লিখিত রায়েই সমাধান সূত্র! by আহমেদ দীপু

ত্রয়োদশ সংশোধনীর লিখিত রায়ের আলোকে নির্বাচনকালীন সরকারের কাঠামো চূড়ান্ত করা হতে পারে। এ জন্য প্রয়োজন হলে সংবিধানও সংশোধন করা হবে। রায়ের লিখিত কপির ভিত্তিতে পদক্ষেপ নিলে রাজনৈতিক সংকট নিরসন অনেকটা সহজ হবে- এ ভাবনা থেকে সরকারও রায়ের লিখিত কপির জন্য অপেক্ষা করছে।

সরকারের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে কথা বলে এমন আভাসই পাওয়া যাচ্ছে। এ থেকে মনে হচ্ছে, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করার ইস্যুতে অনড় অবস্থান থেকে সরকার খুব ধীরে হলেও সরে আসছে।
গত বছর তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক ত্রয়োদশ সংশোধনী-সংক্রান্ত মামলায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি অবৈধ বলে রায় দেন। বর্তমানে অবসরে থাকা বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক এই রায় লিখছেন। খুব শিগগির রায় প্রকাশ করা হবে। সাবেক প্রধান বিচারপতির ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র কালের কণ্ঠকে বলে, লিখিত রায়ে যা থাকছে, তাতে জনগণের জন্য মঙ্গলজনকই হবে। রায় অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হলে দেশের রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান সহজ হবে। দেশের মানুষের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। গণতন্ত্রের ধারা অব্যাহত থাকবে।
বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি অবৈধ বলে রায় দিলেও প্রয়োজনে এই পদ্ধতি আরো দুই মেয়াদে অব্যাহত রাখার বিষয়টি উল্লেখ করেন। এই রায়ের পরপরই তিনি অবসরে চলে যান বলে লিখিত রায় প্রকাশ করে যেতে পারেননি। ওদিকে সরকার ওই সংক্ষিপ্ত রায়ের পর পরই শুধু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পদ্ধতিটি বিলুপ্ত করে জাতীয় সংসদে সংবিধান সংশোধন-সংক্রান্ত বিল পাস করে।
রায়ের লিখিত কপি হাতে পাওয়ার পর সব কিছু পরিষ্কার হয়ে যাবে বলে সরকারের নীতিনির্ধারকরাও আশা করছেন। তাঁদের মতে, সহিংস রাজনৈতিক পরিস্থিতি পাশ কাটানোর জন্য এটাই সবচেয়ে ভালো পথ হতে পারে। তাঁরা আরো মনে করছেন, নির্বাচনকালীন সরকারের বিষয়ে রায়ে যে দিকনির্দেশনা দেওয়া হবে, সেটা মেনে নিতে সরকারি দল ও বিরোধী দল কারোরই আপত্তি থাকার কথা নয়।
সরকারের নীতিনির্ধারকরা আরো বলছেন, বিরোধী দল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে সোচ্চার হলেও তারা সরকারি দলের প্রস্তাব অনুযায়ী নির্দলীয় সরকার গঠনের বিষয়ে সম্মত হয়েছে। উভয় দলই যেহেতু তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা থেকে সরে এসেছে এবং আদালতও এই পদ্ধতির সরকারকে অবৈধ বলেছেন, কাজেই এখন এ-সংক্রান্ত মামলার লিখিত রায়ে যেভাবে দিকনির্দেশনা থাকবে, সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হলে কারো কোনো আপত্তি থাকবে না বলে তারা মনে করে। এ বিষয়ে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী-সংক্রান্ত মামলার রায় লিখছেন। রায়ে কিছু দিকনির্দেশনা থাকবে, সরকার সেই নির্দেশনাগুলো বাস্তবায়ন করবে। লিখিত রায়ে নির্বাচনের সময় সরকার পদ্ধতি, সরকারের কাঠামো কী হবে ইত্যাদি বিষয়ে দিকনির্দেশনা থাকতে পারে কি না এ-সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নির্দলীয় সরকার কিভাবে হবে সে বিষয়ে নির্দেশনা থাকতে পারে।
