চলতি পথে-বিজয়পুরের সাদা মাটির পাহাড় by দীপংকর চন্দ

দুর্গমতার জন্য পাহাড়ের প্রতি অহেতুক ভীতি কাজ করে আমার ভেতর। স্পর্শাতীত দূরত্ব বজায় রাখার জন্য আকাশের প্রতি ক্রিয়াশীল থাকে একরাশ অভিমান। সমুদ্রের প্রতি মুগ্ধতা মেশানো শ্রদ্ধা আজন্মলালিত থাকলেও আমার ভালোবাসা কিন্তু নদীর প্রতি। নদীর স্নিগ্ধ রূপ, আকস্মিক রুদ্ররোষ, সাময়িক গাম্ভীর্য, সুললিত হাস্যরস—সব মিলিয়ে নদীকেই মানবিক গুণসম্পন্ন সজীব সত্তা মনে হয় আমার কাছে!


বিরিশিরির সঙ্গে সোমেশ্বরীর সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। নেত্রকোনা জেলার দুর্গাপুর উপজেলার বিরিশিরি নামের প্রত্যন্ত এলাকার কথা ভাবলে প্রথমেই যে নদীটির ছবি ভেসে ওঠে মানসপটে, তার নাম সোমেশ্বরী। বিরিশিরি পৌঁছে সেই সোমেশ্বরীর সঙ্গে দেখা হবে না, তা কি হয়! দুর্গাপুর সদরে যাওয়ার প্রচলিত পথ এড়িয়ে একটু ভিন্ন রাস্তায় সোমেশ্বরীর কাছে এলাম আমরা। এঁকেবেঁকে বয়ে চলা এই পাহাড়ি নদীর প্রকৃতি এখন শান্ত। চকচকে বালিতে ঢেকে আছে নদীর সর্পিল প্রবাহ খাতের সিংহভাগ। দূরে-বহুদূরে প্রবাহ খাতের প্রাণকেন্দ্রে রুপালি ফিতের মতো বয়ে চলেছে সোমেশ্বরীর স্বচ্ছ জল। নদীর এ অংশে জলের গভীরতা এখন হাঁটু অবধি। তলদেশ বালুচরে আটকে যাওয়ার আশঙ্কা সত্ত্বেও এই সামান্য জলটুকু পেরোনোর জন্যও রয়েছে নৌকার ব্যবস্থা। পাদুকাজোড়া হাতে ঝুলিয়ে নৌকায় উঠলাম আমরা। মিনিট কয়েকের মধ্যে সোমেশ্বরীর ক্ষীণ প্রবাহ অতিক্রম করে পা রাখলাম ওপারে। এবার? এবার অভিযাত্রা বিজয়পুরের পথে।
কিন্তু কী রয়েছে বিজয়পুরে? রয়েছে সাদা মাটির পাহাড়। নেত্রকোনা জেলার উল্লেখযোগ্য প্রাকৃতিক সম্পদের মধ্যে অন্যতম বিজয়পুরের সাদা মাটি। এই সাদা মাটি দিয়েই বাংলাদেশে তৈরি হচ্ছে সিরামিকের বাসন। শুধু তা-ই নয়, টাইলস ও বিভিন্ন ধরনের বৈদ্যুতিক সামগ্রী তৈরিতেও অত্যাবশ্যক উপাদান হিসেবে ব্যবহূত হচ্ছে বিজয়পুরের পাহাড় থেকে আহরিত সাদা মাটি। সাদা মাটির সেই পাহাড় দেখতেই আমরা রিকশা নিলাম। ধীরে ধীরে পার হলাম শিবগঞ্জ বাজার, গারোবাজার, ধানীপাড়া। নানা রকম ফসল ভরা খেতের গন্ধ নিতে নিতে উপস্থিত হলাম ভূমি সমতল থেকে খানিকটা উঁচু এলাকার পাদদেশে। চালক রিকশা থামালেন এবার। জানালেন, এখান থেকেই শুরু বিজয়পুর সাদা মাটির পাহাড়ের সীমানা।
রিকশা থেকে নেমে এলাম আমরা। পরবর্তী পথটুকু এগোলাম পদব্রজে। এগোতে এগোতে লক্ষ করলাম, পাহাড় হিসেবে পরিচিতি পেলেও সাদা মাটি আহরণের স্থানটির ভূপ্রকৃতি টিলাসদৃশ। প্রথম টিলাটি অতিক্রম করতে না করতেই স্তূপাকারে সাজিয়ে রাখা সাদা মাটির টুকরো চোখে পড়ল আমাদের। যদিও পুরোপুরি সাদা নয় মাটিগুলো, তবু লোকমুখে সাদা হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আহরিত