সমাজ-উন্নয়ন-অনুকূল সংস্কৃতির সন্ধানে by মোহাম্মদ কায়কোবাদ

পৃথিবীর এক সহস্রাংশ ভূখণ্ডের বাংলাদেশে চব্বিশ সহস্রাংশ মানুষের বাস। পৃথিবীর গড় জনঘনত্বের ২৪ গুণ বেশি জনঘনত্ব। প্রাকৃতিক সম্পদের ছড়াছড়ি নেই। যাও বা কিছু প্রাকৃতিক গ্যাস আছে, তা নিজেদের দক্ষতার অভাবে বিদেশি কোম্পানিগুলো টেংরাটিলায় আর মাগুরছড়ায় পুড়িয়ে নষ্ট করলেও কার্যকরভাবে ক্ষতিপূরণ দাবি করার ক্ষমতাও


আমাদের নেই। একবিংশ শতাব্দীর বিশ্বায়নের চ্যালেঞ্জ সফলভাবে মোকাবিলা করার জন্য জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রকৌশল আর প্রযুক্তিতে বিশ্বমানের হওয়ার আর কোনো বিকল্প নেই। সীমিত সম্পদের দেশে এই বিশাল জনগোষ্ঠীর চাহিদা পূরণ সহজ নয়। এ জন্য প্রতি ক্ষেত্রেই আমাদের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করতে হবে, আবার একই সঙ্গে ভোগবিলাসও হ্রাস করতে হবে। জিডিপির হিসাবে আমাদের দেশের অগ্রগতি হলেও একসময় সমকাতারে থাকা অনেক দেশের তুলনায়ই আমরা পিছিয়ে যাচ্ছি, যার উদাহরণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া ও যুদ্ধবিধ্বস্ত ভিয়েতনাম।
দেশকে অগ্রগতির পথে নিয়ে যেতে হলে অবশ্যই উৎপাদনের পরিমাণ ভোগের থেকে বেশি হতে হবে। এক দিন হরতালে যেমন উৎপাদন ব্যাহত হয়, একই সঙ্গে সম্ভবত ভোগের মাত্রা বৃদ্ধি পায়, ঠিক তেমনি ক্রিকেটের জন্য এক দিন ছুটি ঘোষণা করলেও অর্থনীতিতে ঋণাত্মক প্রভাব পড়ে। যেকোনো বিষয় উপলক্ষ করে ভোগবিলাস ও উৎপাদনবিমুখতা একটি উন্নয়নকামী দেশের জন্য যথেষ্ট বেমানান। দেশকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য প্রতিটি উপলক্ষ কেন্দ্র করে উন্নয়ন-অনুকূল সংস্কৃতির সূচনা করতে হবে। যেসব দেশ দোর্দণ্ড প্রতাপে উন্নয়নের সিঁড়ি বেয়ে আমাদের পেছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে, তারা প্রতিটি সুযোগে উন্নয়ন-অনুকূল সংস্কৃতি সূচনা করছে। দেশ-বিদেশের নানা উদাহরণ এবং সম্ভাবনা নিয়েই আজকের লেখা।
১. শুনেছি মহাসম্পদশালী জাপানেও বিশ্বকাপ ফুটবল নিয়ে এত মাতামাতি নেই, যদিও তাদের দলের ও জাতীয় সংগীতের উপস্থিতি সেখানে রয়েছে। আমাদের দল ওই বিশ্বকাপে কবে খেলবে, তা নিয়ে একজন আশাবাদীও আশার কথা শোনাতে পারবে না। তবে আমরা যাতে নির্বিঘ্নে খেলা দেখতে পারি, এ জন্য সদাশয় সরকার বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে সদাতৎপর, যদিও হাসপাতালে বিদ্যুতের অভাবে রোগীদের সমস্যা, কারখানার উৎপাদন ব্যাহত কিংবা জমির সেচব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হলে সরকারকে ততটা তৎপর মনে হয় না। একটি হলো ভোগের জন্য সম্পদের বিনিয়োগ, আরেকটি হলো উৎপাদনের জন্য বিনিয়োগ। কোনো অবস্থাতেই উৎপাদনকে উপেক্ষা করা আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য ঠিক হবে না।
২. কথিত আছে, অধুনালুপ্ত সোভিয়েত ইউনিয়নে মহামতি লেনিনের জন্মদিন পালন করার প্রস্তাব নিয়ে কমিউনিস্ট পার্টির একদল নেতা অনুরোধ করলে তিনি সঙ্গে সঙ্গে রাজি হন এবং বলেন, তাঁর জন্মদিনের নিকটবর্তী শনিবার ছুটির দিন পার্ক ও রাস্তাঘাট পরিষ্কার করতে হবে। নেতার জন্মদিন পালনের কী উন্নয়ন-অনুকূল সংস্কৃতি! আমাদের আর আবিষ্কার করতে হবে না, শুধু অনুসরণ করলেই চলবে।
৩. এবার পয়লা বৈশাখে মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিলাম। এ উপলক্ষে শোভাযাত্রা, দেশের গানের আসর, সাজ দিয়ে নানা রকম পিঠা খাওয়ার আসর যেমন ছিল, তার সঙ্গে ছিল কম্পিউটার প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতা, যাতে অংশগ্রহণের জন্য কুমিল্লা ও গাজীপুর থেকে ছাত্রদের দল এসেছিল। পয়লা বৈশাখের আমোদ-প্রমোদের পাশাপাশি ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় প্রত্যয়ী দেশের তরুণ সম্প্রদায় প্রোগ্রামিং দক্ষতা বৃদ্ধি করছে। এ এক অসাধারণ উন্নয়ন-অনুকূল সংস্কৃতি। আশা করি, আগামী দিনগুলোতে এই সংস্কৃতির সম্প্রসারণ ঘটবে। ভাসানী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের অভিনন্দন!
