জলবায়ু পরিবর্তন ও বাংলাদেশ by শহিদুল ইসলাম

এক. ফ্রেডারিক সিটজ (Frederick Seity) একজন পদার্থবিজ্ঞানী। ১৯৬০ সালে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাতীয় একাডেমী অব সায়েন্সের সভাপতি ছিলেন। এককথায় তিনি একজন বিরাট মানুষ। ১৯৯৮ সালে তিনি বিশ্বের জলবায়ু পরিবর্তন এবং উঞ্চতা বৃদ্ধি সম্পর্কে এক বিরাট গবেষণা-প্রবন্ধ লেখেন 'ওরিগোন পিটিশন' নামে।

'জলবায়ু পরিবর্তন একটা মিথ'_যাঁরা এই তত্ত্বে বিশ্বাসী, তাঁদের কাছে ওই প্রবন্ধটি বাইবেল-তুল্য। এই তত্ত্বে বিশ্বাসী প্রায় সব বিশেষজ্ঞ ও সাংবাদিক ঘন ঘন তাঁর তত্ত্বটির উল্লেখ করেন। ওই পিটিশন মার্কিন সরকারকে উদ্দেশ করে লেখা। প্রবন্ধের মূল কথা : '১৯৯৭ সালের ডিসেম্বরে জাপানের কিয়োটোতে গৃহীত প্রস্তাবটির কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। কিয়োটোতে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের যে সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে, তা জলবায়ুর জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়ন ব্যাহত করবে। মানবজাতির ভাগ্য ও স্বাস্থ্যের ক্ষতি করবে। এমন কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই যে মানুষের তৈরি কার্বন ডাই-অঙ্াইড, মিথেন এবং অন্যান্য গ্রিনহাউস গ্যাস ভবিষ্যতে বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধি করবে এবং পৃথিবীর জলবায়ু ধ্বংস করবে। উপরন্তু যথেষ্ট বৈজ্ঞানিক প্রমাণ আছে যে বাতাসে CO2 গ্যাসের পরিমাণ বৃদ্ধি পৃথিবীর গাছ-পাতা-পশু-পাখিসহ জলবায়ুর প্রভূত উপকার করবে।' যার কোনো একটি ডিগ্রি আছে, তিনিই ওই দরখাস্তে সই করতে পারতেন। সিটজ তখন জর্জ সি মার্শাল ইনস্টিটিউটের সভাপতি। ১৯৯৮ সাল থেকে বিশ্বের বৃহত্তম করপোরেট এঙ্ন-মোবিলের কাছ থেকে ছয় লাখ ৩০ হাজার ডলার অনুদান পেয়েছে এ ধরনের গবেষণাকর্ম পরিচালনার জন্য। ২০০৫ সালে Exxon-Mobil-এর ত্রৈমাসিক লাভ সর্বোচ্চ ১০ বিলিয়ন ডলারে উপনীত হয়েছিল। বিশ্বের বড় বড় করপোরেট এ ধরনের অনেক গবেষণাগার পরিচালনা করে থাকে। সেখানে কর্মরত বিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী এককথায় বিজ্ঞ গবেষকরা করপোরেটতন্ত্রের ইচ্ছাপূরণের জন্য গবেষণা করেন। জলবায়ু পরিবর্তন এবং বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধি সম্পর্কে তাঁরা বড় বড় গবেষণা করে প্রমাণ করেন, 'বিজ্ঞান পরস্পরবিরোধী, এ বিষয়ে বিজ্ঞানীরা দ্বিধাবিভক্ত, পরিবেশবিজ্ঞানীরা মিথ্যাবাদী ও ভণ্ড।' এভাবে তাঁরা জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কে মানুষের চিন্তার মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করার অপচেষ্টা করেন। কাজেই গবেষণাকে দুভাবে ভাগ করা যায়। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত গবেষণা এবং সত্যিকার বৈজ্ঞানিক গবেষণা। ওই গবেষণাটি যে প্রথম ক্যাটাগরির একটি গবেষণাপত্র তার প্রমাণ পাওয়া যায়, দরখাস্তটি প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ন্যাশনাল একাডেমী অব সায়েন্স একটি বিবৃতি প্রকাশ করে সবাইকে জানিয়ে দেয় যে ওই দরখাস্তটি একাডেমীর বিশেষজ্ঞদের মতামত প্রতিফলিত করে না। সিটজ দরখাস্তের নিচে ন্যাশনাল একাডেমী অব সায়েন্সের সাবেক সভাপতি হিসেবে স্বাক্ষর করে জনমনে বিভ্রান্ত সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন। এ রকম বিপণনযোগ্য গবেষক-পণ্যে পৃথিবী ভরে গেছে।
