ভারত-পশ্চিমবঙ্গে ‘পরিবর্তন’ না ‘প্রত্যাবর্তন’? by মিজানুর রহমান খান

রোববার অপরাহ্নে মিট দ্য প্রেসে মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য আগের দিন পশ্চিমবঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের দেওয়া মন্তব্যে উষ্মা প্রকাশ করেন। সেটা অপ্রত্যাশিত ছিল না। তিনিও কম যাননি। তত্ত্বাবধায়ক মুখ্যমন্ত্রী হয়ে রাজ্যবাসীকে শুধু কম দামে চালই নয়, আরও তিন-চারটি ভোগ্যপণ্য রেশন দেওয়ার অঙ্গীকার করেন।


তাঁকে যখন গণতন্ত্রে বিরোধী দলের ভূমিকা সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয়, তখন তিনি বললেন, বিরোধী দল নিয়ে তিনি আপাতত ভাবছেন না, সরকার নিয়ে ভাবছেন।
মনমোহন সিং শনিবার পশ্চিমবঙ্গে এসে ‘পরিবর্তনের’ কথা বললেন। কলকাতার বাতাসে এখন এই শব্দটিই ভেসে বেড়াচ্ছে। পরিবর্তন না প্রত্যাবর্তন—সেই প্রশ্নটিও জোরালো। পরিবর্তন মানে লালদুর্গের পতন। প্রত্যাবর্তন মানে বুদ্ধদেবের স্বপদে বহাল থাকা। প্রণব মুখার্জি শনিবার মনমোহনের উপস্থিতিতেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে পরবর্তী মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে ঘোষণা দেন। তবে প্রধানমন্ত্রী মনমোহনের কঠোর সমালোচনা স্মরণ করিয়ে দিল দক্ষিণ এশীয় রাজনীতির ঐতিহ্যগত স্ববিরোধিতা।
কলকাতা থেকে যথাক্রমে ১২৫ ও ২৫ কিলোমিটার দূরবর্তী দুটি স্থানে শনিবার বামফ্রন্ট সরকারকে তিনি রাজ্য শাসনে ব্যর্থ বলে ঘোষণা দেন। তিনি আরও বলেন, শুধু তাঁর দল কংগ্রেস ও মমতার তৃণমূলই পশ্চিমবঙ্গে সুশাসন দিতে পারে। শনিবার প্রধানমন্ত্রী কার্যত বুদ্ধদেবের নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট সরকারের সমালোচনায় সোনিয়া গান্ধীর ‘দেউলিয়া’ রাজ্যের অভিমতই পুনর্ব্যক্ত করেন। বামফ্রন্ট অকর্মা। তার আর দরকার নেই। মনমোহনের কথায়, ‘পশ্চিমবঙ্গের রাজস্ব ঘাটতি যেকোনো রাজ্যের চেয়ে বেশি। সাক্ষরতায় ১৮তম অবস্থানে থাকা রাজ্য আরও দুই ধাপ নিচে নামল। মণিপুর ও নাগাল্যান্ডের চেয়েও নিচে নেমেছে। বিনিয়োগকারীরা আস্থা হারিয়েছে।’ ইত্যাদি। কিছুদিন আগে অবশ্য বুদ্ধদেব বলেছিলেন, মি. মনমোহন সিংয়ের ব্যক্তিগত সততা সন্দেহাতীত। তবে তাঁকে ঘিরে থাকা বিশেষ মহল পথভ্রষ্ট। ২৪ এপ্রিল বুদ্ধদেব বলেন, প্রধানমন্ত্রীর কিছু বক্তব্যে তিনি অবাক, তাঁর কথা দুর্ভাগ্যজনক। গুজরাটের মুসলমানেরা পশ্চিমবঙ্গের চেয়ে ভালো আছে—তাঁর এ কথা মেনে নেবে না এই রাজ্যের মানুষ। প্রেসিডেন্সি কলেজের উন্নতির জন্য প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনাবশ্যক। রাজ্য সরকারই এটা পারবে। বুদ্ধদেবের কথায়, ‘রাজ্য সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী যা বলে গেলেন, তা তাঁর মনোভাব নয় বলেই জানি। আমি খারাপভাবে তাঁর সমালোচনা করতে চাই না।’
