সময়ের প্রতিবিম্ব-বাঙালিত্বের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুর্ভাবনা by এবিএম মূসা

নতুন বছরের প্রথম দিন আমি মানবজটে পড়েছিলাম। ঢাকা শহরে প্রতিদিন যানজটে পড়ে আমি বিরক্ত হই, ক্রুদ্ধ হই এবং মনে মনে অনেকের মুণ্ডপাত করি। সেই যানজট এখন সহ্য হয়ে গেছে। ১০ মিনিটের রাস্তা যেতে এক ঘণ্টা সময় হাতে নিয়ে বের হই। গাড়িতে বসে গজগজ করি অথবা পত্রিকা পড়ি।


এক দিন তো গাড়িতে বসে একটি বই পড়ে শেষ করলাম। সেদিন পড়লাম মানবজটে; কিন্তু প্রতিক্রিয়া হলো ভিন্ন ধরনের। সেদিন গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছিলাম দিনের শেষ বেলায়। গত বছর রাস্তার মাঝে যানজট আর মানবজটে পড়েছি, তাও সকাল আর দুপুরের দিকে। এবার তাই বিকেলে বেরোলাম। ভাবলাম, সারা দিন টেলিভিশনে ঘরে বসে যেসব অনুষ্ঠানের লোকসমাগম দেখেছি, তারা এতক্ষণে বাড়ি ফিরে এসেছে। কিন্তু কোথায় কী, এ যে ‘ভয়াবহ’ অবস্থা। আসাদগেট থেকে বেরিয়ে ফার্মগেট, তারপর গাড়ি আর চলে না। সুনামির জলোচ্ছ্বাস নয়, এ যে জনোচ্ছ্বাস। অতীতে বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চ ভাষণ শুনতে যাওয়ার দিন, পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিনের জনস্রোত দেখেছি। কিন্তু আজকের দিনের মতো রাস্তাজুড়ে, ঢাকা শহরের সব মাঠ-উদ্যান আর কয়েকটি উন্মুক্ত জায়গায় ছড়ানো-ছিটানো উল্লাস সেসবের চেয়ে ছিল অনেক বেশি বিস্তৃত ও ব্যাপক। হাজারো নারী-পুরুষ রাস্তাজুড়ে হাঁটছে তো হাঁটছেই। বাচ্চা কোলে নারী হাঁটছে, ছেলের হাত ধরে বাবা হাঁটছে। জোড়ায় জোড়ায় যুবক-যুবতী হাঁটছে, বৃদ্ধার হাত ধরে বৃদ্ধ হাঁটছে। অনেকেই দল বেঁধে ঢোল বাজিয়ে বাঁশি ফুঁ দিয়ে নাচছে, গান গাইছে আর হাঁটছে।
মানবজটে পড়ে বিরক্তি নয়, মনে এক অদ্ভুত আবেগের ঝরনাধারা বয়ে গেল। গাড়ি-রিকশা নয়, মানবসন্তান নয়, আমাদের বাঙালিত্ব রাস্তা দখল করে আছে। এই মানবজটে আমি বাঙালিত্বের প্রসার আর বাঁধভাঙা ঢেউ দেখতে পেলাম। এই একটিমাত্র উৎসব যখন জাতি-ধর্মনির্বিশেষে, সমাজের সব শ্রেণীর আর সব বয়সের বাঙালি তার বাঙালিপনা অথবা বাঙালিয়ানা প্রকাশে উৎসাহী হয়ে উঠেছে। ঈদ মুসলমানের, পূজা হিন্দু সম্প্রদায়ের, খ্রিষ্টানের শুধু ক্রিস্টমাস। একুশে হচ্ছে বাঙালি শিক্ষিত মধ্যবিত্তের। স্বাধীনতা দিবস আর ১৬ ডিসেম্বরের বিজয় দিবস পালন এখন নিছক আনুষ্ঠানিকতা। এসবের বিপরীতে যে দিনটিকে শহর আর গাঁয়ের মানুষ, সমাজের সর্বশ্রেণী একইভাবে আপন করে নিয়েছে, সে দিনটিতে শুধু নববর্ষের আবাহন হয় না। কোটি বাঙালির জাতীয়তাবোধের সার্বিক বিস্তারের পূর্ণ প্রকাশ ঘটে। এবার এই প্রকাশের মাধ্যমে সব সামাজিক অবস্থান ও অর্থনৈতিক অন্যান্য সমস্যা ভুলে যাওয়া বাঙালির চেতনার অসাম্প্রদায়িকতার রূপ পরস্ফুিট হয়েছে। তারা একাত্তরে একটি বাঙালি জাতির নবজন্মের কথা জানিয়ে দিয়েছে। এই প্রকাশ অতীতে এমনভাবে প্রকাশিত হতে দেখিনি বলেই নববর্ষের বিচিত্র আবাহন নিয়ে এত কথায় আমার আবেগ আর অনুভূতি নিয়ে এতখানি লিখলাম।
