শ্রদ্ধাঞ্জলি-মুক্তির কারিগর

আলেক্সান্ডারের বিখ্যাত উক্তি ‘সত্যিই সেলুকাস! কী বিচিত্র এই দেশ!’ তিনি ছিলেন বিদেশি। কোনটা চিত্র আর কোনটা বিচিত্র, সেটা তিনি বুঝতে পারেননি হয়তো। কিন্তু বিচিত্র সেই দেশের বৈচিত্র্যময় আবহাওয়ার সঙ্গে অবিরাম সংগ্রাম করে যাওয়া মানুষগুলোর মনের খুব কাছাকাছি অতি অল্প সময়ে পৌঁছেছিলেন যে মানুষটি,


তাঁর নাম আবদুস সামাদ আজাদ। সে জন্যই ১৯২২ সালের ১৫ জানুয়ারি সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর উপজেলার নলুয়ার হাওরের অথই পানির মধ্যে ছোট্ট একটি দ্বীপসম গ্রাম ভূ-রাখালীতে জন্মে, ১৯৪০ সালেই তিনি মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের সুনামগঞ্জের সভাপতি হতে পেরেছিলেন। ১৯৪৬ সালে একই সংগঠনের অবিভক্ত আসামের সভাপতি হন। এরই সূত্রে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং ব্রিটিশ শাসকদের কোপানলে পড়ে তাঁদের কারাগারে নিক্ষিপ্ত হয়েছেন। তিনি হাতেগোনা সেই কয়জন রাজনীতিবিদের একজন, যাঁরা ব্রিটিশ, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের স্বৈরশাসকদের কারাযন্ত্রণা ভোগ করেছেন।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি, তৎকালীন নির্ভীক ছাত্রনেতা আবদুস সামাদের প্রস্তাবনা গৃহীত হলো সর্বদলীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের সভায়। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৪৪ ধারা ভাঙার লক্ষ্যে ১০ জনের মিছিলে নেতৃত্ব দিয়ে বের হয়ে এলেন আবদুস সামাদ।
মিছিলের ওপর গুলি না করে গ্রেপ্তার করায় তাঁর নাম শহীদের তালিকায় না থেকে থাকল গ্রেপ্তারের তালিকায়। ভাষা আন্দোলনে জড়িত থাকায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যে ছাত্রনেতাদের ছাত্রত্ব কেড়ে নিয়েছিল, তাঁদের সবাইকে যথাযথ মর্যাদায় সম্মানিত করা হোক।
রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকেই ভাটি বাংলার মানুষের সুখে-দুঃখে নিজেকে বিলীন করে দিতে পেরেছিলেন বলেই তিনি সুরাইয়া-বিবিয়ানাসহ বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে বাংলার মানুষের খাদ্য সমস্যার সমাধানের স্বপ্ন দেখতেন। শত প্রতিকূলতার মধ্যেও কখনো অন্যায়ের কাছে নতি স্বীকার করেননি। দ্বিধা করেননি বিপরীত স্রোতে নৌকা বাইতে। বিপদের মধ্যে তিনি তাঁর চারপাশে একটি ইতিবাচক আবহ তৈরি করতে পারতেন, যা তাঁর আশপাশের মানুষের মনবল সংহত করত। হাওর ভাসানো প্রচণ্ড বন্যায়, গ্রামের মধ্যে কোমরপানিতে দাঁড়িয়ে ত্রাণ বিতরণ করতেন আর বিশ্বাস জোগাতেন, একদিন নেদারল্যান্ডের মতো তাঁর হাওরগুলো ভরা বন্যার সময়ও ফসলে ভরে উঠবে, আর যে হাওরগুলোতে সেটা সম্ভব হবে না, সেই হাওরপারের গ্রামগুলো ভেনিসের মতো অথৈ জলে মুক্তোর মতো জ্বলবে।
