অর্থনীতির স্বার্থে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও ঐকমত্য দুই-ই জরুরি by এম হাফিজউদ্দিন খান

একটি দেশের জন্য সুস্থ ও গঠনমূলক রাজনীতি সর্বাগ্রে জরুরি। রাজনীতির সুস্থ ধারা অর্থনীতিসহ সব কিছুর বিকাশে অপরিহার্য শক্তিও বটে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের রাজনীতি বড় বেশি ব্যক্তি, গোষ্ঠী, দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে পরিচালিত হয়। অথচ এ দেশের রাজনৈতিক অর্জন অনেক।

কী কারণে, কাদের ব্যর্থতায় এ অর্জনের বিসর্জন ঘটছে এর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ নতুন করে নিষ্প্রয়োজন। কারণ সচেতন মানুষ মাত্রই এসব জানেন। রাজনৈতিক অস্থিরতার বিরূপ প্রভাব বহুমুখী এবং এ দেশে এর অজস্র দৃষ্টান্ত রয়েছে। নানাবিধ সমস্যাসক্রান্ত এ দেশের বড় সমস্যা রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, জাতীয় ইস্যুতে ঐকমত্যের অভাব এবং পারস্পরিক যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতা। এসবই গণতন্ত্রের জন্য অমঙ্গলজনক। স্বাধীনতা-উত্তর বিপর্যস্ত দেশটিকে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ করার যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল, তা ত্রুটিমুক্ত ছিল না। এ ক্ষেত্রে বড় ভুল নীতিগত সিদ্ধান্তের বারবার পরিবর্তন। তার পরও অগ্রগতি তো ছিলই উল্লেখযোগ্য না হলেও। একাত্তরে কোরিয়া ও আমাদের অর্থনৈতিক চিত্র একই ছিল; কিন্তু আজ সে ক্ষেত্রে যোজন যোজন দূরত্ব। তাদের তো কোনো রিসোর্সই ছিল না; অথচ আমাদের রিসোর্চ থাকা সত্ত্বেও আমরা তা পারিনি। কারণ দুর্নীতি নামক ব্যাধি আমাদের সব অর্জন কুরে কুরে খেয়েছে। প্রচুর বিদেশি সাহায্য আমরা পেয়েছি; কিন্তু এর সদ্ব্যবহার হয়েছে কতটা? বিশ্বের অনেক দেশ বিদেশি সাহায্য-ঋণ নিয়ে নিজ পায়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা ঋণ নেওয়া কিংবা গ্রহণের ক্ষেত্রে শর্তের ব্যাপারে যেমন সতর্ক থাকতে পারিনি, তেমনি এর সুষ্ঠু ও যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতেও ব্যর্থ হয়েছি। বিদেশি ঋণের প্রয়োজনীয়তা নেই আমি সে কথা বলব না; কিন্তু বিদেশি ঋণের ক্ষেত্রে করণীয় কী তা উল্লেখ করেছি। আমাদের অগ্রগতি হয়নি সে কথাও বলব না। অর্থনীতি বড় হয়েছে; কিন্তু এ পথে বারবার বাধার প্রাচীরও সৃষ্টি হচ্ছে। জনশক্তি ও গার্মেন্ট খাত আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম বড় খাত। কিন্তু এই দুটি খাত বাধাগ্রস্ত হয়েছে এবং হচ্ছে সুস্থ রাজনৈতিক চর্চার অভাবের কারণেই। তবুও এ দুটি খাত জাতীয় অর্থনীতিতে ব্যাপক অবদান রাখছে। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগচিত্র বিবর্ণ। অর্থনীতির ভেতর একধরনের ক্ষরণ চলছে। তা থেকে পরিত্রাণের সঠিক পথ অনুসরণ করা হচ্ছে না। আর্থিক ব্যবস্থাপনায় বিশৃঙ্খলার চিত্রও দেখা যাচ্ছে। সরকারের আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হচ্ছে। উৎপাদনশীল খাতে ব্যয়ের পরিমাণ কম। অনুন্নয়ন ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর মধ্যে রাজনৈতিক অস্থিরতা বৈরী প্রভাব বিস্তার করছে। গ্যাস-বিদ্যুৎ-অবকাঠামোগত সমস্যা সংকটের পাশাপাশি রাজনৈতিক অস্থিরতা বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ দমিয়ে দিচ্ছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিরও অবনতি ঘটাচ্ছে এবং আইনশৃঙ্খলাজনিত যেসব চিত্র প্রায় নিত্য চোখে পড়ছে, তা উদ্বেগজনক। এমতাবস্থায় বছরে সাত শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব হবে না। রপ্তানি প্রবৃদ্ধিও নিম্নমুখী। জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে জনকল্যাণের রাজনীতি নিশ্চিত করার দায় প্রত্যেক রাজনীতিকের। অর্থনীতি রাজনীতিঘনিষ্ঠ। রাজনীতি সুস্থ না হলে অর্থনীতি অসুস্থ হবেই। এসব বিষয়ে রাজনৈতিক ঐকমত্য যার অভাব বারবারই প্রকটভাবে পরিলক্ষিত হয়েছে। একটি গণতান্ত্রিক সমাজ কিংবা রাষ্ট্রে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতের অমিল থাকতেই পারে, চিন্তার দূরত্বও খুব স্বাভাবিক; কিন্তু জাতীয় স্বার্থের ব্যাপারে ঐকমত্যের অভাব থাকবে কেন? এই চিত্র তো দেশ-জাতির উন্নয়ন-অগ্রগতির পথে অবশ্যই বড় বাধা হয়ে আছে। দেশের অর্থনীতি চাপে রয়েছে তাতে সন্দেহ নেই। মূল্যস্ফীতির চাপের সঙ্গে আমাদের মোকাবিলা করতে হচ্ছে বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জও। সরকারের আয়-ব্যয়ে কাঠামোগত অসংগতিও বেশ বড়। বিদ্যমান নানা সংকট নিরসনের জন্য চাই দূরদর্শী রাজনৈতিক উদ্যোগ এবং এ ক্ষেত্রে দায় শুধু সরকারের একার নয়। তবে সরকারকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। একলা চলো নীতির অবসান ঘটাতে হবে। গণতন্ত্রে এমনটির স্থানও নেই। অহেতুক ইস্যু সৃষ্টি না করে বাদানুবাদ বর্জন করে অর্থনীতিসহ উন্নয়ন-অগ্রগতির সব দিক কণ্টকমুক্ত না করতে পারলে এর জন্য আরো কঠিন মূল্য আমাদের দিতে হবে, যা কোনোভাবেই কোনো বিবেকবান মানুষের কাম্য হতে পারে না। দুর্নীতি নির্মূলে অবস্থান কঠোর করা চাই। অর্থনীতির অগ্রগতি বলি কিংবা বলিষ্ঠতার কথাই বলি না কেন, এ ক্ষেত্রে সুষ্ঠু, স্বচ্ছ, পরিকল্পিত নীতিমালা প্রণয়ন এবং এর বাস্তবায়ন জরুরি। রাজনৈতিক বিবেচনায় অর্থনৈতিক প্রকল্প গ্রহণ করলে এর বাস্তবায়নে যে ব্যয় হবে, তা আরো সমস্যা-সংকটের সৃষ্টি করবে। আমাদের সম্পদ খুব সীমিত। এর যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করার প্রয়োজনে দুর্নীতি নির্মূলে অঙ্গীকার দৃঢ় করতেই হবে। অর্থনীতি তো এমনি এমনিই চাঙ্গা হবে না। অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার কাজগুলো করতে হবে সুষ্ঠু ও সফলভাবে। স্বনির্ভর অর্থনীতি গড়ে তুলতে প্রয়াস চালাতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.