পাকিস্তান-জারদারির সুফিবাদী ঝোঁক by সৈয়দ নাকভি

ভারত ও পাকিস্তানে যখন ধর্মীয় চরম পন্থা চরমে, তখন আসিফ আলী জারদারির আজমির শরিফে খাজা বাবা চিশতির মাজারে ধরনা দেওয়া প্রশংসার যোগ্য হয়েছে। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং উপযুক্ত সময়ে পাকিস্তান সফর করবেন, এটা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ খবর। কিন্তু আমার কাছে এই ঘটনার প্রতীকী গুরুত্ব অন্যখানে।


এত বড় একটি পাকিস্তানি প্রতিনিধিদলের আজমির সফরের ঘটনা পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মনে আঁচড় কাটবে। হাফিজ সাঈদের সহিংস ধর্মাচরণের চেয়ে তাঁরা বরং সুফিদের কোমল মানবীয় বার্তায় বেশি শান্তি পান। এসব সত্ত্বেও হাফিজের মাথার জন্য মার্কিন সরকারের তরফে বিরাট পুরস্কার ঘোষিত হওয়ায় তাঁর জনপ্রিয়তার পারদ অনেক উঁচুতে উঠে গেছে। এসব কারণেই জারদারির আজমির সফর অভিনন্দনযোগ্য কাজ।
উপমহাদেশে ইসলামের বিস্তার ঘটেছে মূলত সুফিদের হাত ধরে। যদিও প্রচলিত ধারণা এর উল্টা। যে সময় রাহুল গান্ধী এবং তাঁর দলবল জনতার মন জয় করার জন্য ঘুরে বেড়াচ্ছেন, সে সময় সুফিরাই হতে পারেন তাঁদের আদর্শ পুরুষ। সুফি তরিকায় মানুষের মন জয়ের প্রথম শর্ত হলো, সহজে হূদয়ে গেঁথে যায় এমন বাণী তৈরি করা। সুফিদের বাণীগুলো অহিংস এবংসহজে ছড়াতে সক্ষম, যেমন সত্তার একত্ব, মানুষের সাম্য, ভালোবাসা বিশ্বজনীন এমন সব ধারণা।