দুই. এ রকম অবৈজ্ঞানিক আবর্জনা ছাপতে ব্রিটিশ প্রেসও কম যায় না। ২০০১ সালের ২৯ জুলাই 'Mail on Sunday' পত্রিকায় পিটার হিচেনস লিখেন, 'Global Warming? Hot Air and Hypocrisy'। তিনি লিখেন যে 'জর্জ বুশই ঠিক কিয়োটো সমঝোতা সময়ের অপচয় ছাড়া কিছু নয়। গ্রিনহাউস গ্যাসের সম্ভবত কোনো অস্তিত্ব নেই। এখন পর্যন্ত তার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।...বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণ সূর্য। নাসার গবেষণায় প্রমাণ হয়েছে যে গত ২২ বছরে আবহাওয়ার উষ্ণতা বৃদ্ধি হয়নি।' ২০০৬ সালের ১৩ জানুয়ারি মেলাইন ফিলিপস লিখেন, 'আবহাওয়া অবশ্যই উষ্ণ হচ্ছে, তার মানে এই নয় যে মানুষের তৈরি গ্রিনহাউস গ্যাসই তার জন্য দায়ী।' ২০০৩ সালে ওকলাহোমা থেকে নির্বাচিত সিনেটর জেমস ইনহোফে (রিপাবলিকান) সিনেটে আবহাওয়া পরিবর্তনে বিজ্ঞানের ওপর এক বক্তৃতায় বলেন, 'মানবসৃষ্ট গ্যাসই যে বিশ্বের উষ্ণতার বৃদ্ধির কারণ, তা ঠিক নয়_এ দাবির কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। CO2 পৃথিবীতে কোনো দুর্যোগ বহন করে আনবে না, বরং তা হবে আমাদের আবহাওয়া এবং অর্থনীতির জন্য মঙ্গল। মানবসৃষ্ট বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধিতে যে ভয়ভীতি, তা কেবল অবৈজ্ঞানিকই নয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মানুষের ওপর চাপানো সবচেয়ে বড় মিথ্যাচার_সবচেয়ে বড় ঠকবাজি।' আগেই বলেছি, গবেষণা দুই ধরনের : বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত গবেষণা। যুক্তরাজ্যের রয়্যাল সোসাইটি, আমেরিকার ন্যাশনাল একাডেমী অব সায়েন্স, রয়্যাল সুইডিশ একাডেমী অব সায়েন্সসহ বিশ্বের বড় বড় বৈজ্ঞানিক গবেষণাগার থেকে যে সিদ্ধান্ত বেরিয়ে আসে, তার সঙ্গে দ্বিতীয় ধারার গবেষণার কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। গত ৪০ বছরে সমুদ্রের উষ্ণতা কতটা বৃদ্ধি পেয়েছে তার ওপর একটি গবেষণাপত্র ছাপা হয় 'দি টাইমস' পত্রিকার ৭ নভেম্বর ২০০৩ সংখ্যায়। গবেষক রজার বয়েস জোর দিয়ে বলেন, 'উষ্ণতা বৃদ্ধির বিষয়টি এতটাই সত্য যে মানুষই সে বৃদ্ধি ঘটিয়ে চলেছে কি না, সে বিতর্ক বন্ধ করা উচিত।' ১৯৮৬ সালের ৩ মে তারিখের 'গার্ডিয়ান' পত্রিকায় মাইকেল হোয়াইটের একটি গবেষণা-ফল প্রকাশিত হয়। ৯২৮টি প্রবন্ধ পড়ে তিনি সিদ্ধান্তে আসেন যে 'বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধির বিষয়ে কেউই দ্বিমত প্রকাশ করেননি। রাজনৈতিক গবেষকরা এ ব্যাপারে মানুষের মনে সে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করতে চান। তিনি বলেন, তাঁদের প্রচারণা মিথ্যা।' যুক্তরাজ্যে বিখ্যাত বিজ্ঞান গবেষণাগার রয়্যাল সোসাইটি ২০০১ সালে একটি বক্তব্য প্রকাশ করে। বলা হয় যে 'বিশ্বের জলবায়ুর পরিবর্তন সম্পর্কে যখন একটা ঐকমত্যে পেঁৗছানো গেছে, তখন তা নিয়ে সম্প্রতি যে সন্দেহের বাতাবরণ সৃষ্টির প্রচেষ্টা চলছে, আমরা মনে করি তা যুক্তিযুক্ত নয়।' (The Science of Climate Change, Science, Vol. 292, 18 May, 2001, p.1261। সেই বক্তব্যে স্বাক্ষর করে বিশ্বের নামকরা ১৫টি গবেষণা সংস্থা। আমেরিকার বিজ্ঞান গবেষণাগার থেকে একই রকম বক্তব্য প্রকাশ করা হয়।