এই মাটির রং। সামনেই একটা প্রমিত আকারের সাইনবোর্ড। বিসিআইসির একটি প্রতিষ্ঠান ‘বাংলাদেশ ইনসুলেটর অ্যান্ড স্যানিটারি ওয়্যার ফ্যাক্টরি লিমিটেড’-এর সাদা মাটি কোয়ারি প্রকল্পের নাম লেখা সেই বোর্ডটিতে। মাইজপাড়া ও পাঁচকাহনীয়া মৌজার ৩০ হেক্টর জমি নিয়ে সাদা মাটি খননকাজ পরিচালনা করছে প্রতিষ্ঠানটি। ‘স্বাধীনতার আগে এই খননক্ষেত্র থেকে সাদা মাটি আহরণ করত কোহিনূর কোম্পানি। এলাকার পুরোনো মানুষের কাছে এখনো এই খননক্ষেত্রটি কোহিনূর কোম্পানির পাহাড় হিসেবে পরিচিত,’ বললেন খননক্ষেত্রের পাহারার কাজে নিযুক্ত মো. ইউনুস আলী। তিনি আরও জানালেন, ১৯৫৭ সালের ভূতাত্ত্বিক জরিপে দুর্গাপুর উপজেলার বিজয়পুরে সর্বপ্রথম সাদা মাটির সন্ধান পাওয়া যায়। ১৯৬৪ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত সরকারের খনিজ সম্পদ বিভাগ এই অঞ্চলে সাদা মাটির পরিমাণ নির্ধারণের জন্য ১৩টি কূপ খনন করে। আবিষ্কৃত হয় সাদা মাটির বিশাল মজুদ। স্বাধীনতার পর দেশে সাদা মাটির ব্যবহার বাড়তে থাকে। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এগিয়ে আসে সাদা মাটির জিনিসপত্র তৈরির কারখানা স্থাপনে। প্রাকৃতিক এই খনিজ সম্পদ উত্তোলনের জন্য ইজারা দেওয়া হয় খননক্ষেত্র। বর্তমানে ১১টি প্রতিষ্ঠান খননক্ষেত্র ইজারা নিয়ে সাদা মাটি আহরণ করছে দুর্গাপুরে। মাটি আহরণকাজের তত্ত্বাবধানে নিযুক্ত মো. আবুল কাশেমের সঙ্গেও কথা হলো আমাদের। তিনি জানালেন, বিজয়পুরের সাদা মাটির রং হালকা সাদা থেকে ধূসর রঙের হয়। কোথাও কোথাও মাটির রং গোলাপি, হালকা সবুজ, নীলাভ ও বেগুনি। তবে হালকা সাদা মাটিই শিল্পকারখানার কাঁচামাল হিসেবে সর্বোৎকৃষ্ট। ধূসর রঙের মাটি শুকিয়ে মসৃণ করে কিছুটা কার্যোপযোগী করা গেলেও অন্যান্য রঙের মাটির কোনো উপযোগিতা নেই সিরামিকশিল্পে। তাঁর সঙ্গে কথা বলতে বলতে টিলার ওপর উঠে এলাম আমরা। নিচে তাকালাম। অনেক অনেক নিচে পৃথিবীর বুক বিদীর্ণ করে সাদা মাটি তুলে আনছে পুরুষ শ্রমিকের দল। মাটি তুলে ঝুড়িতে সাজিয়ে দিচ্ছে তারা। ঝুড়িভর্তি সেই মাটি পৃথিবীর উপরিতলে তুলে আনছে একদল নারী শ্রমিক। গাঁইতি কোদাল দিয়ে সেগুলো স্তূপাকারে গুছিয়ে রাখছে অন্যরা। আচ্ছা, এই খননক্ষেত্রের মাটি উত্তোলন-প্রক্রিয়াটি কি পরিবেশবান্ধব প্রকৃত অর্থে? যথাযথ নিয়মনীতি মেনেই কি সম্পন্ন হচ্ছে ভূগর্ভস্থ খনিজ সম্পদ আহরণের কাজ? খননকাজ দেখতে দেখতে প্রশ্ন তৈরি হয় আমাদের মনে। উত্তরের প্রত্যাশায় যথাযথ কর্তৃপক্ষের সন্ধান করি আমরা। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে কী হয় শেষ পর্যন্ত? হ্যাঁ, উত্তরের পরিবর্তে জন্ম নেয় প্রশ্নের এক নাতিদীর্ঘ মিছিল!
দীপংকর চন্দ

No comments

Powered by Blogger.