চারদিক-বয়স্বী কল্যাণ সমিতির মিলন আলয় by মাহফুজ রহমান

ধরা যাক, তাঁর নাম রোকেয়া বেগম। তাঁর এখন বয়স ৬২ চলছে। তন্ময়ের বয়স আট। তাদের দুজনের সম্পর্ক দাদি-নাতি। মাস দুয়েক আগে রুদ্র, মানে তন্ময় রহমান দাদির জন্য একটা গান লিখেছিল। রোকেয়া বেগম যতটুকু মনে করতে পারেন, গানের কথাগুলো ছিল এ রকম,


‘ও আমার দাদুমণি, তুমি আমার চোখের মণি...’ তারপর? প্রবীণ রোকেয়া বেগম স্মৃতি হাতড়াতে থাকেন, মনে করতে পারেন না। তবে গানের সারমর্মটা ব্যাখ্যা করেন খানিকক্ষণের নীরবতা ভেঙে, ‘নাতিটা আমাকে পেলে যেন হাতে চাঁদ পায়। সারাক্ষণ আমার সঙ্গে থাকবে, গল্প শুনতে চাইবে, খাইয়ে নেবে। ও গানে গানে বলতে চেয়েছিল—তুমি চলে যেয়ো না...!’
আট বছরের তন্ময় বলেছিল, চলে যেয়ো না। কিন্তু, শেষমেশ আদরের নাতিটিকে ছেড়ে চলে আসতে হয়েছে রোকেয়া বেগমের। ছেলের আলয় ছেড়ে তিনি এখন আছেন ঢাকার শ্যামলীর প্রবীণ আবাসন ‘মিলন আলয়’-এ। স্বামী গত হলেও একটি যোগ্য ছেলে আছে তাঁর। কিন্তু ছেলের হাতে অত সময় কই যে তাঁকে দেখেশুনে রাখবে? নচিকেতার ‘বৃদ্ধাশ্রম’ গানটির কথাগুলো মনে আছে নিশ্চয়ই? ফের মনে করিয়ে দিই, ‘ছেলে আমার, আমার প্রতি অগাধ সম্ভ্রম/ আমার ঠিকানা তাই বৃদ্ধাশ্রম!’ রোকেয়া বেগমের সঙ্গে গানের কথাগুলো খুব ভালো যায়। আরও অনেকের সঙ্গেই হয়তো যায়।
রোকেয়া বেগমের মতো কত অসহায় প্রবীণই যে আমাদের দেশে আছেন, এর কোনো লেখাজোখা নেই। সংখ্যাটি যে ক্রমবর্ধমান, তা অবশ্য সহজেই অনুমেয়। জীবন বাজি রেখে মানুষ করেছেন যে সন্তানকে, সেই সন্তান সব ভুলে বসে আছে। মা-বাবার শেষ জীবনে ঠেলে দিচ্ছে আরেক জীবনের বাজিতে! কিন্তু জীবনবাজি যে বড় কঠিন বাজি! যেখানে টগবগে তরুণেরাই নাজেহাল, সেখানে প্রবীণেরা কোন ছার! অগত্যা উপায় কী? ধুঁকে ধুঁকে বেঁচে থাকা, কিংবা বেঁচে মরে থাকা!
ভাগ্যহত এই প্রবীণদের জন্য কী করা যায়? ২০০৭ সালে এমন একটা প্রশ্ন উঁকি দিয়েছিল কয়েকজন সমমনা শিক্ষক, চিকিৎসক ও প্রকৌশলীর মনে। প্রশ্নের সমাধান খুঁজলেন তাঁরা। সমাধানের একটা রাস্তাও বের করে ফেললেন ২০০৭-এর ডিসেম্বরে। সমাজের অবহেলিত ও অসহায় প্রবীণদের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য তাঁরা প্রতিষ্ঠা করলেন ‘বয়স্বী কল্যাণ সমিতি’। ঠিক করা হলো, বয়স্বী কল্যাণ সমিতি প্রবীণদের শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা, তাঁদের আনন্দঘন নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থার সঙ্গে চিকিৎসার সুব্যবস্থার জন্যও কাজ করবে। সমিতির সভাপতি শহীদ ডা. মিলনের মা সেলিনা আখতার। বললেন তাঁদের কার্যক্রম সম্পর্কে, ‘বয়স্বী কল্যাণ সমিতি প্রবীণদের শারীরিক-মানসিক সুস্থতার জন্য কাজ তো করছেই, পাশাপাশি বয়স্বী মানে প্রবীণদের অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান ও সৃজনশীলতাকে কাজে লাগিয়ে তাঁদের সামাজিক ও দেশীয় উন্নয়নের কাজে নিয়োজিত করার জন্য কাজ করছে। প্রবীণদের সামাজিক অধিকারগুলো বাস্তবায়ন করতেও পরিশ্রম করছেন সমিতির সদস্যরা।’