৪. শুনেছি কোরিয়াতে দেশের প্রত্যেক নাগরিককেই প্রতিরক্ষা বাহিনীতে কাজ করতে হয়। সবাইকে যে গুলি-বন্দুক ব্যবহার করতে হবে, এমন নয়। যেসব তরুণ পড়ালেখায় ভালো, তাঁরা পাস করার পর নামমাত্র বেতনে প্রতিরক্ষা বাহিনীতে গবেষণা করেন। এই স্বার্থ ত্যাগের মাধ্যমে দেশের প্রতি তাঁদের মমত্ব ও ভালোবাসা তৈরি হয়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের দেশের তরুণ কিংবা প্রবীণ কোনো নাগরিকেরই দেশের জন্য ভালোবাসা তৈরিতে ত্যাগের তেমন উদাহরণ নেই। এসএসসি কিংবা এইচএসসি পরীক্ষার পর যে সময়টি অবসর থাকে অথবা স্নাতক পরীক্ষার পর ওই সময়টিতে লাখ লাখ তরুণের অফুরন্ত প্রাণশক্তি দেশের কাজে লাগানোর জন্য সরকারের একটি পরিকল্পনা থাকা উচিত। শুধু কোরিয়াতেই নয়, নানা দেশেই এ ধরনের উন্নয়ন-অনুকূল কর্মসূচি রয়েছে।
৫. অধুনালুপ্ত সোভিয়েত ইউনিয়নে গ্রীষ্মের লম্বা ছুটিতে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা পরিকল্পনা অনুযায়ী সাইবেরিয়ার দুর্গম অঞ্চলে যাওয়ার রাস্তা ও রেলপথ তৈরি করতেন, তারপর ছোট ছোট শহরও। আমাদের দেশে বনায়ন, রাস্তাঘাট কিংবা বাঁধ নির্মাণে তরুণ সম্প্রদায়কে পরিকল্পিতভাবে ব্যবহার করে দেশের উন্নয়নে অবদান রাখা যায়। দেশের উন্নয়নে প্রতিশ্রুতিশীল দল-গোষ্ঠী নিজেদের নিবেদিতপ্রাণ কর্মীদের এসব কাজে অংশগ্রহণে উৎসাহিত করতে পারলে একদিন নিশ্চয়ই সাধারণ মানুষও এ রকম উন্নয়ন-অনুকূল কর্মকাণ্ডে অবদান রাখবে। একই সঙ্গে দেশের কাজে ভবিষ্যৎ নেতাদের এই ত্যাগ সাধারণ মানুষকে উৎসাহিত করবে।
৬. রাজধানীর দুর্বিষহ যানজটকে বিবেচনায় রেখে স্কুল-কলেজে ভর্তিগুলো অন্তত এলাকাভিত্তিক করা উচিত। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশেও এই পদ্ধতি চালু আছে, যেখানে সহোদরের উপস্থিতিকেও বিবেচনায় আনা হয়। এই একই পদ্ধতি অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি, কানাডা কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের মতো গণতান্ত্রিক দেশে যেহেতু চালু আছে, আমাদের গণতান্ত্রিক অধিকার ক্ষুণ্ন হওয়ার অভিযোগ ধোপে টিকবে না। তা ছাড়া এ পদ্ধতি চালু হলে তো ভিকারুননিসা আর নটর ডেম কলেজে ভারত আর পাকিস্তান থেকে ভর্তি হবে না, কোনো না কোনো বাংলাদেশি ছেলেমেয়েরা ভর্তি হবে। এতে রাজধানীর যানজট যেমন হ্রাস পাবে, ঠিক তেমনি ছাত্রদের রাস্তায় অলস সময় এবং ভোগান্তিও। যাত্রীদের উৎপাদনশীল সময় বৃদ্ধি পাবে, সঙ্গে সঙ্গে যানবাহনের খরচ হ্রাস পাবে।
৭. সরকারের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করার জন্য সংসদে যোগদান না করা কিংবা হরতাল ডাকার উন্নয়ন-প্রতিকূল সংস্কৃতি আমাদের দেশে যুগের পর যুগ চালু রয়েছে। সরকারি কর্মকাণ্ডে বিরোধী দলের ক্ষোভ প্রকাশের একটি উন্নয়ন-অনুকূল ভাষা আবিষ্কারের প্রয়োজন। আরও দুঃখজনক হলো, সাধারণ মানুষের প্রতিনিধিরা মহান জাতীয় সংসদে উপস্থিত না থাকলেও সব সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করেন, ভোগে এক বিন্দু কমতি নেই, ত্যাগ করারও বাসনা নেই। দেশের সাধারণ মানুষ যাঁদের জনপ্রতিনিধি করে, তাঁরা নিজেদের দেশপ্রেম দিয়ে আমাদের উজ্জীবিত করবেন—এটাই সবার প্রত্যাশা। আমাদেরই দেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণা জন্ম ও বাস্তবায়ন হয়েছে; আশা করি, এবার হরতাল ও কর্মবিমুখ কর্মসূচির পরিবর্তে উন্নয়ন-অনুকূল কোনো সংস্কৃতিরও সূচনা হবে ।
