লিবিয়া আগ্রাসন-এরা ‘সভ্যতা’র প্রতিনিধি? by আলাঁ বাদিয়ু

[ফরাসি দার্শনিক জঁ-লুক ন্যান্সি লিবিয়ায় ন্যাটোর অভিযানকে সতর্কভাবে স্বাগত জানিয়ে একটি নিবন্ধ লেখেন লিবারেশন পত্রিকায়। সেই নিবন্ধের সূত্র ধরেই আলাঁ বাদিয়ু এই খোলা চিঠিটি প্রকাশ করেন] হ্যাঁ, প্রিয় জঁ-লুক, লিবিয়ায় ‘পশ্চিমা’ আগ্রাসনের পক্ষে আপনার অবস্থান আমার কাছে দুঃখজনকভাবে আশ্চর্য লেগেছে বৈকি।


লিবিয়ায় যা ঘটছে এর সঙ্গে অন্যত্র [তিউনিসিয়া ও মিসর] যা ঘটছে, তার পার্থক্য যে শুরু থেকেই পরিষ্কার, সেটা কি আপনি দেখেননি? তিউনিসিয়া ও মিসরে তো আমরা আসলেই বিশাল গণজমায়েত দেখলাম, অন্য দিকে লিবিয়ায় তেমন কিছু ঘটল না। কেমন করে এটা ঘটল? আমার এক আরব বন্ধু গত কয়েক সপ্তাহে তিউনিসিয়া ও মিসরে ব্যবহূত প্ল্যাকার্ড, ব্যানার, পোস্টার ও পতাকার গায়ে উৎকীর্ণ লেখার অনুবাদ করছিলেন নিবিষ্ট মনে। দেশ দুটিতে বিক্ষোভ প্রদর্শনের সময় সবখানে এসব ব্যবহূত হয়েছে। অথচ লিবিয়ায় এসবের একটা নমুনাও তিনি খুঁজে পাননি। এমনকি বেনগাজিতেও না। লিবিয়ার ‘বিদ্রোহীদের’ ক্ষেত্রে আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো, তাদের মধ্যে একজনও নারী নেই। অথচ তিউনিসিয়া ও মিসরে নারীদের খুব দৃশ্যমান উপস্থিতি ছিল। বিস্ময় লাগল, আপনি এ বিষয়টি উল্লেখ করেননি। গত হেমন্ত থেকেই ব্রিটিশ ও ফরাসি গোয়েন্দা সংস্থাগুলো গাদ্দাফির পতন ঘটানোর আয়োজন করে চলেছে। আপনি তা জানতেন না? অন্য সব আরব জাগরণের বিপরীতে লিবিয়ায় দেখা গেল অজানা উৎস থেকে অস্ত্র এল, আপনার একটুও খটকা লাগল না? একদল তরুণ একেবারে শুরু থেকেই আকাশে অবিরাম গুলি ছুড়তে শুরু করল। অন্যত্র এমন ঘটার কথা ভাবা যায়? যেখানে যেখানে গণজাগরণ ঘটল, সেসব স্থানে কোথাও সরকারকে স্থলাভিষিক্ত করতে কাউকে নিযুক্ত করার কোনো প্রশ্ন উঠতে দেখা গেল না, অথচ গাদ্দাফিরই সাবেক এক সহচরের নেতৃত্বে ‘বিপ্লবী পরিষদ’ গজিয়ে ওঠা নিয়ে আপনার কোনো ধন্দ লাগল না?
এত সব বিবরণের পর আরও অনেক কথা বলা যাবে। সাহায্যের জন্য এই বড় শক্তিগুলোকে তো এখানেই ডেকে আনা হয়েছে। অন্য কোথাও এমনটি ঘটেনি। তাদের ডেকে আনা যে এত সব বিবরণের সঙ্গে কতটা অসংগতিপূর্ণ, তা কি আপনি বুঝতে পারছেন না? সারকোজি আর ক্যামেরনের মতো লোককে ডেকে আনা হয়েছে। এই দুজনের মনোবাসনা তো একদম পরিষ্কার। তাঁদের অভিবাদন জানানো হলো, সাদরে গ্রহণ করা হলো—আর আপনি হুট করে তাঁদের সমর্থন দিয়ে বসলেন। পশ্চিমা শক্তিগুলোকে প্রবেশের পথ করে দিয়েছে লিবিয়া—এটা কি পুরোপুরি পরিষ্কার নয়? অন্য জায়গা তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছিল। আর তাদের চাওয়া পুরোপুরি পরিষ্কার ও শাশ্বত; তা হলো চলমান বিপ্লবকে যুদ্ধে রূপ দেওয়া। রাজপথ থেকে জনতাকে সরিয়ে অস্ত্র ও সেনাবাহিনী আসার পথ করে দেওয়া। এই কাজ কি সম্পদ কবজা করার জন্য? এই প্রক্রিয়াটি আপনার চোখের সামনে ঘটে চলেছে প্রতিনিয়ত, অথচ আপনি এটা মেনে নিলেন? আপনি দেখতে পাচ্ছেন না, কীভাবে শুরুতে বিমান থেকে সন্ত্রাসী হামলা চালানোর পর এখন স্থলে বিদ্রোহী বাহিনীকে ভারী অস্ত্রে সজ্জিত করা হচ্ছে? পাশাপাশি দেওয়া হচ্ছে প্রশিক্ষক, যুদ্ধযান, রণকৌশলবিশারদ, উপদেষ্টা ও শান্তিরক্ষীদের। আর এভাবেই আবার নতুন করে আরব বিশ্ব জয় শুরু হতে যাচ্ছে পুঁজি ও তার রাষ্ট্রীয় তাঁবেদারদের স্বৈরিতায়।