বয়স্বী কল্যাণ সমিতির এই কার্যক্রমের মধ্যে একটি হলো প্রবীণ আবাসন। গত বছর থেকে চালু হওয়া এই আবাসনের নাম ‘মিলন আলয়’। শ্যামলীর ছোট্ট একটি ফ্ল্যাটে পাঁচটি আসন দিয়ে শুরু হয়েছে তাদের পথচলা। তবে এই আবাসন এখন কেবল নারীদের জন্যই। দুজন সার্বক্ষণিক পরিচর্যাকারী ও একজন ব্যবস্থাপক দেখভাল করছেন মিলন আলয়ের প্রবীণদের। নিয়মিত চিকিৎসাসেবাও দেওয়া হয় এখানে। সমিতির চিকিৎসক সদস্যরা সপ্তাহে অন্তত একবার হলেও দেখে যান প্রবীণদের। প্রবীণদের জন্য আরও বিভিন্ন সেবার ব্যাপারে বললেন সমিতির সাধারণ সম্পাদক শামীম ফারুক, ‘মিলন আলয়ের প্রবীণদের জন্য হেলথ অ্যান্ড হোপ হাসপাতালে ৩০ শতাংশ কম মূল্যে প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষার ব্যবস্থা করেছি আমরা। ১৫২/১, এইচ গ্রিন রোড, পান্থপথে এই হাসপাতাল। সেখানে প্রতিদিন সকাল নয়টা থেকে বেলা আড়াইটা পর্যন্ত এই সেবা দেওয়া হয়। দরকার হলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছেও নিয়ে যাওয়া হয় প্রবীণদের। আবাসনে একজন প্যারামেডিকস আছেন। মুমূর্ষু রোগীদের হাসপাতালে স্থানান্তরের জন্য অ্যাম্বুলেন্সের সুবিধাও পাওয়া যাবে আমাদের এখানে। আর নিঃসম্বল প্রবীণ রোগীদের জন্য বিনা মূল্যে স্বাস্থ্যসেবা তো আছেই।’
বয়স্বী কল্যাণ সমিতির আরও কাজের মধ্যে শীতার্ত মানুষের মধ্যে শীতবস্ত্র বিতরণ, জাকাত তহবিল থেকে আর্থিক সহায়তা ও হেলথ ক্যাম্পেইন অন্যতম। ঢাকার অদূরে মিজমিজি গ্রামে নিয়মিতভাবে বিনা মূল্যে চিকিৎসাসেবা ও ওষুধ বিতরণ করে আসছে প্রতিষ্ঠানটি। এ ছাড়া প্রবীণদের অধিকার নিশ্চিত করার জন্য সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছে। ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে বললেন সেলিনা আখতার, ‘প্রবীণ আবাসন মিলন আলয় এখনো সম্পূর্ণ সমিতির সদস্যদের অনুদান দিয়ে চলছে। এই প্রতিষ্ঠান যদি আরও ভালোভাবে দাঁড়াতে পারে, প্রবীণদের জন্য খুব ভালো হবে। মিলন আলয়ের পাশে প্রবীণদের জন্য একটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার কথাও আমাদের পরিকল্পনায় আছে। দেশে প্রবীণদের জন্য আলাদা হাসপাতাল নেই। তাই সরকার এক খণ্ড জমি দিয়ে আমাদের সহযোগিতা করলে খুবই ভালো হতো। আমাদের সবাইকে তো একদিন প্রবীণ হতে হবে। এটা নিয়ে যদি সবাই ভাবেন, তাহলে এই সমস্যার সমাধান খুব সহজেই হয়ে যায়।’
বয়স্বী কল্যাণ সমিতি এবং মিলন আলয়ের সঙ্গে যোগাযোগ: ০১৭১৩০৪১২৪১, ০১৭১১৭০৪৪৫৮ ও ০১৭১১৫৩৪৯৩০।
মাহফুজ রহমান

No comments

Powered by Blogger.