবনেই নারী-পুরুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠার কাজ অনেকটা হয়ে যায়।
মশিউল আলম: সাংবাদিক।
mashiul.alam@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.