দুই দু’গুণে পাঁচ-অর্থ অনর্থের মূল by আতাউর রহমান

আমরা বাল্যকালে বলাবলি করতাম, ‘পৃথিবীটা কার বশ?’ বলা বাহুল্য, এটা একটা ধাঁধা এবং ধাঁধার উত্তর প্রশ্নটির মধ্যেই নিহিত—পৃথিবী টাকার বশ। আর যৌবনকালে সিনেমায় গান শুনেছিলাম, ‘টাকা তুমি দেখতে গোল/ করো যত গন্ডগোল...’ ইত্যাদি।

সেদিন সিনেমায় যিনি ‘লিপ-সিং’ করেছিলেন, সেই জলিল সাহেব এখন ধানমন্ডিতে আমার প্রতিবেশী। জীবদ্দশাতেই তিনি দেখতে পাচ্ছেন, এখনকার নিকেলে তৈরি গোলাকার এক টাকার মুদ্রার মান তখনকার তামার তৈরি এক পয়সার সমান হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অবশ্য টাকা-পয়সা ছাড়া আমাদের এক দিনও চলে না। অথচ কিছুদিন আগে পত্রিকায় পড়েছিলাম, এই ধারণা ভ্রান্ত বলে প্রমাণের জন্য মার্ক বয়েল নামের এক ইংলিশ যুবক ২০০৮ সালের নভেম্বর থেকে টাকা-পয়সা খরচ পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছেন—তিনি ব্রিস্টলের একটি কৃষি খামারের সন্নিকটে মুফতে পাওয়া এক ক্যারভানে বাস করেন, খামারে নিজের খাদ্য নিজেই ফলান ও তা রান্না করেন স্বয়ং সংগৃহীত লাকড়ির চুলোয়, বিদ্যুৎ পান একটি সৌর প্যানেল থেকে, টুথপেস্ট-সাবান ইত্যাদিও প্রাকৃতিক উপাদান দিয়ে তৈরি করে থাকেন; আর তাঁর মোবাইল ফোনেও তিনি শুধু ইনকামিং কলের ব্যবস্থা রেখেছেন। তিনি এভাবে কত দিন চালিয়ে যেতে পারবেন, সেটাই আপাতত আমাদের ঔৎসুক্যের বিষয়।
সে যাক গে। কেউ যদি কেবলই টাকা-পয়সার পেছনে ছোটে, তাহলে তাকে আমরা বলি টাকাপাগল; যদি সে এটা জমিয়ে রাখে, তাহলে সে পুঁজিবাদী; যদি সে যথেচ্ছ খরচ করে, তাহলে সে অমিতব্যয়ী; যদি সে এটা না পায়, তাহলে সে নিষ্কর্মা; যদি সে এটা প্রাপ্তির প্রচেষ্টা প্রত্যাহার করে, তাহলে সে উচ্চাকাঙ্ক্ষাহীন; আর যদি সে কোনো পরিশ্রম ছাড়াই এটা পায়, তাহলে সে পরজীবী। এবং সে যদি সারা জীবন পরিশ্রম করে এটাকে পুঞ্জীভূত করে, লোকেরা যখন বলাবলি করতে থাকে যে সে একজন অপদার্থ, যে জীবন থেকে কিছুই পেল না। তবে হ্যাঁ, কৃপণদের সঙ্গে জীবনযাপন কষ্টকর হলেও পূর্বপুরুষ হিসেবে ওরা যে মহান, সেটা বুঝিয়ে বলার অপেক্ষা রাখে না।
বিশ্বের তাবৎ গুণী আর ধনী ব্যক্তি কিন্তু টাকা-পয়সা সম্পর্কে অনেক মজার কথা বলে গেছেন। সবাইকে উদ্ধৃত করতে গেলে সাতকাহন হয়ে যাবে; আপাতত গুটি কয়েকের মন্তব্য উপস্থাপন করছি। সর্বাগ্রে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ; তিনি বলেছেন, ‘টাকা যে মানুষ জমিয়েছে, অনেক পাপ জমিয়েছে সে তার সঙ্গে (সাধে কি আর বলা হয়, লাখকে মেরেই তবে লাখপতি)।’ অতঃপর অমর কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র; তিনি বলেছেন, ‘মানুষ খাঁটি কি-না চেনা যায় শুধু টাকার সম্পর্কে। এ জায়গায় নাকি ফাঁকি চলে না। তাই এখানেই মানুষের যথার্থ রূপ প্রকাশ পায়।’ মহামতি ভলটেয়ারও বলেছেন, ‘যখন প্রশ্নটা টাকা-পয়সার, সবার ধর্ম একই।’
কিন্তু এগুলো তো বেশ গুরুগম্ভীর কথা, হালকা মেজাজের কথার জন্য আমাদের যেতে হবে অন্যত্র। সমারসেট মম্ বলেছেন, ‘টাকা-পয়সা হচ্ছে ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের মতো, ওটা ছাড়া অন্য পাঁচটা পূর্ণতা পায় না।’ ফ্রান্সিস বেকন বলেছেন, ‘টাকা-পয়সা হচ্ছে ভেজা গোবরের মতো, ছড়িয়ে না দিলে মোটেও সুখদ হয় না।’ আর ধনকুবের হেনরি ফোর্ড নাকি বলেছিলেন, ‘টাকা-পয়সাকে বাহু বা পায়ের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে—হয় এটাকে ব্যবহার করো, নয় এটা অকেজো বা নষ্ট হয়ে যাবে।’
