দূরদেশ-ওবামার গলার কাঁটা আফগানিস্তান by আলী রীয়াজ

আফগানিস্তান যুদ্ধ যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, বিশেষ করে ওবামা প্রশাসনের গলার কাঁটা হয়ে উঠেছে, এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। যুদ্ধ, সেনা প্রত্যাহার ও শান্তি আলোচনা—এগুলো পরস্পর বিচ্ছিন্ন না হলেও কোনো ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি গত কয়েক মাসে। ফলে বছরের গোড়া থেকেই ওবামা প্রশাসনের যে অস্বস্তি ছিল, তা অনেকাংশেই বৃদ্ধি পেয়েছে।

ওবামা প্রশাসন সম্ভবত এই আশা করেছিল যে স্থিতাবস্থা বজায় রেখে নভেম্বরে অনুষ্ঠেয় নির্বাচন পর্যন্ত পার করে দেওয়া যাবে। পররাষ্ট্রনীতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে নির্ধারক ভূমিকা পালন করে না, কিন্তু যুদ্ধ ও জাতীয় নিরাপত্তা প্রশ্ন সময়ে সময়ে ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্টের জন্য সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। অতীতে এই দুই প্রশ্নেই রিপাবলিকান পার্টি ডেমোক্র্যাটদের দুর্বল বলে প্রতিপন্ন করতে চেষ্টা করেছে এবং অধিকাংশ সময়েই সাফল্যও পেয়েছে। কিন্তু বারাক ওবামাকে এসব বিষয়ে বিপদগ্রস্ত করার মতো অবস্থা এবার ছিল না। তাঁর বিরুদ্ধে রিপাবলিকানরা সমালোচনা করলেও তা হালে পানি পায়নি একাধিক কারণে। এর মধ্যে অন্যতম হলো ওসামা বিন লাদেনকে হত্যা করার ব্যাপারে ওবামা প্রশাসনের সাফল্য। রিপাবলিকানরা ওবামার নীতির সমালোচনা করতে গিয়ে আরও যুদ্ধংদেহী ভাব প্রকাশ করে, যা সাধারণ মার্কিনরা খুব সমর্থন করেনি। অর্থনৈতিক সংকট এবং ইরাক ও আফগানিস্তানে দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধই এই অনাগ্রহের কারণ। গত কয়েক মাসে ইরাকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ বাধিয়ে তোলার জন্য যে চাপ তৈরি হয়েছিল, প্রশাসন তা নিয়ে সংকটে পড়ে যায়; তবে ওবামা আপাতত তা সামাল দিয়েছেন বলেই মনে হয়। এসব কারণে প্রশাসন সম্ভবত আশা করছিল যে আফগানিস্তানে স্থিতাবস্থা বজায় রাখাই যথেষ্ট। ২০১৪ সালের শেষ নাগাদ সেনা প্রত্যাহারের যে পরিকল্পনা রয়েছে, পুনর্নির্বাচিত হলে সে বিষয়ে মনোযোগ দেওয়ার কথা ভেবে থাকলে তা ওবামা প্রশাসনের দূরদৃষ্টিরই পরিচায়ক বলতে হবে।
কিন্তু গত দুই মাসেরও কম সময়ে অবস্থার দ্রুত অবনতি হয়েছে। ফেব্রুয়ারি মাসে মার্কিন সেনাদের কোরআন পোড়ানোর ঘটনায় ৩০ জন আফগান ও ছয়জন মার্কিন সেনা নিহত হওয়ার ঘটনার অভিঘাত শেষ না হতেই একজন মার্কিন সেনা কর্তৃক ১৬ জন নারী ও শিশুকে হত্যার ঘটনা ঘটল। সমসাময়িককালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে একজন আফগান সেনা কর্তৃক দুজন ন্যাটো কর্মকর্তাকে গুলি করে হত্যার ঘটনাও ঘটে। এসব পরিস্থিতি ওবামা প্রশাসনের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছে—প্রতিরক্ষামন্ত্রী লিওন প্যানেট্টার কাবুল সফর তারই প্রমাণ। বারাক ওবামা সর্বসাম্প্রতিক ঘটনার পর বলেছেন, সেনা প্রত্যাহারে যুক্তরাষ্ট্র তাড়াহুড়ো করবে না।