অশালীন অনিল: অশালীন কথাবার্তার খই ফুটছে। তুইতোকারি চলছে। বিশিষ্ট বাম নেতা অনিল বসু গত শুক্রবার হুগলির আরামবাগে এক অনুষ্ঠানে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে কালো টাকা প্রশ্নে অশ্লীল মন্তব্য করেন। এতে যারপরনাই বিব্রত বাম নেতারা। সব মহলে ধিক্কার। অনিল সবাইকে টেক্কা দেন। বুদ্ধদেব রোববার কৈফিয়ত দেন, কারও মাথা খারাপ হলে ওষুধ দিতে হবে। তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা ঘোষণার পরপরই অনিল অবশ্য গতকাল ক্ষমা চেয়ে বিবৃতি দেন। নেহাত দায় ঠেকে। কোনো অনুশোচনা নেই। তবে এটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। কলকাতার রাজনৈতিক সংলাপ সৌন্দর্য হারিয়েছে।
তৃণমূল নেতারা এ জন্য অনিল বসুকে গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়েছেন। অনিলের বিরুদ্ধে নির্বাচন কমিশন ও জাতীয় মহিলা কমিশনের কাছে অভিযোগ করেছে তৃণমূল। মনমোহন, সোনিয়ার কাছেও বক্তব্যের সিডি যাচ্ছে। অনিল বলেছিলেন, মমতা চেন্নাই ও মুম্বাই থেকে টাকা গ্রহণের প্রস্তাব পান, কিন্তু তিনি তা ফিরিয়ে দেন। তিনি মঞ্চে প্রায় নেচে নেচে তীব্র বিদ্বেষে বলেন, তা তিনি নেবেন কেন? সোনাগাছির (যৌনপল্লি) মেয়েদের ঘরে যখন বড় বাবুরা আসে, তখন তারা ছোট বাবুদের পোঁছে না। মমতা আমেরিকার কাছ থেকে টাকা পাচ্ছেন। তাঁর এখন বড় বাবু জুটে গেছে। তাঁকে বলতে হবে, ৩৪ কোটি টাকা কোথা থেকে এল? কোন ভাতারে (স্বামী) তাঁকে দিল? তাঁর এই বক্তব্য মিডিয়ায় ঝড় বয়।
দমদম থেকে তৃণমূলের তারকাপ্রার্থী অধ্যাপক ব্রাত্য বসু অনিল সম্পর্কে মন্তব্য করেন, ‘তাঁকে চতুষ্পেয় সারমেয় বলতে চাই, কিন্তু বলব না।’ কবি শঙ্খ ঘোষ এক বিবৃতিতে বলেন, ‘অনিলের নীচতায় ও ভয়ংকরতায় আমি স্তম্ভিত। দেশের মানুষ বুঝতে পারলেন, বামদের বহুঘোষিত শুদ্ধিকরণের পর এই হচ্ছে আজ বামফ্রন্টের প্রকৃত মুখচ্ছবি।’ সুচিত্রা ভট্টাচার্য বলেন, এক মহিলার কাছে হার মেনে নিতে পারছে না সিপিএম। শাঁওলি মিত্র অনিলকে উপযুক্ত শিক্ষার জন্য প্রকাশ্য শাস্তির দাবি জানান।
পরিবর্তন: তাঁরা মন খুলে কথা বলছিলেন। দুজন। কথা বলছিলেন এভাবে: ‘এমন সুন্দর নির্বাচন আর দেখিনি। এর আগে তো ভোটই দিতে পারতাম না। লাইনে দাঁড়িয়ে আছি। ভোট দিয়েছে অন্য।’ এক স্থানীয় জ্যেষ্ঠ সিপিআইএম নেতার নাম ধরে বললেন, ‘দেখলাম তিনিও লাইনে দাঁড়িয়ে।’
আমি তাঁদের সঙ্গে বেঞ্চে বসি। কথা বলি। বুঝলাম সিপিআইএমের ডাকসাইটেরা আগে নিয়ম অগ্রাহ্য করতেন। এবারে তা ঘটেনি। রথতলার বিধান দাসের অকপট উচ্চারণ: ‘আগের বিধানসভার নির্বাচনে আমি লাইনে থেকেছি। লালেরা ভোট দিয়ে দিয়েছে। সেটা এবার কেউ চিন্তা করতে পারেনি।’
আমি শনিবার কলকাতা থেকে ৬০ কিলোমিটার দূরের কল্যাণীতে পাঁচটি ভোটকেন্দ্র পরিদর্শন করি। না উৎসব না উত্তেজনা। একেবারে আদর্শ পরিবেশ। সুনসান নীরবতা। বাইরে কোনো জটলা নেই। বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই, এখানে ভোট চলছে। বুথের আশপাশে একাধিক ব্যক্তিকে দাঁড়াতেই দেয়নি কেন্দ্রীয় বাহিনী। এবার রেকর্ডসংখ্যক ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ ভোটার উপস্থিতির জন্য নির্বাচন কমিশনের উন্নত নজরদারি ও কারবাইনধারী কেন্দ্রীয় বাহিনীর সক্রিয়তাই প্রাধান্য পাচ্ছে।
কল্যাণী রেলস্টেশন থেকে পাঁচ কিলোমিটারের বেশি প্রত্যন্ত এলাকার একটি বুথে যাই শনিবার দুপুরে। ৩৪ বছর ধরে সিপিআইএম জয়ী হওয়ার বিষয়টি এবার যে যথেষ্ট চাপের মুখে, তা বাম ভোটাররাও স্বীকার করেন। ঈশ্বরীপুরের দুটি বুথে এক হাজার ৬৮০ ভোটার। মুসলিম ভোট ৩২৫। সকাল সাতটা থেকে দুপুর আড়াইটার মধ্যে সেখানে এক হাজার ২৬৯ ভোট পড়ে।
