ঝুঁকিপূর্ণ ৩২১ ভবন ভাঙা হয়নি দুই বছরেও by আশরাফুল হক রাজীব

জরাজীর্ণ ও মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা রাজধানীর ৩২১টি ভবন দুই বছরেও ভাঙতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। অথচ এসব ভবন চিহ্নিত করে ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন খোদ প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে ২০১০ সালের ৭ এপ্রিল জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কাউন্সিলের বৈঠকে ওই সিদ্ধান্ত হয়েছিল।

আইলাদুর্গত এলাকায় খাবার পানির সংকট নিরসনের যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল তাও বাস্তবায়িত হয়নি। বাস্তবায়ন করা হয়নি নতুন ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণের সিদ্ধান্তও। প্রায় দুই বছর পর আজ রবিবার আবারও বৈঠকে বসবে কাউন্সিল।
রাজউক সূত্রে জানা গেছে, ৩২১টি ভবন মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। তা ছাড়া আরো পাঁচ হাজারের বেশি ভবন ঝুঁকিপূর্ণ। এসব ভবন উচ্ছেদের ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেই। অভিযোগ আছে, রাজধানীতে নিয়মনীতি লঙ্ঘন করে নির্মিত হচ্ছে অধিকাংশ ভবন। নির্মাণ ত্রুটির কারণে ভবন ধসসহ ছোট-বড় দুর্ঘটনা বেড়েই চলেছে। রাজধানীতে প্রায় বছরই এক বা একাধিক ভবন হেলে পড়া বা ভেঙে পড়ার ঘটনা ঘটছে। এতে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটে। দুর্ঘটনার পর কিছুদিন হৈচৈ হয়। নিয়ম রক্ষার মামলা ও তদন্ত কমিটি হয়। তারপর আর কিছুই এগোয় না। দুর্ঘটনার পর তাতক্ষণিকভাবে তৎপরতা দেখালেও এসব অনিয়ম প্রতিরোধের ব্যাপারে যথাযথ তদারকি ও নিয়ন্ত্রণ নেই রাজউকের।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কাউন্সিল হচ্ছে সর্বোচ্চ কমিটি। প্রধানমন্ত্রী এ কমিটির প্রধান। পানিসম্পদমন্ত্রী, বন ও পরিবেশমন্ত্রী, স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী, যোগাযোগমন্ত্রী, স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনামন্ত্রী, কৃষিমন্ত্রী, নৌপরিবহনমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী এ কমিটির সদস্য। মন্ত্রিপরিষদ সচিব কমিটির সদস্যসচিব। সেনাবাহিনী, বিমান ও নৌবাহিনীপ্রধানসহ সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয়ের সচিব এ কমিটির সদস্য। কমিটির বছরে একবার বৈঠকে বসার বাধ্যবাধকতা থাকলেও এবারের বৈঠক হচ্ছে প্রায় দুই বছর পর।
২০১০ সালের বৈঠকে রাজধানীর জরাজীর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ স্থাপনা চিহ্নিত করে তা ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্ত নেওয়ার কয়েক দিন পরই ঢাকা মহানগরে ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে থাকা ভবন খুঁজে বের করার জন্য গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় টাস্কফোর্স গঠন করে। টাস্কফোর্স ও রাজউক ৩২১টি ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করে। এরপর এসব ভবন সম্পর্কে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য তালিকা পাঠানো হয় ঢাকা সিটি করপোরেশনে। ঝুঁকিপূর্ণ ভবন ভেঙে ফেলার দায়িত্ব রাজউকের হলেও তা ঢাকা সিটি করপোরেশনে পাঠানো হয়। তালিকা পাঠানোর ১০ মাস পর এসব ভবন ভেঙে ফেলার জন্য তাগিদও দেওয়া হয়। কিন্তু সিটি করপোরেশন কোনো উদ্যোগ নেয়নি বলে জানা গেছে।
ভবনগুলো না ভেঙে তালিকা সিটি করপোরেশনে পাঠানোর কারণ জানতে চাইলে রাজউকের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে জানান, আইনগত জটিলতার কারণেই এসব ভবন ভাঙা হচ্ছে না। সবাই মনে করে ঝুঁকিপূর্ণ ভবন ভাঙবে রাজউক। আসলে তা নয়। স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) অধ্যাদেশ, ২০০৮-এর বিধি ১৭ অনুযায়ী বিপজ্জনক ইমারতের বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া সিটি করপোরেশনের এখতিয়ারভুক্ত। তবে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা তৈরি ও সুপারিশ প্রণয়নে রাজউক সহায়তা করেছে। গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট), ফায়ার সার্ভিস, ঢাকা সিটি করপোরেশন, গণপূর্ত অধিদপ্তর, পুলিশ, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন- এসব সংস্থার সমন্বয়ে রাজউক অতি ঝুঁকিপূর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা তৈরি ও যাচাই-বাছাই করে সিটি করপোরেশনে পাঠায়। এখনো সেই অবস্থায় রয়েছে বলে জানা গেছে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কাউন্সিলের গত বৈঠকে আইলা দুর্গত এলাকায় সুপেয় পানির প্রাপ্যতা নিশ্চিত করার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। ওই নির্দেশনাও বাস্তবায়িত হয়নি। উপকূলবর্তী কয়রা উপজেলায় সুপেয় পানির জন্য ২০টি পুকুর খনন করার কথা। এ পর্যন্ত জায়গাই নির্বাচন করতে পারেনি পানি উন্নয়ন বোর্ড। এ ছাড়া উপকূলীয় ১১টি উপজেলায় একটি করে পুকুর নির্বাচন করে পুনর্খননের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। খুলনার দাকোপ উপজেলার সুতারখালী ইউনিয়নে ২০০ ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে পুনর্বাসনের জন্য দুটি গ্রামকে দুর্যোগ সহনীয় করা হচ্ছে। এসব গ্রামেও বিশুদ্ধ ও সুপেয় পানি সরবরাহের কার্যক্রম হাতে নেওয়া হবে। এ ছাড়া আইলা উপদ্রুত এলাকায় সুপেয় পানির সংকট নিরসনে জাপানের সহায়তায় প্লান্ট স্থাপনের জন্য ১১৪ কোটি টাকার একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে।
ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের হাত থেকে উপকূলীয় জেলার জনগণকে বাঁচানোর জন্য সারা দেশে পাঁচ হাজার ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণের সিদ্ধান্ত থাকলেও তা এখনো বাস্তবায়ন করা হয়নি। বর্তমানে দুই হাজার ৮৫৩টি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র রয়েছে। সরকারি অর্থে আরো ১০০টি আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণের জন্য প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া বিশ্বব্যাংক, ইসলামী ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (ফায়েল খায়ের কর্মসূচি), ইউএসএইড এবং অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার অর্থায়নে আরো ৫৫০টি আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে ২৫০টি পুরনো আশ্রয়কেন্দ্র ও গবাদিপশু আশ্রয়স্থল হিসেবে নির্মিত মাটির কিল্লা সংস্কারের কাজ শুরু হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.