সময়চিত্র-বিশেষজ্ঞ নই, তবু মতামত দিচ্ছি by আসিফ নজরুল

পিএইচডি নিয়ে পৃথিবীতে নানা গল্প প্রচলিত আছে। এসব গল্প ভালো বলতে পারেন ড. আইনুন নিশাত। তিনি আমাকে একবার বলেছিলেন, পিএইচডি আসলে পাঁচ প্রকার। জালিয়াতি (ব্যাখ্যা নিষ্প্রয়োজন), তেজারতি (টাকা-পয়সা খরচ করলেই যা পাওয়া যায়), খয়রাতি (খয়রাত হিসেবে যা দেওয়া হয়), মারফতি (যে পিএইচডির ব্যাখ্যা মারফতি জ্ঞান ছাড়া সম্ভব নয়) এবং মেহনতি (মেহনত করে পাওয়া)।


আমরা যারা বিদেশে বৃত্তি (যেমন কমনওয়েলথ বা ফুলব্রাইট) নিয়ে পড়াশোনা করেছি, তাদের মেহনতি পিএইচডি করা ছাড়া উপায় নেই। আমার পিএইচডি ছিল আন্তর্জাতিক নদী আইনের ওপর। নদী নিয়ে মানুষ গল্প-কবিতা-গান লেখে, চিত্রকলা করে। আর আমাকে করতে হয়েছে পিএইচডি। আমার এক শ্রদ্ধেয় শিক্ষক বুঝিয়েছিলেন, অর্ধশত আন্তর্জাতিক নদী প্রবাহিত বাংলাদেশের ওপর দিয়ে, কাজেই এটি করা খুব জরুরি। তাঁর বক্তব্য: যৌথ নদী কমিশনে আমার ‘বিশেষজ্ঞ জ্ঞান’ ব্যবহার করে উপকৃত হবে দেশ।
আমার ‘বিশেষজ্ঞ জ্ঞান’ আসলে দেশের তেমন কাজে লাগেনি। বিনয়ের সঙ্গে বলি, দেশের ১৫-১৬ কোটি মানুষের মধ্যে আমি সম্ভবত একমাত্র আন্তর্জাতিক নদী আইনে পিএইচডিধারী। নদী আইন বিষয়ে ক্লুয়ার একাডেমিক পাবলিশার্স কর্তৃক প্রকাশিত বইয়ের অধ্যায় ও জার্নাল অব এনভায়রনমেন্টাল লসহ কিছু উঁচুমানের জায়গায় আমি লিখেছি। পৃথিবীর বিভিন্ন ফোরামে এ বিষয়ে বক্তৃতা দেওয়ার সুযোগও হয়েছে। কিন্তু যে কারণে আমি পিএইচডি করেছিলাম, তা হয়নি। পিএইচডি করে আসার পর বিএনপি-তত্ত্বাবধায়ক-আওয়ামী লীগ সরকারের ১১ বছর অতিক্রান্ত হলো। আন্তর্জাতিক নদী নিয়ে কখনো কোনো সরকার আমাকে মতামত দেওয়ার জন্য ডাকেনি। যৌথ নদী কমিশনে আইনি বিষয়ে পরামর্শ দেওয়ার কাজ করেছেন প্রকৌশলীরা, কিন্তু আমি বা অন্য কোনো আইনের লোক নয়।
সে তুলনায় সাংবিধানিক আইনে আমার জ্ঞান সীমিত। কাজেই সংবিধান সংশোধনবিষয়ক সংসদীয় বিশেষ কমিটিতে মতামত দেওয়ার জন্য আমার মতো কাউকে ডাকা হবে না, এটি স্বাভাবিক। কিন্তু আমার আপত্তি অন্য জায়গায়। সাংবিধানিক আইন দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়ানো হয় বহু বছর ধরে। কমিটি শুধু এটি বিবেচনায় নিয়েও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আইন বিভাগকে মতামত দেওয়ার জন্য আহ্বান জানাতে পারত। পত্রিকায় দেখলাম, মতামত জানানোর জন্য ডাকা হয়েছে শুধু আইনজীবী আর বিচারকদের। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, আইনের গবেষকদের নয় কেন? কেন সামাজিক বিজ্ঞানের গবেষকদেরও নয়? কেন নয় সমাজের বিভিন্ন পেশাজীবীর প্রতিনিধিদের? কেন নয় নারী-শিশু-ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিদের?
সংবিধান সর্বস্তরের মানুষের জন্য। এত ঢাকঢোল পিটিয়ে কাজ করতে থাকা কমিটিতে তাদের কথা শোনার আগ্রহ নেই কারও?

২.