যুক্তরাষ্ট্র যে আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহার, বিশেষ করে প্রত্যক্ষ যুদ্ধে জড়িত সেনাদের প্রত্যাহারে আগ্রহী, তা বুঝতে কষ্ট হওয়ার কথা নয়। ন্যাটোর অন্যান্য শরিক দেশ ২০১৪ সালের পর কোনো অবস্থাতেই থাকবে বলে মনে হয় না। সে ক্ষেত্রে আর্থিকভাবে, কৌশলগত কারণে এবং সামরিক বিবেচনায় যুক্তরাষ্ট্র এককভাবে আফগানিস্তানে থাকতে অনাগ্রহী। কিন্তু প্রত্যাহারের পথ কী এবং পরবর্তী পর্যায়ে আফগানিস্তানে কী পরিস্থিতি হবে, সেটাই মার্কিন নীতিনির্ধারকদের উদ্বেগের বিষয়। মূল পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০১৩ সালের মাঝামাঝি আফগান সেনা ও অন্যান্য আফগান নিরাপত্তা বাহিনী প্রত্যক্ষ যুদ্ধের দায়িত্ব নেবে। কিন্তু আফগান সেনা ও অন্যান্য বাহিনী এ জন্য এখনো প্রস্তুত বলে মনে হয় না। তদুপরি ন্যাটো ও আফগান বাহিনীর মধ্যে যে আস্থা ও বিশ্বাসের অভাব তৈরি হয়েছে, তাতে অনেকের আশঙ্কা, তারা একত্রে খুব সাফল্য অর্জন করতে পারবে না। স্মরণ করা যেতে পারে, গত বছরগুলোতে আফগান নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে ৭০ জন ন্যাটো সেনা নিহত হয়েছে।
আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহারের লক্ষ্য অর্জনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের এযাবৎ গৃহীত পদক্ষেপের মধ্যে ছিল আফগানিস্তানের সঙ্গে একটি কৌশলগত চুক্তি বা ‘স্ট্র্যাটেজিক অ্যাগ্রিমেন্ট’ স্বাক্ষর করা। প্রায় এক বছর ধরে এ নিয়ে আলোচনা হলেও এ বিষয়ে আফগানিস্তানের দেওয়া শর্ত মানতে নারাজ হওয়ায় এটিও এখন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। সর্বসাম্প্রতিক ঘটনাবলির পর এ ধরনের চুক্তি আদৌ হবে কি না, সেটাই প্রশ্নসাপেক্ষ। যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো সেনা প্রত্যাহারের আগেই তালেবান ও আফগান সরকারের মধ্যে শান্তি চুক্তি সম্পাদন করতে চায়। কিন্তু এ নিয়েও অগ্রগতি খুবই সীমিত।
শান্তি চুক্তির ব্যাপারে তালেবান যোদ্ধাদের একাংশ আগ্রহী। তারা এ জন্য কাতারে একটি অফিসও খুলেছে। কাতার এ বিষয়ে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকাও নিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র নীতিগতভাবে তাতে রাজি। এই আলোচনার পূর্বশর্ত হিসেবে পাঁচজন তালেবান নেতাকে গুয়ানতানামোর বন্দিশিবির থেকে কাতারের জেলে পাঠাতেও যুক্তরাষ্ট্র রাজি হয়েছে বলে খবরে জানা গেছে। হামিদ কারজাই ও তাঁর প্রশাসন কাতারের মাধ্যমে তালেবানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের আলোচনায় প্রথমে বড় ধরনের