আরেকটি অদ্ভুত ভাবনা মনে এল। গত দুই বছর যে বাঙালিত্ব প্রকাশের বিস্তৃতি ঘটেছে, তার কারণ কি বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা রাজনৈতিক দলটি ক্ষমতায় আসাতে অবাধ হয়েছে বলে? চিন্তার গভীরে গেলে তা-ই তো মনে হয়। তাই তো একই সঙ্গে শঙ্কাও হয়, এই অবারিত প্রকাশ কি আড়াই বছর পরে অটুট থাকবে? এই প্রশ্নটি মনে জেগেছে, যখন অতীতে ফিরে যাই। বাঙালি জাতীয়তাবাদকে একটি রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে পরিচিতিদানকারী বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর আমাদের বাঙালিত্ব কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। বাংলাদেশি লেবাস পরানোর কারণে বাঙালিত্বের পরিচয়টি ধীরে ধীরে ক্ষয় হতে থাকল। দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে বাঙালি জাতীয়তাবাদ একটি জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে শৃঙ্খলমুক্ত আবার পূর্ণরূপে ফিরে এল। তা সম্ভব হয়েছিল বাঙালির রাজনৈতিক দলটি, বাঙালিত্বের প্রতিষ্ঠাকারী বঙ্গবন্ধুর দলটি ক্ষমতায় পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বলে। সে রূপটিই দেখলাম এবারের পয়লা বৈশাখের মানবজটে। কিন্তু এ রূপটি আড়াই বছর পরে হারিয়ে যাবে না তো? কেন এই দুর্ভাবনা, তা সমাপ্তিতে ব্যাখ্যা করব।
বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রস্ফুটন নিয়ে এত যে কথা বললাম, তার মূলে রয়েছে দুটি ভাবনা। এক. যাঁদের ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তনের কারণে এই পয়লা বৈশাখে উপচে পড়া বাঙালিত্বের রূপ দেখেছি। তাঁরা যদি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকতে না পারেন অথবা আড়াই বছর পরে ফিরে না আসেন, তা হলে আবার কি আমরা বাঙালিত্ব হারিয়ে ফেলব? আগেই বলেছি, পঁচাত্তর-পরবর্তী দীর্ঘ সময়ে আমাদের বাঙালিত্ব ছাইচাপা পড়েছিল। আমাদের বাংলাদেশি বানানো হয়েছিল। অবশ্য আমাদের উচ্চতম আদালত সংবিধান নাগরিকত্বে সংশোধন-সম্পর্কীয় মতামতে বলেছেন, ‘আমরা বাংলাদেশি আছি, আবার বাঙালি আছি।’ ‘বাঙ্গালও আছি’ বললে বোধ হয় বিষয়টি আরও অর্থপূর্ণ হতো। যা-ই হোক, এবারের পয়লা বৈশাখে এ দেশের সর্বশ্রেণীর, সর্বমতের ও অসাম্প্রদায়িকতা এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী জনগণ পূর্ণ বাঙালিত্বের প্রকাশ ঘটাল, তা কারও কোনো নির্দেশনার কারণে নয়। গত কয়েক বছরে পাকিস্তানি মনোভাবাপন্ন বিশেষ শক্তি কোণঠাসা করে রেখেছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাঙালি জাতীয়তাবাদী সংস্কৃতিতে উদ্বেলিত জাতিকে। এবার মনে হলো পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের অবাধ দাবিতে পুরোপুরি সোচ্চার হতে পেরেছে বুদ্ধিজীবী মহল। একাত্তরের উত্তরসূরি, নতুন প্রজন্মের মাঝে আত্মচেতনার উন্মেষ ঘটেছে একই কারণে।
কথাগুলো অতি-আবেগের প্রকাশের মাঝে পাঠকদের ভালো করে বোঝাতে পেরেছি কি না, জানি না। মোদ্দা কথা হচ্ছে, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলেই বাঙালিত্বের এমনি প্রকাশের রূপ দেখতে পাই। ইংরেজিতে ভাইসভার্সা, অর্থাৎ উল্টোভাবেও বলতে পারি। নতুন প্রজন্মে বাঙালিপনার উন্মেষের কারণেই আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসেছে। কিন্তু যে বিশ্বাস নিয়ে তারা নৌকায় ভোট দিয়েছে, পরবর্তী প্রজন্ম পয়লা বৈশাখে বাঙালিত্বের পূর্ণ প্রকাশ দেখিয়েছে, আড়াই বছর পর তারা কী তা করতে পারবে অথবা করবে? প্রশ্নটি আমার একজন টেলিভিশন দর্শক-শ্রোতা করেছেন এবং উত্তরটিও দিয়েছেন। আসন্ন নির্বাচনের আড়াই বছর আগেই এই প্রশ্ন কেন, সে আলোচনাও করেছেন। প্রশ্নকর্তা জানতে চাইলেন, আওয়ামী লীগ দলটির সরকার কি বিগতপ্রায় আওয়ামী লীগের দিনগুলোতে ফেরার জন্য এখনই বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের দেওয়া ‘বাজিকর’ পরিচয়টি কি মুছে ফেলতে পারবে? শায়েস্তা খানের আমলের দরে না হলেও দ্রব্যমূল্য তাঁদের পূর্ব শাসনামলের সহনশীল পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারবে? বর্তমান সরকার পরিচালনার দিশেহারা অবস্থা দেখে কী মনে হয়? বাঙালিত্বের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবনায় তিনি প্রশ্নটি করেছেন। আমার প্রশ্নকারী টক শো শ্রোতার চাঁছাছোলা বক্তব্য ছিল, ভবিষ্যতে শুধু বাঙালি জাতীয়তাবোধের দোহাই দিয়ে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রতিষ্ঠিত করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করে শেষ করার অঙ্গীকার করে, বিদ্যুতের তার ঝুলিয়ে রেখে, সিলিন্ডার গ্যাসের ব্যবসা করে নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়া যাবে না। কারণটি জানতে হলে অতীতের কথাই ভাবুন। নৌকায় ভোট দিলে ইসলাম থাকবে না আর বউ তালাক হয়ে যাবে বলে অথবা ভারতীয় জুজুর ভয় দেখিয়ে যাঁরা ক্ষমতায় এসেছিলেন, তাঁদের সেসব দোহাই জনগণকে দীর্ঘদিন ভুলভুলানিতে ঘুরপাক খাওয়াতে পারেনি।