ধর্মগ্রন্থ বাইবেল-এ বলা হয়েছে, ‘একজন ধনবান ব্যক্তির পক্ষে ঈশ্বরের রাজ্যে প্রবেশ করা একটি সুচের ছিদ্র দিয়ে উট প্রবেশ করার চেয়েও কঠিন।’ বাইবেল-এ আরও বলা হয়েছে, ‘অর্থের প্রতি ভালোবাসা সকল অনর্থের মূল।’ তো, জর্জ বার্নার্ড শ ছিলেন বিদ্রূপাত্মক রসিকতায় পারঙ্গম; এটা শুনে তিনি বললেন, ‘অর্থহীনতাই সকল অনর্থের মূল।’
এতক্ষণ মজার মন্তব্যগুলো তুলে ধরা হলো, এবারে মজার উপাখ্যানগুলোর দিকে দৃষ্টি ফেরানো যাক: এক সুইস ও এক ফরাসিতে কথাবার্তা হচ্ছিল। একপর্যায়ে ফরাসি ফোড়ন কাটল, ‘তোমরা সুইসরা সব সময় টাকার জন্য যুদ্ধ করো, আমরা ফরাসিরা করি সম্মানের জন্য—এটা কেন? প্রত্যুত্তরে সুইস বলে উঠল, ‘আমার মনে হয়, যার যেটা নেই, সে সেটার জন্য যুদ্ধ করে থাকে। দুই, এক সন্ত্রাসী জনৈক পথচারীর গায়ে পিস্তল ঠেকিয়ে বলেছিল, ‘হয় তোমার টাকা, না হয় তোমার জীবন।’ সঙ্গে সঙ্গে লোকটা বলল, ‘জীবনটাই নাও, আমি আমার বুড়ো বয়সের জন্য টাকা জমাচ্ছি।’ তিন, ছেলেদের ক্লাসে শিক্ষক বললেন, ‘কাগজ-কলম নাও এবং রচনা লিখো—আমি যদি কোটিপতি হতাম।’ সবাই তড়িঘড়ি করে লিখতে শুরু করে দিল; কিন্তু একজন চুপচাপ বসে আছে দেখে শিক্ষক প্রশ্ন করলেন, ‘তুমি লিখছো না কেন?’
‘আমি আমার সেক্রেটারির জন্য অপেক্ষা করছি’—ছেলেটি চটপট জবাব দিল। তা সত্যিই তো, সবকিছু সম্পাদনের জন্য একজন সেক্রেটারি না থাকলে কোটিপতিকে মানায়?
আর হ্যাঁ, এটা অবশ্য সত্যি যে যার টাকা-পয়সা নেই, সে গরিব। তবে এর চেয়ে বড় সত্যি হচ্ছে এই যে যার কেবল টাকা আছে আর কিছুই নেই, সে অধিকতর গরিব। একসময় ছিল যখন বলা হতো, বোকাদের হাতে টাকা-পয়সা বেশিক্ষণ থাকে না; কিন্তু বর্তমানে সবার বেলায়ই এটা ঘটে থাকে। সাধে কি আর বলা হয়, এ দেশে আমরা দিন দিন অধিকতর বলবান হচ্ছি—২০ বছর আগে বাইশ শ টাকার কাঁচাবাজার বহন করতে অন্তত দুজন লোক লাগত, এখন একটা শিশুই সেটা বহন করে নিয়ে আসতে পারে। আর টাকা-পয়সার সঙ্গে বিদ্যা-বুদ্ধিরও অনেকটা সাদৃশ্য আছে—আপনার কত কম আছে, সেটা যদি আপনি প্রকাশ না করেন তাহলে লোকেরা আপনার সঙ্গে এমন ব্যবহার করবে যেন আপনার অনেক আছে। সর্বোপরি, আপনার ধর্ম আপনাকে শেখায়, সংসারে টাকা-পয়সাই সবকিছু নয়; কিন্তু আপনার সরকার আপনাকে বলতে থাকে, ওটাই সবকিছু। এ বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসার কোনো উপায় কারও জানা আছে কি না, আমার জানা নেই।
পুনশ্চ: সম্প্রতি যৌন নির্যাতনের অভিযোগের মুখে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) প্রধান দমিনিক স্ত্রস কান পদত্যাগ করেছেন। এর আগে নিউইয়র্কের একটি হোটেলে এক নারী কর্মীকে ধর্ষণের চেষ্টার অভিযোগে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের পুলিশ কর্তৃক গ্রেপ্তার হন। এটাও ‘অর্থই সকল অনর্থের মূল’ এ কারণে কি না, কে জানে।
আতাউর রহমান: রম্য লেখক। ডাক বিভাগের সাবেক মহাপরিচালক।

No comments

Powered by Blogger.