আপত্তি তোলে। কারজাই চাইছিল সৌদি আরব ও আফগানিস্তান শান্তি কাউন্সিল এ বিষয়ে অগ্রণী ভূমিকা নিক। আলোচনা কাতারের বদলে সৌদি আরবে অনুষ্ঠিত হোক—কারজাই তা-ই চাইছিলেন। শেষাবধি কারজাই এই প্রক্রিয়ার ব্যাপারে নিমরাজি হয়েছেন। কিন্তু এ ধরনের আলোচনার সাফল্যের জন্য যতটা সময় দরকার, ততটা যুক্তরাষ্ট্রের হাতে আছে বলে মনে হয় না। তদুপরি বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে তালেবান ঘোষণা করেছে যে তারা মার্কিন যুক্তরাষ্টের সঙ্গে শান্তি আলোচনা স্থগিত করছে। তারা দাবি করেছে যে শান্তি আলোচনায় স্বচ্ছতার অভাব এবং অঙ্গীকার পূর্ণ করায় মার্কিনদের ব্যর্থতাই এর সিদ্ধান্তের কারণ। বিবৃতিতে তালেবান বলে যে আফগান সরকারের সঙ্গে কোনো শান্তি আলোচনায় তারা যাবে না। কেননা তারা মনে করে যে আফগানিস্তান বিদেশি বাহিনী দ্বারা অধিকৃত, আফগান সরকারের সঙ্গে শান্তি আলোচনা অর্থহীন।
আফগান-পাকিস্তানের সম্পর্কে টানাপোড়েন ও পারস্পরিক অবিশ্বাস পরিস্থিতির ইতিবাচক অগ্রগতিতে বাধা হয়ে আছে। সম্প্রতি ইসলামাবাদে ইরান পাকিস্তান-আফগানিস্তান শীর্ষ বৈঠকে আপাতদৃষ্টে ঐক্যের সুর শোনা গেলেও তার পরপরই পাকিস্তানি পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিনা রাব্বানি খার মন্তব্যে বোঝা যায়, দূরত্ব অনেক। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘আফগানিস্তান শান্তি-প্রক্রিয়ার জন্য পাকিস্তানের কাছ থেকে অত্যন্ত বেশি মাত্রায় আশা করে। আমরা কী ভূমিকা পালন করতে পারি, আফগানিস্তান তা স্পষ্ট করে বলেনি।’ এই মন্তব্য হিনা রাব্বানির। আফগানিস্তান চায়, পাকিস্তান তালেবান নেতাদের আলোচনার জন্য উৎসাহিত করুক এবং তাঁদের আলোচনাস্থলে উপস্থিত করুক। পাকিস্তানের বক্তব্য স্পষ্ট, ‘আমরা সেটা করতে পারি না। কেননা এদের সঙ্গে আমাদের কোনো যোগাযোগ নেই।’ এই নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে কিছু বলে রাজি করাতে পারবে, এমন আশা করাও বাতুলতা। তাদের সম্পর্কও ভালো নয়—ড্রোন হামলা তো আছেই, গত নভেম্বরে মার্কিনদের হাতে ২৪ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হওয়ার পর টানাপোড়েন বেড়েছে।
সব মিলিয়ে আফগানিস্তান যুদ্ধ অবসানে দ্রুত অগ্রগতির সম্ভাবনা খুব কম, নেই বললেই চলে। এই পরিস্থিতিতে নির্বাচনের বছরে পুনর্নির্বাচনপ্রত্যাশী বারাক ওবামা চান না যে আফগানিস্তান নিয়ে তাঁকে সমস্যায় পড়তে হোক। পুনর্নির্বাচিত হতে পারলে ওবামা প্রশাসন সম্ভাব্য দ্রুততার সঙ্গে এই যুদ্ধ অবসান করবে, সেনা প্রত্যাহার করবে, এমন কথাও নিশ্চিত করে বলা যায় না। তবে পরিস্থিতি যেদিকে এগোচ্ছে তাতে মনে হয়, এ নিয়ে ২০১৩ সালে আর কোনো বিকল্পই থাকবে না।
ইলিনয়, ১৪ মার্চ ২০১২
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক।

No comments

Powered by Blogger.