ভোটপ্রযুক্তি: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শনিবার ইলেকট্রনিক ভোটিং সিস্টেম চালুর কথা বলেছেন। ভোটার পরিচয়পত্রের মতোই এটা হবে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ। পশ্চিমবঙ্গের অভিজ্ঞতা অত্যন্ত সুখকর। শনিবার দক্ষিণবঙ্গের ৫০ আসনের নির্বাচনে মাত্র অল্প কিছু স্থানে ইভিএম কিছুক্ষণের জন্য বিকল হওয়ার ঘটনা ঘটে। প্রযুক্তির ব্যবহার এবার আরও আকর্ষণীয়। বিহারের পর এবারই প্রথম পশ্চিমবঙ্গে ওয়েব ক্যামেরার ব্যবহার শুরু হলো।
আগে দলীয় কর্মীরা ভোট নম্বর লেখা স্লিপ নিয়ে বাড়ি বাড়ি যেতেন। সেটা হাতে নিয়েই তাঁরা আসতেন ভোট দিতে। এবার যেকোনো দলীয় স্লিপ অচল। নির্বাচন কমিশনের নিযুক্ত কর্মীরা স্লিপ পৌঁছে দিয়েছেন। এ জন্য স্লিপপ্রতি কর্মীরা কমিশনের কাছ থেকে পাঁচ টাকা করে পান। আইডি ও স্লিপ দুটিই অপরিহার্য। সেটা না থাকলে ভোট দেওয়া যাবে না।
যান্ত্রিক ভোট এ রকম: ভোট দেওয়ার আগে প্রিসাইডিং কর্মকর্তার কাছে রাখা নিয়ন্ত্রণ ইউনিটে (কন্ট্রোল) ‘বিজি’ বাতিটি লাল হয়ে জ্বলে। এ সময় ভোটদান কক্ষে ভোটযন্ত্রের ওপর থাকা ‘রেডি’ বাতিটি সবুজ হয়ে জ্বলে। ভোটার তাঁর পছন্দের প্রার্থীর নাম ও প্রতীক চিহ্নের ডান দিকের নীল বোতাম টিপে দেন। সঙ্গে সঙ্গে রেডি সবুজ বাতিটি নিভে যায়, প্রার্থীর বোতামের তীর চিহ্নটি লাল হয়ে জ্বলে। কন্ট্রোল ইউনিট থেকে তখন দুই সেকেন্ড ধরে বি-ই-প শব্দ হয়। শব্দটি বন্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তীর চিহ্নের লাল আলোটি নিভে যায়। তখন ভোটার নিশ্চিত হন, ভোটটি সঠিকভাবে দেওয়া হয়েছে।
নারীর ক্ষমতায়ন: বিধানসভায় নারীকে জায়গা করে দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো দলেরই বিশেষ কর্মসূচি নেই। এটা তেমন কোনো ইস্যুও নয়। আমাদের শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার মতোই মমতা বিচ্ছিন্ন গল্প। নারীর ক্ষমতায়নের প্রশ্ন নেই। নারী প্রার্থীর সংখ্যা নগণ্য। কলকাতা ও মুম্বাই হাইকোর্টের সাবেক প্রধান বিচারপতি চিত্ততোষ মুখোপাধ্যায় কিছুকাল মহারাষ্ট্রের গভর্নর ছিলেন। নারী প্রার্থীদের স্বল্পতা প্রসঙ্গে তিনি পুরুষতান্ত্রিকতা এবং অবস্থার পরিবর্তন ঘটতে আরও বহু সময় লাগবে বলেই জানালেন।
পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে নারীদের এত দীর্ঘ লাইন এই প্রথম। মনে হলো, অবাধ ও সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করার সঙ্গেও নারীর ক্ষমতায়নের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের সমালোচনা করতে গিয়ে লোকসভার সাবেক স্পিকার সোমনাথ চ্যাটার্জি শনিবার বলেন, সারা ভারতে নারীশিক্ষার হার ৭৪। পশ্চিমবঙ্গে সর্বোচ্চ। এখানে এটা ৭৭ দশমিক শূন্য ৮। তিন ভাগ বেশি। মনমোহনকে নাকচ করতে বুদ্ধদেবও তা পুনর্ব্যক্ত করেন। মনে হচ্ছে, মহাকরণে নারীর সদর্প পদচারণ সময়ের ব্যাপার মাত্র। পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে এটাই প্রকৃত পরিবর্তন এবং সেটা ঘটতে শুরু করেছে।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.