আমার ওপরের বক্তব্য ভিন্নভাবে ব্যক্ত করছি। আমার অনেক কলাম-পাঠক আর টক শোর দর্শক-শ্রোতা টেলিফোনে, পত্র লিখে আমি যে বর্তমান সরকারের সমালোচনা করি, তার প্রশংসা করেন। এই প্রশংসায় আমি আত্মপ্রসাদ পাই না, মনে আত্মশ্লাঘাবোধ জন্মায় না বরং চিন্তাগ্রস্ত করে। আমি তো আওয়ামী লীগের সমালোচনা বা নিন্দা করি না, আওয়ামী লীগের লেবাসধারী ‘বাজিকর’দের এবং পক্ষে যাঁরা সাফাই গান, তাঁদের শায়েস্তা করতে ব্যর্থ অথবা অনিচ্ছুক ক্ষমতাবানদের সমালোচনা করি, সঠিক কাজটি করতে বলি। গাছটি উপড়ে ফেলতে চাই না, শুধু ঝাঁকি দিতে থাকি। আমি একদিন আমার বহুদিনের প্রিয়ভাজন যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের কামরা থেকে বের হওয়ার পথে একজন নারী সাংসদ অনুযোগ করলেন, ‘আপনি আওয়ামী লীগের এত কঠোর সমালোচনা করেন কেন?’ আমি উত্তরে বলেছি, দলটি নয়, দলের সরকারের সমালোচনা করি। যে সরকার দল আর নেতা-নেত্রী দলীয় কর্মীদের আদর্শচ্যুত করেছে, তাদের দলীয় আদর্শের পথে ফিরে আসতে বলি।
কোথা থেকে কোথায় চলে এলাম। বলছিলাম কেন অনেক প্রশংসা আত্মতৃপ্তি দেয় না বরং দুশ্চিন্তাগ্রস্ত করে। ক্ষমতাসীন সরকারের কঠোর সমালোচনার পর যেসব পত্রিকার পাঠক ও টেলিভিশনের আলোচনা অনুষ্ঠানের দর্শক-শ্রোতা আমার বক্তব্যের প্রশংসা করেন, তাঁরা তো সবাই ‘ষড়যন্ত্রকারী’ অথবা আওয়ামীবিরোধী বলে মনে হয় না। বরং কথায় মনে হয় তাঁরা উদ্বিগ্ন সমর্থক, তৃণমূল পর্যায়ের নেতা-সদস্য ও শুভাকাঙ্ক্ষী পরিচয়টিই বোঝা যায়। তাঁরা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি আবার ক্ষমতায় আসতে পারবে কি না, তা নিয়ে উদ্বিগ্ন ও শঙ্কিত। তাঁরা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত অসাম্প্রদায়িকতা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, গণতন্ত্রে বিশ্বাস বাঙালি জাতীয়তাবাদের উপচে পড়া বিস্তার আবার যদি পঁচাত্তর-পরবর্তী আমলের বিপর্যয়ে পড়ে, তা হলে কী হবে? কাকে দায়ী করব এমন অঘটন ঘটলে? এসব রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি শুনে যাঁদের ক্ষমতায় বসিয়েছি, তাঁদের বিচ্যুতিকে দায়ী করব?
এসব প্রশ্নের উত্তর তাঁরা চান বঙ্গবন্ধু-কন্যার কাছে, যাঁর ওপর পিতার নীতি ও আদর্শ চিরন্তন রাখার দায়িত্ব জনগণ অর্পণ করেছে। বঙ্গবন্ধু তাঁর শাসনামলে দুঃখ করে বলেছিলেন, ‘চাটার দল সব খেয়ে ফেলছে।’ লোকে বলছে, এখন চাটার দল সব গোগ্রাসে গিলছে। এই খাওয়া-খাই বন্ধ না করতে পারলে বাঙালিত্বের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তার অবসান হবে না। পয়লা বৈশাখের উপচে পড়া বাঙালিত্বের রূপ ম্লান হয়ে যাবে। আড়াই বছর খুব কম সময় নয়, আবার বেশিও নয়।
এবিএম মূসা: সাংবাদিক ও কলাম লেখক।

No comments

Powered by Blogger.