জনপ্রশাসন-ঘষেমেজে কত ধারালো করা যায়? by বদিউর রহমান

পাকিস্তান আমলে আমরা যেমন শুনেছি এবং পরে ওইসব নিয়োগের কর্মকর্তাদের অধীনে কাজ করে দেখেছি, নিয়োগের সময়ের বাছাইটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। চাকরির শুরু থেকে শেষ ধাপে অর্থাৎ সচিব পর্যন্ত পেঁৗছার জন্য পদসংখ্যার ভিত্তিতে প্রত্যেক পরীক্ষায় সীমিত আকারে নিয়োগ করা হতো।


ফলে অনেক প্রার্থী থেকে বাছাইয়ের মধ্যে, প্রতিযোগীর মাধ্যমে সেরা মেধাবীরাই নিয়োগ পেয়েছেন বলা চলে

বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে সচিবদের দক্ষতা নিয়ে বেশ কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে। খোদ প্রধানমন্ত্রীও সচিবদের কাজে বেশ কয়েকবার অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন থেকে শুরু করে সরকারের গৃহীত বিভিন্ন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে প্রচুর গাফিলতি সরকারের নজরে এসেছে মর্মে পত্রপত্রিকায় খবরও এসেছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মন্ত্রী-সচিবের দ্বন্দ্ব তো এমন প্রকাশ্যরূপও নিয়েছিল যে, সচিবকে তার মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য মন্ত্রী চেষ্টা করেছেন, কেউ ডিও পর্যন্ত লিখেছেন। ফলে কোনো কোনো সচিব বদলিও হয়েছেন। কেউ আরও খারাপ পরিণতিতে পড়ে ওএসডিও হয়েছেন। কিন্তু সরকারের তিন বছর পার হওয়ার পরও সচিবদের দক্ষতা নিয়ে সরকারের সন্তোষ বেড়েছে মর্মে কোনো সুসংবাদ নেই। তাহলে কি সরকার অদক্ষ সচিব নিয়ে বিপাকে আছে, না কম দক্ষ সচিবদের নিয়ে আশানুরূপ অগ্রগতি সাধনে ব্যর্থ হচ্ছে? বিষয়টি একটু পর্যালোচনা করে দেখা যেতে পারে।
সচিবদের দক্ষতার বিষয়টি দলীয় সরকারের দলীয়করণের মাপকাঠিতে না নিলে একভাবে বিবেচিত হয় এবং হবে আর দলীয়করণের বিবেচনায় নিলে তার মানদণ্ড হয়ে পড়বে ভিন্নতর। আমলাতন্ত্রকে আমলাতন্ত্র হিসেবে ধরে নিয়ে যদি দলীয়করণের প্রভাবমুক্ত বিবেচনা করা হয় তাহলে সচিবদের দক্ষতা নিয়ে কিছুটা নৈর্ব্যক্তিক বিশ্লেষণ সম্ভব হতে পারে। এ ক্ষেত্রে প্রথমেই এসে যায় সিভিল সার্ভিসের নিয়োগ প্রক্রিয়া। পাকিস্তান আমলে আমরা যেমন শুনেছি এবং পরে ওইসব নিয়োগের কর্মকর্তাদের অধীনে কাজ করে দেখেছি, নিয়োগের সময়ের বাছাইটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। চাকরির শুরু থেকে শেষ ধাপে অর্থাৎ সচিব পর্যন্ত পেঁৗছার জন্য পদসংখ্যার ভিত্তিতে প্রত্যেক পরীক্ষায় সীমিত আকারে নিয়োগ করা হতো। ফলে অনেক প্রার্থী থেকে বাছাইয়ের মধ্যে, প্রতিযোগীর মাধ্যমে সেরা মেধাবীরাই নিয়োগ পেয়েছেন বলা চলে। তখনকার কোটাও এখনকার মতো এত প্রচুর ছিল না। কোনো এক পরীক্ষায় একটি ক্যাডারে, ধরা যাক প্রশাসন ক্যাডারেই, যদি এক সঙ্গে ৪০-৫০ জনের স্থলে ৪৫০, ৫৫০, ৬৫০ কিংবা যদি যতজন পাস করেছে সবাইকে কোনো না কোনো ক্যাডারে কিংবা অন্য কোনো চাকরিতেও নিয়োগ দিতে হয় তাহলে তো গুণগত মানের 'ডাব্বা' মারা অবস্থা অস্বীকার করার উপায় নেই। ৪০ কিংবা ৪৫ শতাংশ নম্বর পেলেই তো আর হলো না, পাস নম্বরের সীমার আরও অনেক ওপরের প্রার্থীদের প্রতিযোগিতাই হতো মুখ্য। কিন্তু অতি বেশি সংখ্যায় নিয়োগের পর অনেক ব্যাচে গুণগত মান বজায় রাখা তো দূরে থাক, আগের ধারার ধারে-কাছেও থাকা যায়নি। ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে, হচ্ছে। গুণগত মান পড়ে গেছে, দক্ষতা কমে যাচ্ছে এবং গেছেও। দীর্ঘ চাকরি জীবনে অনেকেই হয়তো অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে পারেন, কেউ কেউ দক্ষও হয়ে ওঠেন, কিন্তু নিজের মেধা কম থাকলে তাকে ঘষেমেজে আর কত ধারালো করা যায়? প্রশিক্ষণে একটা আগ্রহ সৃষ্টি করা হয়তো সম্ভব, অনেক ক্ষেত্রের ঘাটতি সারিয়ে নেওয়াও হয়তো সাময়িকভাবে সম্ভব; কিন্তু মাঝারিমানের বা নিম্নমানের কর্মকর্তাকে প্রশিক্ষণ আর কত ওপরে উঠাতে পারে? ফলে নিচের মেধাবী অফিসার গরহরংঃৎু ড়ভ ঋড়ৎবরমহ অভভধরৎং রং... লিখলেও তার ওপরের কর্মকর্তা অভভধরৎং বহুবচন দেখে রং-কে ধৎব করে সংশোধন করে নিলে কী আর করা যায়? বড় কর্তাও যদি বিদেশি মহিলা প্রতিনিধিকে আপনার শরীর কেমন বাংলার ইংরেজি করে_ ঐড় িরং ুড়ঁৎ নড়ফু জিজ্ঞেস করেন তখন আমরা মুখ ঢাকি কী দিয়ে? একসঙ্গে অধিকসংখ্যক নিয়োগের এবং মেধা বাদ দিয়ে হরেকরকম কোটার কর্তারা যখন বড় পদে যাবেন/ছিলেন/আছেন তাদের মধ্যে বেশ অদক্ষতা থাকা অস্বাভাবিক নয়। 'ফালতু' কোটার বিষয়ে পরে আলাদাভাবে লেখার আশা রাখি।
নিয়োগ আর প্রশিক্ষণের পর আসা যাক পদোন্নতি প্রক্রিয়ায়। আমাদের সিভিল সার্ভিসে পদোন্নতি প্রক্রিয়া খুবই দুর্বল। প্রথম নিয়োগ পরীক্ষার সময়ের জ্যেষ্ঠতা যেন কেয়ামত পর্যন্ত পদোন্নতির জন্য মাপকাঠি হবে। পদোন্নতির জন্য পদ/সোপানের প্রত্যেক স্তরে পরীক্ষার ব্যবস্থা, পিএসসির মাধ্যমে থাকা অত্যাবশ্যক ছিল; কিন্তু সিনিয়র সহকারী সচিব পর্যায় ছাড়া আরও কোনো পর্যায়ে এ পরীক্ষা চালু করা হয়নি। একবার উপসচিব পদে (আশির দশকের শেষদিকে) পদোন্নতি পরীক্ষা চালু করতে গিয়েও তা বন্ধ হয়ে যায়। ফলে জীবনের প্রথম নিয়োগ পরীক্ষার মেধাক্রম যেন বাইবেল হয়ে আছে, কর্মক্ষেত্রে এসে যে পরে গুণগত মান অর্জনে, কাজ শেখায় তারতম্য হয়ে গেছে তা আর মূল্যায়ন হয়নি। বার্ষিক গোপনীয় অনুবেদন যোগ্যতা মূল্যায়নের প্রকৃত এবং একক মাপকাঠি হতে পারে না। কেননা এ অনুবেদন সবসময় নৈর্ব্যক্তিক হয় না। উত্তম হতো, আংশিক এ অনুবেদন বড়জোর ২৫ শতাংশ আর অবশিষ্ট ৭৫ শতাংশ যদি আবার পরীক্ষায় মূল্যায়ন হতো। অতএব, পদোন্নতি প্রক্রিয়া উন্নত মান এবং বাছাই নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হচ্ছে।