তিন. জলবায়ুর পরিবর্তন এবং মানবসৃষ্ট গ্রিনহাউস গ্যাসের ফলে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি সম্পর্কে পৃথিবী আজ একমত। তাই প্রতিবছর জলবায়ুর পরিবর্তন সম্পর্কে সর্বশেষ অবস্থা পর্যালোচনার জন্য গঠিত হয়েছে 'আন্তঃসরকারীয় প্যানেল'। 'জলবায়ুর পরিবর্তন' নামে একটি রিপোর্ট তারা প্রতিবছর প্রস্তুত করে। ২০০৭ সালের রিপোর্টে তারা বিশ্ববাসীকে সাবধান করে দেয় যে "ইতিমধ্যে পৃথিবীর বিস্তীর্ণ এলাকায় দীর্ঘকালীন তীব্র 'খরা' দেখা যাচ্ছে। গত তিন হাজার বছরে সমুদ্রপৃষ্ঠ গড়ে যে হারে স্ফীত হয়েছে, বর্তমানে সে হার 'কুড়ি গুণ' বৃদ্ধি পেয়েছে। গত ১২ বছরের মধ্যে শেষ ১১ বছর সবচেয়ে গরম বছর বলে প্রমাণিত হয়েছে।" জলবায়ুবিশারদদের সঙ্গে এক বৈঠকে টনি ব্লেয়ার ২০০৪ সালের ২৭ এপ্রিল বলেন, 'জলবায়ুর পরিবর্তনই আজ বিশ্ববাসীর প্রধান সমস্যা। ২০৩০ সালে বাতাসে কার্বন ডাই-অঙ্াইডের পরিমাণ যদি আজকের মতো থাকে, তাহলেও শিল্প বিপ্লবের আগের অবস্থা থেকে 2c তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাবে। দুই ডিগ্রির ওপরে গেলে পৃথিবীতে এক ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হবে। তাই তাপমাত্রাকে কিছুতেই 2c ওপরে যেতে দেওয়া যাবে না। সেটা সম্ভব একমাত্র যদি উন্নত বিশ্ব তাদের গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের মাত্রা ২০৩০ সালের মধ্যে ৯০ শতাংশ ছেঁটে ফেলে, কিন্তু কিয়োটো প্রটোকলে যাঁরা স্বাক্ষর করেছিলেন, তাঁরা ২০১২ সালের মধ্যে মাত্র ৫ দশমিক ২ শতাংশ ছেঁটে ফেলতে রাজি হন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাতেও রাজি হয়নি। তারা চীনের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে। এটা ঠিক যে চীনে জনপ্রতি ঈঙ২ গ্যাস নিঃসরণের মাত্রা দুইয়ের আশপাশে। কিন্তু উন্নত বিশ্বের তুলনায় তা অনেক কম। চীন বছরে গড়ে দুই থেকে সাত টন কার্বন ডাই-অঙ্াইড গ্যাস উৎপন্ন করে। আর যুক্তরাজ্য উৎপন্ন করে ৯ দশমিক ৫ ও যুক্তরাষ্ট্র ২০ টন। গত জলবায়ু সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জোর দিয়েই বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ হচ্ছে বাংলাদেশ। সমুদ্রের পানি যদি এক মিটার বৃদ্ধি পায়, তাহলে বাংলাদেশের শতকরা ২১ ভাগ জমি চিরকালের জন্য সমুদ্রতলে হারিয়ে যাবে। সবচেয়ে উৎপাদনশীল জমি ধ্বংস হবে এবং ১৫ মিলিয়ন মানুষ বাস্তচ্যুত হবে। ১৯৯৮ সালের মতো বন্যার প্রকোপ বাড়বে। ওই বছর ৬৫ ভাগ জমি প্লাবিত হয়েছিল। কৃষিজমি ধ্বংস হয়েছিল। ২০০৪ সালের মধ্যে বৃহত্তম দ্বীপ জেলার অর্ধেকটাই পানির নিচে চলে গেছে। ১ দশমিক ৬ মিলিয়ন মানুষ সেখানে বাস করে। আন্তঃসরকারীয় প্যানেল ২০০১ সালের রিপোর্টে এ তথ্য তুলে ধরে। গত কয়েক দিন আগে দৈনন্দিন জোয়ারের পানিতে হঠাৎ জেলার বিশাল অঞ্চল তলিয়ে গেছে। ভেঙে গেছে উপকূলীয় বাঁধের অংশবিশেষ। এটা এক অশনিসংকেত।
কোনো বিপদসংকেত ছিল না সেদিন, ছিল না কোনো জলোচ্ছ্বাস। ভোলা বহু আগে থেকেই আন্তর্জাতিক সমাজের কাছে পরিচিত। পাকিস্তান আমলে উপকূলীয় বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছিল। তাই দেখা দরকার, তারপর সমুদ্রের উচ্চতা বেড়েছে কি না! জোয়ারের পানি এমন অবস্থার সৃষ্টি করেছে, এমন নজির আর কখনো আছে কি না? পানির উচ্চতা যদি বৃদ্ধি পেয়ে থাকে, তাহলেই এমনটা হওয়া সম্ভব। উপনিবেশবাদের ৫০০ বছর এশিয়া, আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকা শোষণ করেছে। আজ বাতাসে গ্রিনহাউস গ্যাস ছেড়ে তারা আমাদের হুমকির মধ্যে ফেলেছে। ধনী দেশগুলো তার প্রাথমিক বিপদ কাটিয়ে ওঠার ক্ষমতা রাখে। আমরা রাখি না। তাই প্রথম আঘাতটা আমাদের ওপরেই এসে পড়ে।
লেখক : শিক্ষাবিদ

No comments

Powered by Blogger.