এত মানুষ থাকতে আপনিই কেন এমন ফাঁদে পা বাড়ালেন? যাদের কাছে আগের পরিস্থিতি ভালো ছিল, তাদের জন্য যেকোনো ‘উদ্ধার’ মিশন আপনি কী করে মেনে নিতে পারেন? যারা তেল ও কর্তৃত্বের আকর্ষণে জোর করে হলেও ক্ষমতার খেলায় ফিরতে চায়? অশ্লীলভাবে ভিকটিমের নাম ব্যবহার করে যে ‘মানবিকতার’ ছাতা তৈরি করা হয়েছে, তা কি শুধু শুধু আপনি মেনে নিতে পারেন? স্থানীয় বস গাদ্দাফি নিজ দেশে যত মানুষ মারতে পারতেন তার চেয়ে অনেক বেশি মানুষ বিভিন্ন দেশে হত্যা করে ফরাসি সেনাবাহিনী। সমসাময়িক কালে সবচেয়ে বড় নরহত্যাকারী কসাইদের প্রতি হঠাৎ আস্থা কেন? যারা পৃথিবীটাকে কেটে-ছিঁড়ে লন্ডভন্ড করছে, তাদের প্রতি দরদ কেন? তাদের কীর্তিকলাপের ছবি তো দেখেছি আমরা। এরা ‘সভ্যতার’ প্রতিনিধি—এ কথা আপনি বিশ্বাস করেন? এটা বিশ্বাস করা যায়? বিশ্বাস করা যায়, তাদের পাশবিক বাহিনী হতে পারে ন্যায়ের বাহিনী? আমি হতভম্ব। বলতেই হচ্ছে। নিজেকে প্রশ্ন করি, এ ধরনের অচিন্তাশীল মতামত, যা আমাদের শাসকদের প্রপাগান্ডার ছাঁচে গড়া, তার র‌্যাডিকেল সমালোচনা যদি না হয় তবে দার্শনিকের কাজ কী?
আপনার লেখায় বলেছেন, ‘পরবর্তীকালে’ তেল ও অস্ত্রচুক্তি এবং এ-জাতীয় অন্যান্য ব্যাপার-স্যাপার যেন ফিরে না আসে, সেটা দেখার দায়িত্ব ‘আমাদের’ ওপরই বর্তাবে (আজ যদি এই আমরার ভেতরে সারকোজি, বারনার্ড-হেনরি লেভি, আমাদের বোমারু আর তার সমর্থকেরাও থাকে তাহলে এই ‘আমরা’ মানে কারা?)। কিন্তু কেন ‘পরবর্তী সময়ে’? আরব বিশ্বের চলমান রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় বড় শক্তিগুলোর হস্তক্ষেপ বন্ধ করার বিষয়টি আমাদের এখনই নিশ্চিত করতে হবে। সম্ভবপর সবকিছু করার মাধ্যমে নিশ্চিত করতে হবে এসব শক্তি নতুন করে গণতন্ত্র, নৈতিকতা ও মানবিকতার নানা অজুহাতে যেন ঢুকতে না পারে। প্রথম ঔপনিবেশিক বিজয়ের সময় থেকেই তো এমন অজুহাতই এরা দিচ্ছে।
প্রিয় জঁ-লুক, এ ধরনের পরিস্থিতিতে আপনার বা আমার কারোরই পশ্চিমা মতৈক্যের প্রতি সতর্কভাবেও সমর্থন দেওয়ার কোনো মানে হয় না। ‘আমাদের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকতে হবে সবকিছুর ওপর’—এ ব্যাপারে পশ্চিমারা একমত। এ পরিস্থিতিতে পশ্চিমা হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে হবে আর দেখাতে হবে, পশ্চিমা বোমারু ও সেনাদের আসল লক্ষ্যবস্তু কোনোমতেই বদমাশ গাদ্দাফি নন। গাদ্দাফিকে আজ তারা হটাতে চাইছে, অথচ কিছুদিন আগে গাদ্দাফি ছিল তাদেরই মক্কেল। আজ তাঁকে হটাতে চাওয়ার কারণ তাদের অধিকতর পছন্দসই কাউকে তারা নিয়ে আসতে চায়। বোমা নিক্ষেপকারীদের লক্ষ্যবস্তু নিশ্চিতভাবেই মিসরের গণজাগরণ ও তিউনিসিয়ার বিপ্লব, তাদের অপ্রত্যাশিত ও বিরূপ অবস্থান, তাদের রাজনৈতিক স্বায়ত্তশাসন, এককথায় তাদের স্বাধীনতা। পশ্চিমাদের সামরিক হস্তক্ষেপের বিরোধিতার মানে সেই রাজনৈতিক স্বাধীনতাকে আর এসব গণজাগরণ ও বিপ্লবকে সমর্থন দান। এ কাজ আমাদের অসাধ্য নয়, আর শর্তহীনভাবেই আমাদের তা করতে হবে।
আপনার বন্ধু/আলাঁ
ভার্সোবুকস ব্লগ থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনুবাদ: আহসান হাবীব
আলাঁ বাদিয়ু: ফরাসি রাজনৈতিক দার্শনিক।

No comments

Powered by Blogger.