আইনমন্ত্রী বলেন, 'আদালত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অবৈধ বলে রায় দিয়েছেন। তাই ওই ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়ার আর সুযোগ নেই। একই সঙ্গে সাবেক প্রধান বিচারপতিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান না করার বিষয়েও বলে দেওয়া হয়েছে। সে ক্ষেত্রে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাঠামোও থাকছে না। কাজেই আমরা আশা করছি, লিখিত রায়ে একটি দিকনির্দেশনা থাকবে।' অন্য কোনো নামে এবং নতুন কাঠামোয় নির্দলীয় বা অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে নির্বাচন করার দিকনির্দেশনা থাকলে সরকার কি বিষয়টি সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করবে, এ-সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী বলেন, 'সংশোধনের মাধ্যমে বিষয়টি সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা না-ও লাগতে পারে। আবার প্রয়োজন হলে সংবিধান সংশোধন করা যাবে না, এমন তো নয়। প্রয়োজনে সংবিধান সংশোধন করা যেতেই পারে।'
প্রধান বিচারপতি তাঁর রায়ে জনগণের জানমালের নিরাপত্তার স্বার্থে আরো দুই দফায় এই পদ্ধতিতে নির্বাচন করার বিষয়ে যে বক্তব্য দেন, সে বিষয়টি সংবিধান সংশোধনের সময় সম্পূর্ণ উপেক্ষা করা হয়। সংক্ষিপ্ত রায়ের ভেতর থেকে শুধু তত্ত্বাবধায়ক সরকার অংশটুকু বাদ দিয়ে বর্তমান সরকার দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করার বিধান অন্তর্ভুক্ত করে সংবিধানে। পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের আগেই জাতীয় সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার সুবাদে তড়িঘড়ি বিল পাসের ফলে সরকার ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে। বিরোধী দল তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবিতে মরিয়া হয়ে নামে আন্দোলনে।
সরকারের একাধিক নীতিনির্ধারক কালের কণ্ঠকে বলেন, 'তড়িঘড়ি করে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী সুবিবেচনাপ্রসূত কাজ হয়নি। আর ত্রয়োদশ সংশোধনীর মতো জনগুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়ে রায়ের কপির জন্য আমাদের উচিত ছিল অপেক্ষা করা। রায়ের কপি হাতে পাওয়ার পর সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হলে কোনো বিতর্ক থাকত না। বিরোধী দল আন্দোলনের মতো কোনো ইস্যুই হাতে পেত না। তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল করে দিয়ে বিরোধী দলের হাতে আন্দোলনের ইস্যু তুলে দেওয়া হয়েছে।'
নীতিনির্ধারকরা আরো বলেন, আদালত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে অবৈধ বলেছেন। সেই সুযোগ নিয়ে তড়িঘড়ি করে সিদ্ধান্ত নেওয়ায় পুরো দায় সরকারের কাঁধে চলে এসেছে। এখন সেই দায় থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য সহজতম পথ হচ্ছে- রায়ের লিখিত কপি হাতে পাওয়ার পর সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া। এতে সরকারের ভাবমূর্তিই উজ্জ্বল হবে।
এ প্রসঙ্গে কথা বলতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, উচ্চ আদালতের পূর্ণাঙ্গ রায়ে অবশ্যই সমাধানের পথ থাকবে। এর আগে সরকারের আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদও বিরোধী দলকে বলছেন, ধৈর্য ধরুন, অস্থির হবেন না।
লিখিত রায়ে নির্দলীয় সরকার বিষয়ে নির্দেশনা থাকতে পারে- আইনমন্ত্রীর এই বক্তব্য প্রসঙ্গে রফিকুল ইসলাম মিয়া বলেন, 'পূর্ণাঙ্গ রায় না পেয়ে কেন সরকার তড়িঘড়ি করে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করল? এ প্রশ্ন শুধু আমাদের নয়, সারা দেশবাসীর।' তিনি বলেন, আট মাস সাত দিন অতিবাহিত হলেও পূর্ণাঙ্গ রায়ের কপি পাওয়া যায়নি। তাই বলব, সরকার সংকট সৃষ্টি করেছে, তাদেরই উচিত হবে সমাধানের পথ বের করা।' তবে এ নিয়ে কিছুটা দ্বিধাও আছে তাঁর। রফিকুল ইসলাম মিয়া বলেন, 'পূর্ণাঙ্গ রায়ের পর সরকার আবার কী করে বলা কঠিন।'

No comments

Powered by Blogger.