কমিটির কারও আগ্রহ না থাকলে আমরা তো বসে থাকতে পারি না। পত্রপত্রিকায় সংবিধান সংশোধন বিষয়ে বহু মানুষ ইতিমধ্যে মতামত জানিয়েছেন। জানি না এত কিছু পড়ে দেখার ইচ্ছে বা সময় কমিটির হয়েছে কি না। আমি শুধু সংক্ষেপে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু সাংবিধানিক পরিবর্তনের প্রয়োজনের কথা আবারও তুলে ধরছি।
প্রথমত, সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কার্যকাল ও কার্যাবলি সুনির্দিষ্ট করতে হবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে রাষ্ট্রপতি অতিমাত্রায় ক্ষমতাশালী হয়ে পড়েন বলে এই একজন ব্যক্তিকে বাধ্য করে বহু অঘটন করানো সম্ভব। তাই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে রাষ্ট্রপতির ওপর অবশ্যই উপদেষ্টামণ্ডলীর পরামর্শ অনুসারে কাজ করার বাধ্যবাধকতা আরোপ করতে হবে।
দ্বিতীয়ত, নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে প্রধানমন্ত্রী অতিমাত্রায় ক্ষমতা ভোগ করেন বলে কার্যত এক ব্যক্তির সরকার প্রতিষ্ঠিত হয় তখন দেশে। ভারতের সংবিধানে এই ক্ষমতা রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভার মধ্যে বণ্টিত। ভারতের রাষ্ট্রপতি মন্ত্রিসভার পরামর্শ নিয়ে কাজ করেন, আমাদের দেশের মতো শুধু প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ নেওয়ার বাধ্যবাধকতা সেখানে নেই। ভারতে রাষ্ট্রপতি প্রয়োজন মনে করলে এই পরামর্শ পুনর্বিবেচনার জন্য মন্ত্রিসভার কাছে ফেরতও পাঠাতে পারেন। রাষ্ট্রপতি ও মন্ত্রিসভার ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য এসব ভালো বিধানকে বিবেচনায় নেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে।
তৃতীয়ত, আইনসভাকে আরও কার্যকর করার জন্য সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ শুধু আস্থা-অনাস্থা ভোট ও বাজেট পাসের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, এটি সংবিধানে লিখে দেওয়া প্রয়োজন। আফ্রিকা ও পূর্ব ইউরোপের কিছু দেশে অনুরূপ ও প্রতিবেশী পাকিস্তানে অবিকল এ ধরনের বিধান রয়েছে।
চতুর্থত, নিম্ন আদালতের স্বাধীনতার জন্য ১৯৭২ সালের সংবিধানের ১১৫ ও ১১৬ অনুচ্ছেদ অবিকলভাবে ফিরিয়ে আনতে হবে। পঞ্চম সংশোধনী মামলায় স্বয়ং আপিল বিভাগের কাছে এটি করার সুযোগ ছিল। কিন্তু তাঁরা এটি করতে আশ্চর্যজনকভাবে অনীহ ছিলেন। এখন সংসদও এটি করতে ব্যর্থ হলে বিচার বিভাগের কাজে নানাভাবে হস্তক্ষেপ করার সুযোগ অব্যাহত থাকবে।
পঞ্চমত, উচ্চ আদালতের জবাবদিহি প্রতিষ্ঠা করতে হলে ১৯৭২ সালের ৯৬ অনুচ্ছেদ ফিরিয়ে আনতে হবে। ওই অনুচ্ছেদে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদকে দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশে সংসদ নির্বাহী বিভাগের আজ্ঞাবহ বলে এই ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের কাছেই রাখতে চান কেউ কেউ। কিন্তু আমাদের প্রশ্ন হলো, এই কাউন্সিল কি সত্যিই তার দায়িত্ব পালন করে? কোনো কোনো বিচারপতির বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ শোনা যায়, কিন্তু কাউন্সিলকে আমরা কদাচিৎ কাজ করতে দেখি। কাজেই সংসদের কাছে এ ক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়ার বিধানে আপত্তির কোনো যুক্তিসংগত কারণ নেই। এ ছাড়া সংবিধানের ৯৫ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে উচ্চ আদালতের বিচারক পদে প্রার্থীদের যোগ্যতা অবশ্যই সুনির্দিষ্ট ও বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করতে হবে। এতে সর্বোচ্চ আদালতে অযোগ্য ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের নিয়োগের সম্ভাবনা হ্রাস পাবে।
সংবিধানে আরও বহু সংশোধনীর প্রয়োজন রয়েছে। সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারগুলো আমাদের সংবিধানে যথেষ্টভাবে বর্ণিত হয়নি, সুরক্ষিতও হয়নি। সংবিধানে লিগ্যাল এইড, শ্রমিকদের জীবনধারণক্ষম ন্যূনতম মজুরি, মা ও শিশুদের জন্য বিশেষ সুযোগ-সুবিধা, পরিবেশ রক্ষা এবং ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীগুলোর সাংসৃ্কতিক অধিকারের কোনো সুনির্দিষ্ট উল্লেখ নেই। আমাদের সংবিধানে নিবর্তনমূলক আটকের বিধান ভারত বা পাকিস্তানের চেয়ে অনেক বেশি কঠোর ও স্বৈরতান্ত্রিক। সংবিধানে সংসদের ন্যূনতম অধিবেশন বা কার্যদিবসের কথা বলা হয়নি, অনুমতি না নিয়ে সংসদে একাদিক্রমে ঊননব্বই বৈঠক দিবসে অনুপস্থিত থাকার সুযোগ রয়েছে, ধর্মপালনের অধিকারের ক্ষেত্রে বৈষম্য আছে আমাদের সংবিধানে। গত কয়েক বছরে নাগরিক সমাজ, পেশাজীবী, গণমাধ্যম এমনকি বড় দুই দলের অনেক নেতা এসব বিষয়ে সংবিধান সংশোধনীর প্রয়োজনের কথা বলেছেন। এখন তা ভুলে যাওয়া ঠিক হবে না।
৩.