সাম্যবাদ
সুফি খানকা, দরবার, সেবাসদনের সাম্যবাদ অস্বীকার করা যায় না। সেবাসদনে গিয়ে প্রথম দর্শনেই আগন্তুকেরা মুগ্ধ হয়ে যান। সেখানকার খাবার এমনভাবে তৈরি করা হয়, যাতে কেবল নিরামিষাশীদের জন্যই নয়, কোনো ধর্মের কারোরই খেতে সমস্যা না হয়। পেঁয়াজ ও রসুন যাতে বাদ যায় তা খেয়াল রাখা হয়, যাতে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনের অসুবিধা না হয়।
কোনো গোঁড়ামি যদি সুফিদের থেকে থাকে তা এই: তাঁরা রাজ-রাজড়া ও সামন্তদের সংস্রব সম্পূর্ণভাবে পরিহার করে চলেন। যেহেতু নীতির কারণে তাঁরা সুলতানের দরবারে যান না, সেহেতু সুলতানরাই তাঁদের দরবারে হাজিরা দেন। এ রকম ঘটনাও আছে, সুফিদের তুমুল জনপ্রিয়তায় অভিভূত হয়ে শাসকেরা তাঁদের দরবারে আসার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন।
কথিত আছে, একবার এ রকম অবস্থার মুখে হজরত নিজামুদ্দিন আউলিয়া বলেছিলেন, ‘যদি বাদশাহ সদর দরজা দিয়ে ঢোকেন, তাহলে আমি পেছন দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাব।’ তাঁরা সেই বাইবেলীয় অনুশাসন মান্য করে চলতেন: উটের পক্ষে সুচের ছিদ্র দিয়ে পার হওয়া বরং সহজ, কিন্তু ধনীদের পক্ষে ঈশ্বরের রাজত্বে প্রবেশ করা কঠিন। তাই দেখা যেত, দরিদ্র এবং বিচক্ষণেরা তাঁদের কাছে ভিড় জমাতেন।
খোশমেজাজি আচরণ, চালচলন এবং বিশ্বাসের কারণে মানুষ তাঁদের প্রতি আকর্ষণ বোধ করত। তাঁদের আধ্যাত্মিক চেতনা এমনই ছিল, যে জায়গাটিকে তাঁরা আপন করে নিতেন, সেখানকার সাংস্কৃতিক পরিবেশের সঙ্গে তাঁরা মিলিয়ে চলার চেষ্টা করতেন। স্থানীয় সংস্কৃতিকে তাঁরা কেবল গ্রহণই করতেন না, তার সঙ্গে একাত্মও হতেন।
এসব কারণেই, নিম্নবর্গীয়, জনপ্রিয় এবং শাস্ত্রীয় শিল্প-সংগীতে তাঁদের বিপুল প্রভাব। যেমন হজরত নিজামুদ্দিন আউলিয়ার প্রধান শাগরেদ হজরত আমির খসরু সেতার ও তবলা আবিষ্কার করেছিলেন এবং জন্ম দিয়েছিলেন কাওয়ালির। এ ছাড়া রাগসংগীতের বিকাশেও তাঁর অবদান অভূতপূর্ব। তাঁর হাতেই পরীক্ষামূলকভাবে হিন্দি ও ফারসির মিশ্রণের মাধ্যমে উর্দু ভাষার ভিত রচিত হয়।
সুফিরা যে ধারার জন্ম দিয়েছিলেন, পরের দিকের প্রত্যেক মহান উর্দু কবিই সেই ধারা অনুসরণ করে উপমহাদেশীয় মানবতাবাদী চিন্তাকে বিকশিত করেছেন। মাওলানা হাসরত মোহানী এঁদের অন্যতম। তিনি কমিউনিস্ট পার্টির নেতা এবংভারতীয়সংবিধানসভার সদস্যছিলেন। ভারতীয় সংবিধান যখন চূড়ান্ত হলো, ‘গণবিরোধী’ অভিযোগ তুলে তিনি তাতে স্বাক্ষর করতে অস্বীকার করেন। তিনি ছিলেন আধুনিক উর্দু গজলের এক প্রবাদপুরুষ। মল্লিকা পাখরাজের গাওয়া বিখ্যাত গজল ‘বেজুবানি জবান না হো যায়’ (শোনো, নৈঃশব্দ জবান পাচ্ছে) এই মাওলানারই সৃষ্টি।
স্বাভাবিকভাবেই, এই বর্ণিল বহুমুখী ইসলাম ভারতবর্ষে দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়েছিল। এবং স্বাভাবিকভাবেই এর প্রতিক্রিয়ায় জন্ম নিয়েছিল ইসলামি বিশুদ্ধতাবাদ।
দেওবন্দের দারুল উলুম ইসলামের বিশুদ্ধতাবাদী সংস্কার আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে। বিশ্বাসীদের ধর্মের সিধা পথে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা তখন থেকে চলছেই। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, রাজনীতিবিদেরা মুসলিম ভোটারদের খুশি করতে দেওবন্দ অথবা একটি বা দুটি মসজিদের ইমাম ছাড়া আর কারও কাছে যানও না, আর কোনো মধ্যস্থতাকারীকে চেনেনও না।
এসব প্রতিষ্ঠান দিনে দিনে ক্ষয় পাচ্ছে। তাহলেও, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ মুসলমানদের সন্ত্রাসী বলে দাগিয়ে দিয়ে মুসলমান সমাজে প্রতিহিংসার জন্ম দিচ্ছে। এসব ঘটনার অভিঘাতে দেওবন্দ হারানো শক্তি ফিরে পেতে চেষ্টা করছে।
মোটা দাগে আফগানিস্তান, কাশ্মীর, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশসহ ভারত ও পাকিস্তানের অন্যান্য অংশে ইসলাম এত দিন মূলত সুফি প্রভাবেই ছিল। কিন্তু আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েতদের হটাতে আমেরিকা সেখানে ওয়াহাবি মতবাদকে পৃষ্ঠপোষকতা দেয়। সেখান থেকেই জন্ম আধুনিক ইসলামি রাজনীতির। নয়-এগারো এবং এর পরের ঘটনাবলি এরই মাইলফলক।

ইসলামি চরম পন্থা
মূলত, জন্মের সময় থেকেই পাকিস্তানের ডিএনএর মধ্যেই একধরনের চরম পন্থার দাগ ছিল। তা নিছক একটি দাগই ছিল, বড় কিছু ছিল না। ১৯৫৩ সালে গঠিত মুনীর কমিশন প্রকৃত ইসলাম কী, সে বিষয়ে অনুসন্ধান চালায় কিন্তু কোনো উপসংহারে পৌঁছায় না। আফগান যুদ্ধের প্রতিক্রিয়ায় যা ঘটল তারই অন্তিম চেহারা দেখা গেল ২০০৭ সালে পাকিস্তানের লাল মসজিদের ঘটনাবলিতে। আফগান যুদ্ধের সময় আমেরিকান পৃষ্ঠপোষকতা এবং সেনাবাহিনীর মদদ পেয়ে ধর্মের ভেতরকার চরম পন্থা এখনো জোরদার।
বর্তমানে হাফিজ সাঈদকেই এই চরম পন্থার শীর্ষ প্রতিনিধি ধরা হয়। তাঁর সঙ্গে সৌদি আরব থেকে আসা ওয়াহাবি মতবাদের সম্পর্ক গভীর। ভারতে দেওবন্দ একটি নিরীহ সংস্কারবাদী ধারা হলেও পাকিস্তানে দেওবন্দ/সালাফি জোট তীব্র জিহাদের ডাক দিয়ে যাচ্ছে। সেটাকেই তারা মনে করে জাতীয় প্রয়োজন।
এসব কারণেই জারদারির আজমির সফর কেবল পাকিস্তানের জন্যই নয়, তার বাইরেও গুরুত্বপূর্ণ তাৎপর্য বহন করে।
ভারতের দি হিন্দু থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
সৈয়দ নাকভি: ভারতীয়সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.