৮. বেশ কয়েক বছর ধরে বাসের জন্য লাইন ধরে দাঁড়ানোর যে নিয়ম চালু হয়েছে, তা নিঃসন্দেহে একটি ইতিবাচক সংস্কৃতি। সাধারণ মানুষ আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তবে অসাধারণ মানুষের গাড়িগুলো যখন লাইন ভেঙে সিএনজি নেয়, তখন এই অশুভ সংস্কৃতি নিশ্চয়ই একদিন সাধারণ মানুষকেও আইনের প্রতি অশ্রদ্ধাশীল করে তুলবে। সমাজের নেতৃস্থানীয় মানুষ সাধারণ মানুষকে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে অনুপ্রাণিত করবে আইন পালন করেই—এই আমাদের কাম্য।
৯. সরকারি দল কিংবা বিরোধী দলের জনসভাকে কেন্দ্র করে পথিক কিংবা যাত্রীদের দুর্ভোগ কম নয়। সেই দুর্ভোগ অবশ্য জাতিরও। কারণ, নাগরিকেরা যখন তাদের উৎপাদনশীলতা রাস্তার যানজটে হারায়, তখন দেশ উন্নয়ন তৎপরতা বঞ্চিত হয়। নাগরিকদের যা বলার, উদ্বুদ্ধ করার, বোঝানোর থাকে, তা বিভিন্ন স্টেডিয়াম অথবা পার্ককে জনসভার স্থান হিসেবে নির্বাচন করলে জনভোগান্তি অনেকখানি কমে আসবে।
১০. বিগত কয়েক বছর অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের নানা কর্মতৎপরতা লক্ষ করা যাচ্ছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় ধ্বংসকে একমাত্র হাতিয়ার হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। আমাদের মতো উন্নয়নকামী দেশে সম্পদ ধ্বংস করে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার আগে ভাবা উচিত, দেশে কি এটাই বেআইনি কাজের সর্বশেষ নজির? নদীর তীরে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা হালকা স্থাপনা, বেআইনিভাবে নদীর বালু উত্তোলনসহ অনেক অবৈধ কাজে অথবা নানা উপলক্ষে, নানা স্থানে চাঁদাবাজি কিংবা টেন্ডারবাজি থেকে দেশকে মুক্ত করতে বিশাল মাপের ধ্বংসের প্রয়োজন হবে না। বিমানবন্দর দিয়ে যাত্রীরা যখন অবৈধ মালামাল নিয়ে প্রবেশ করে, তখন সরকার তা ক্রোক করে নেয়, ধ্বংস করে না। এ রকম ধ্বংস না করে, বাংলাদেশকে অধিকতর দরিদ্র না করে, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার বিকল্প ও অভিনব পদ্ধতি কাম্য।
আসুন, বাংলা বর্ষের শুরুতে আমরা সবাই উন্নয়ন-অনুকূল সংস্কৃতির সূচনায় মেতে উঠি, উন্নয়ন-প্রতিকূল সংস্কৃতি পরিহার করি। এমন সংস্কৃতির সূচনায় সরকার অগ্রপথিক হয়ে সাধারণ মানুষকে উদ্বুদ্ধ করুক, উজ্জীবিত করুক, উৎসাহিত করুক।
মোহাম্মদ কায়কোবাদ: অধ্যাপক, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ও ফেলো, বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্সেস।

No comments

Powered by Blogger.