সংবিধান সংশোধনের পাশাপাশি আরেকটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ করার প্রয়োজন রয়েছে। আমরা ৩৯ বছর ধরে এটি করতে ব্যর্থ হয়েছি সংবিধানের সুস্পষ্ট নির্দেশনা সত্ত্বেও। যেমন—সংবিধানের ৭৬ অনুচ্ছেদে রয়েছে সংসদীয় কমিটি তার কাছে কোনো ব্যক্তিকে হাজির হতে (বা দলিল উপস্থাপনের জন্য) নির্দেশ দেবেন, এই ক্ষমতা সংসদ আইন দ্বারা কমিটিগুলোকে প্রদান করবে। বর্তমানে সংসদীয় কমিটিগুলো বিভিন্ন ব্যক্তিকে হাজির হওয়ার জন্য নির্দেশ দিচ্ছেন এ ধরনের কোনো আইন ছাড়াই। এই আইনটি করতে অসুবিধা কী? সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদে আছে, প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য কমিশনারকে রাষ্ট্রপতি ‘উক্ত বিষয়ে প্রণীত কোন আইনের বিধানাবলী-সাপেক্ষে’ নিয়োগদান করবেন। সুশাসনের স্বার্থে সংবিধানে এ রকম আরও কয়েকটি জায়গায় আইন প্রণয়নের নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু সংসদ এসব আইন প্রণয়ন করেনি। সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ পুনঃস্থাপিত হলে তার অধীনে বিচারপতিদের অপসারণের পদ্ধতিসংক্রান্ত একটি আইনও করতে হবে। এসব আইন প্রণীত না হওয়ায় শুধু বাহাত্তরের সংবিধানের চেতনা ও প্রত্যাশা খর্বিত হচ্ছে না, গণতন্ত্রের ভিতও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
১৯৭২ সালের সংবিধানের একটি মূল প্রত্যাশা ছিল সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় প্রশাসন ও বিচারব্যবস্থাকে নিয়ে যাওয়া। এর ১০০ অনুচ্ছেদে প্রধান বিচারপতিকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে হাইকোর্টের অস্থায়ী অধিবেশন বসানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এটি করা হলে সারা দেশের মানুষকে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ঢাকায় ছুটে আসার দুর্ভোগে পড়তে হতো না। গত প্রায় ৪০ বছরে আমাদের প্রধান বিচারপতিরা এই জনস্বার্থমূলক কাজটি করতে ব্যর্থ হয়েছেন। তাই বলে এ ক্ষেত্রে কি সংসদেরও কিছু করার নেই? সংবিধান সংশোধনীবিষয়ক বিশেষ কমিটি এ বিষয়ে নজর দেবে কি?

৪.
কমিটির কাছে আরেকটি অনুরোধ সংবিধান সংশোধনী বিষয়ে তাড়াহুড়ো না করার জন্য। তথ্যপ্রযুক্তি, তথ্য অধিকার, ডিজিটাল বাংলাদেশ—এসব কথা এই সরকারের কাছে আমরা সবচেয়ে বেশি শুনি। এ লক্ষ্যে সরকার কিছু গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগও নিয়েছে। সংবিধান সংশোধন কমিটি কি পারে না একটি ওয়েব পাতা খুলে এবং একই সঙ্গে নির্দিষ্ট নম্বরে ফোন ও এসএমএস করে সব নাগরিককে মতামত পেশের সুযোগ দিতে?
আমি বিশ্বাস করি, কমিটি চাইলেই তা করতে পারে। চাইলে আরও বহু ভালো নজির স্থাপন করা যায়। এই কমিটিতে সাজেদা চৌধুরী, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, তোফায়েল আহমেদের মতো ১৯৭২ সালের সংবিধানপ্রণেতারা আছেন। তাঁদের কাছে আমাদের প্রত্যাশা অনেক।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.