রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আসুক-মানবিক দুর্যোগ

২০০১ সালের ১ অক্টোবর অনুষ্ঠিত অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরপরই দেশের বিভিন্ন স্থানে বেশ কিছু সহিংস ঘটনার খবর দেশ-বিদেশের সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত হয়; দেশের ভেতর ও বাইরে তার ব্যাপক সমালোচনাও হয়। ওই নির্বাচনে পরাজিত আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের ওপর নির্বাচনে বিজয়ী বিএনপি ও


তার নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটের শরিক দলগুলোর কিছু নেতা-কর্মী যে নৃসংসতা চালায়, একটি গণতান্ত্রিক দেশে তা প্রত্যাশিত ছিল না। সে সময় দায়িত্বরত তত্ত্বাবধায়ক সরকার সহিংসতা দমনে ব্যর্থ হয়েছিল, এটা যেমন দুর্ভাগ্যজনক, তেমনি নির্বাচনে জয়ী হয়ে ক্ষমতা গ্রহণকারী চারদলীয় জোট সরকার যে সেসব অপরাধের কোনো আইনি প্রতিকারের পদক্ষেপ নেয়নি, তাও সমানভাবে দুঃখজনক।
প্রায় নয় বছরের মাথায় সেসব সহিংস ঘটনা তদন্তে গঠিত তিন সদস্যের বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন প্রায় এক বছর ধরে ঘটনাবলি তদন্ত করে একটি বিশদ প্রতিবেদন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে জমা দিয়েছে গত রোববার। এখন এই প্রতিবেদনের আলোকে সংঘটিত অপরাধগুলোর আইনি প্রতিকার এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি বন্ধ করার উদ্যোগ নিতে হবে।
পাঁচ খণ্ডে মোট এক হাজার ৭৮ পৃষ্ঠার ওই প্রতিবেদনে মোট পাঁচ হাজার ৫৭১টি অভিযোগ রয়েছে। এর মধ্যে ৩৫৫টি হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ। ধর্ষণ, গণধর্ষণ, হাত-পা কেটে নেওয়াসহ গুরুতর আঘাত করা, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ইত্যাদি অপরাধের অভিযোগ তিন হাজার ২৭০টি। অপরাধগুলো সংঘটিত হয়েছে ২০০১ সালের ১ অক্টোবর থেকে ২০০২ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত।
তদন্ত কমিশনের একজন সদস্য যথার্থভাবেই সেসব ঘটনাকে ‘মানবিক দুর্যোগ’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। নির্বাচনে বিজয়ীদের ‘বিজয়োল্লাস’ স্তিমিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের জিঘাংসার অবসান ঘটেনি এবং ক্ষমতার হাতবদলের সুযোগে কিছু মানুষ দীর্ঘ সময় রাজনৈতিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়া প্রতিপক্ষ এবং সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন চালিয়েছে। এটি যারপরনাই বিপজ্জনক প্রবণতা।
প্রতিবেদনে চারদলীয় জোটের কতিপয় নেতাকে সেই সময়ের সহিংস ঘটনার জন্য দায়ী করে তাঁদের নাম-পরিচয় উল্লেখ করা হয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন বলেছেন, দোষী ব্যক্তিদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হবে। এখানে সতর্কতা প্রয়োজন: অপরাধীদের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগ ও বিচার-প্রক্রিয়া যেন রাজনৈতিক অবস্থান দ্বারা প্রভাবিত না হয়। কোনো ধরনের প্রতিশোধপ্রবণতা যেন স্থান না পায়, তা নিশ্চিত করতে হবে। বদলাতে হবে রাজনৈতিক সংস্কৃতি। নইলে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঠেকানো যাবে না। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করা হোক। নির্বাচনে ‘বিজয়োল্লাসের’ সহিংস প্রদর্শনী বন্ধ করা দরকার। উদ্ভূত অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি মোকাবিলায় আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও স্থানীয় প্রশাসনকে রাজনৈতিক প্রভাবের বাইরে থেকে দায়িত্ব পালন করতে দিতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.