১৯৫৪ সাল। জগন্নাথপুর-দিরাই থেকে যুক্তফ্রন্টের নৌকা নিয়ে তিনি প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। তৎকালীন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এটা ছিল শাসক-শোষকশ্রেণীর ওপর সাধারণ মানুষের বিজয়। তৎকালীন রাজনৈতিক নেতৃত্বকে কুক্ষিগত করে রেখেছিল জমিদার-তালুকদার আর রায়বাহাদুর-খানবাহাদুরেরা। সেই কুলীন রাজনীতিকে সাধারণ মানুষের কাতারে নিয়ে এসেছিলেন হাতেগোনা যে কজন মানুষ, তাঁদের একজন ছিলেন আবদুস সামাদ আজাদ। প্রতিদানও তিনি পেয়েছেন। সাধারণ মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে, সুনামগঞ্জ জেলার প্রায় প্রতিটি অঞ্চলে মানুষের ভোটে, ১৯৫৪ সাল থেকে আমৃত্যু সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রতিটি সংসদে তিনি ছিলেন নির্বাচিত প্রতিনিধি।
তাঁর রাজনীতি ছিল জনগণতান্ত্রিক-অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি; তাঁর রাজনীতি ছিল স্বৈরাচারবিরোধী, প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের বিরুদ্ধে রাজনীতি। সে জন্যই তাঁকে দেখা গেছে ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান থেকে ছিয়ানব্বইয়ের গণ-আন্দোলনসহ সব গণসংগ্রামের সামনের কাতারে। তিনি গর্ববোধ করতেন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে নিজের পরিচয় দিতে। তাঁর সব অহংকার বাঁধা ছিল বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের গণ্ডিতে। মুক্তির জন্য যুদ্ধ করেছেন অনেকেই, কিন্তু সেই ইতিহাসের সফল নায়ক কজন? মহাপরাক্রমশালী রোমান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে মুক্তিকামী জনতাকে নিয়ে যুদ্ধ করা স্পার্টাকাসের চেয়ে আর্জেন্টাইন ফুটবলার ম্যারাডোনা ছিলেন আবদুস সামাদ আজাদের বেশি প্রিয়। মানব জাতির ইতিহাসে খুব কম মানুষই আছেন, যাঁরা তাঁর জাতির হাজার বছরের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবতার নিরিখে বিচার করে ধীরে ধীরে সাফল্যের বিজয়গাথা রচনা করতে পেরেছেন।
রবীন্দ্রনাথ সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখিয়েছেন আর নজরুল শুনিয়েছেন বিদ্রোহের বাণী, কিন্তু স্বাধীনতা আনতে পারেননি। স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন তিতুমীর-ঈশা খাঁ আর সূর্যসেনের মতো বীরেরা, কিন্তু বাস্তবায়ন করতে পারেননি। নেতাজি বলেছিলেন, ‘তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব।’ বাঙালি রক্ত ঢেলে দিয়েছিল, কিন্তু দেখা পায়নি স্বপ্নের স্বাধীনতার। অতঃপর হাজার বছরের প্রতীক্ষা শেষে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম’, সামাদ আজাদের মতো হাজারো কর্মী তাঁদের নেতা বঙ্গবন্ধুর ওপর সম্পূর্ণ আস্থা রেখে এগিয়ে গেলেন নেতার দেখানো পথে, ঐক্যবদ্ধ হলো সাড়ে সাত কোটি বাঙালি—জাতি পেল স্বাধীনতা। সামাদ আজাদের কর্ম বোধ হয় পূর্ণতা পেয়েছে, মুজিবনগর সরকার যে মাসে গঠিত হয়, সেই এপ্রিলেরই ২০০৫ সালের ২৭ তারিখ মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার কারণে।
আমৃত্যু তিনি বিশ্বাস করতেন বাংলার মানুষের মনজগতে হজরত শাহ্জালাল (রহ.) এবং তাঁর সঙ্গে আসা ৩৬০ জন আউলিয়ার আধ্যাত্মিক ভূমিকাকে। তিনি বিশ্বাস করতেন, তাঁদের কারণেই এ অঞ্চলে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয়েছে অসাম্প্রদায়িক সমাজব্যবস্থা অক্ষুণ্ন রেখে। হজরত শাহ্জালাল (রহ.)-এর শহরের গাম্ভীর্য অক্ষুণ্ন রাখার প্রয়োজনে সিলেটকে বাংলাদেশের আধ্যাত্মিক রাজধানী ঘোষণা করা হোক।
আজিজুস সামাদ আজাদ

No comments

Powered by Blogger.