হালে পদোন্নতি প্রক্রিয়ায় দলীয়করণের যে বড় অভিযোগ বারবার উত্থাপিত হচ্ছে তা দক্ষ সচিবের অভাবকে আরও প্রকট করে তুলেছে। খালেদা জিয়ার গত আমল থেকে পদোন্নতিতে দলীয়মনা ভাবার রেওয়াজ এমনভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে যে, নিয়োগ পরীক্ষার মেধাক্রমের জ্যেষ্ঠতাও আর ধরে রাখা হয়নি। পিএসসির মাধ্যমে কোনো পরীক্ষা ছাড়া এসএসবি বারবার কীভাবে জ্যেষ্ঠতাক্রম লঙ্ঘন করে অনেক যোগ্য কর্মকর্তাকেও পদোন্নতি বঞ্চিত করেছে তার কোনো কারণ কেউ বলতে পারে না। আমি লিখিতভাবে বারবার আমাকে সচিব পদে পদোন্নতিবঞ্চিত করার কারণ জানতে চেয়েও সরকারের কাছ থেকে কোনো উত্তর পেলাম না। পরে কী আর করব, সরকারি চাকরিতে আমার 'অনুভূতি-পদোন্নতি বঞ্চনা' বইটি লিখে নিজেকে সান্ত্বনা দিলাম। আমাদের এসএসবির এমন কার্যক্রমের মূল কারণ হচ্ছে এসএসবির সভাপতি, মন্ত্রিপরিষদ সচিব এবং অন্য সদস্যদের ন্যায়পরায়ণতার অভাব, মেরুদণ্ডহীনতা এবং অনেক ক্ষেত্রে নিজ স্বার্থে সরকারকে সন্তুষ্ট রাখার অপচেষ্টা। আমি এ জন্য এসএসবিকে আইএসবি অর্থাৎ সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ডের পরিবর্তে ইনফেরিয়র সিলেকশন বোর্ড বলে থাকি। এ ধরনের দলীয় বিবেচনায় পরবর্তী দক্ষতার জন্য দুটি মারাত্মক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়। এক. যোগ্য কর্মকর্তা বাদ পড়ে গেলে তার ওপরের পদে আরও দক্ষ হওয়ার সুযোগ বন্ধ হয়ে গেল, পরবর্তী পদোন্নতিতে তিনি আর সুযোগ পেলেন না। অতএব ওপরের স্তরে দক্ষ কর্মকর্তার একটা ঘাটতি শুরু হয়ে গেল। দুই. দলীয়করণের কারণে অযোগ্য কর্মকর্তা ওপরে উঠে ওপরের স্তরে অদক্ষতার সুযোগ বাড়িয়ে দিলেন এবং পরবর্তী পদোন্নতিতে এ অযোগ্য কর্মকর্তাই আবার যোগ্য হয়ে ওপরের আরও অযোগ্যতা বাড়িয়ে দিলেন। উপসচিব থেকে যুগ্ম সচিব হয়ে অতিরিক্ত সচিব পর্যন্ত পেঁৗছে তারাই যখন সচিব হবেন তখন দক্ষতা কি আকাশ থেকে ঝরে পড়বে? আর অধিক সংখ্যক নিয়োগের জট ছাড়াতে এক সঙ্গে একই পদে, শূন্যপদ না থাকা অবস্থায়ও শত শত পদোন্নতি তো অদক্ষতাকে আরও জোরদার করে দিচ্ছে। ওপরের পদে পদোন্নতি পেয়েও আবার আগের নিচের পদে দায়িত্ব পালনের ফলে বেতন-ভাতা উচ্চতর পদের পেলেও দায়িত্ব তো নিচের পদেরই। তাহলে আর দক্ষতা বাড়বে কীভাবে? তারা যখন আবার সচিব হবেন তখন দক্ষতার মাত্রা তো বুঝতেই পারছেন। আহা! কী দুর্গতি দেখলাম অনেক কর্মকর্তার_ অতিরিক্ত সচিব হয়েও যুগ্ম সচিব পদে কাজ করছেন, সাদা কাগজের পট্টি লাগিয়ে নামফলকে যুগ্মকে ঢেকে দিয়ে অতিরিক্ত করা হয়েছে। এ পট্টি লাগানো নামফলক পরবর্তী পট্টি লাগানো দক্ষতার স্বরূপ আগেই তুলে ধরছে বলতে হবে।
তারপর আসুন পদায়নে। আমি চিনি-জানি এমন অনেক দক্ষ কর্মকর্তাকে উপযুক্ত পদায়ন দেওয়া হলো না, দেওয়া হলো দলীয়মনা বিবেচনার কোনো অপদার্থকে। তারপরও কি দক্ষতা নিয়ে আক্ষেপ করা সাজে? সরকারদলীয় বিবেচনায় পদোন্নতি-পদায়ন পছন্দ করায় কর্মকর্তারাও অনেকে এখন 'সুর' বুঝে এগোতে শুরু করেছেন, টিকে তো থাকতে হবে। অতএব দক্ষতা লাটে উঠুক, আগে তো নিজে বাঁচি, নাকি? রাজনৈতিক নেতাদের সন্তুষ্টি যদি বড় বিবেচনা হয় তাহলে দক্ষতা দেখিয়ে অপ্রিয় হওয়া বোকামি ছাড়া আর কী হতে পারে? অতএব অদক্ষরাই বেশি প্রিয় হবেন, ফলে ভবিষ্যতে বর্তমান প্রক্রিয়া অটুট থাকলে দক্ষ সচিবের আরও অভাব হবে_ এ নিয়ে হা-হুতাশ না করাই শ্রেয়।

বদিউর রহমান :সাবেক চেয়ারম্যান
এনবিআর

No comments

Powered by Blogger.