চরাচর-চা শ্রমিক হত্যাদিবস by দীপংকর ভট্টাচার্য লিটন

আজ চা শ্রমিক হত্যাদিবস। ১৯২১ সালের এই দিনে নিজ আবাসভূমিতে ফিরে যেতে চেয়েছিল চা শ্রমিকরা। কিন্তু ব্রিটিশ সরকারের বাধার কারণে তাদের সেই যাত্রা সফল হয়নি। বিদ্রোহী চা শ্রমিকদের চাঁদপুর জাহাজঘাট থেকে ফিরে আসতে হয়েছিল। আর যারা নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্তে অটুট ছিল, তাদের প্রাণ দিতে হয়েছিল পুলিশের গুলিতে।

সেদিন চা শ্রমিকদের একটাই দাবি ছিল, ইংরেজ মালিকদের অধীনে তারা কাজ করবে না। পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতাব্দীতে একমাত্র চীন ছাড়া পৃথিবীর অন্য কোথাও চায়ের প্রচলন ছিল না। বাংলাদেশে অনেক পরে পরীক্ষামূলকভাবে সিলেটের মালনীছড়ায় চায়ের চাষ করা হয়। তখন ভারতবর্ষ ছিল ইংরেজদের দখলে। ভারতবর্ষে বিশেষভাবে আসামের ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় এবং সুরমা উপত্যকার সিলেট ও কাছাড় জেলায় দিনের পর দিন চায়ের উৎপাদন ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকে। আর যেখানেই উৎপাদন সেখানেই শ্রমের প্রশ্ন। তখন ইংরেজ কম্পানির চা বাগান মালিকরা কম দামে শ্রম কিনে অধিক মুনাফা লাভের লক্ষ্যে আজীবন কাজের শর্তে চুক্তিবদ্ধ করে মধ্য ভারতের দুর্ভিক্ষ-পীড়িত সাঁওতাল, মুণ্ডা, কোলবিল, লোহার, কুর্মী, ভূমিজ প্রভৃতি আদিবাসী গোষ্ঠীর শ্রমিকদের বিহার, উড়িষ্যা, মাদ্রাজ, উত্তর প্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, বাকোরা প্রভৃতি অঞ্চলের গরিব চাষিদের চা শ্রমিক হিসেবে এ দেশে নিয়ে আসে তারা। তাদের মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে বলা হতো, 'চা গাছে ধরে নাড়া দিলেই টাকা ঝরে।' আসাম সিলেট অঞ্চলের ইংরেজ মালিকানাধীন বিভিন্ন চা বাগানে নামমাত্র মজুরিতে তাদের নিয়োগ দেওয়া হয়। শ্রমিকদের মজুরি এতই কম ছিল যে দিনশেষে প্রাপ্য মজুরি দিয়ে একবেলা খাবার জোগাড় করাও তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। চাবুক ও বুটের লাথি ছিল চা শ্রমিকদের নিত্যসঙ্গী। এই অসহনীয় অবস্থার পরিবর্তনের জন্য বিদ্রোহী হয়ে ওঠে চা শ্রমিকরা। এদিকে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনও দানা বাঁধতে থাকে ভারতজুড়ে। সেই আন্দোলনে অনুপ্রাণিত হয়ে চা শ্রমিকদের শোষণবিরোধী আন্দোলন সাম্রাজ্যবাদবিরোধী জাতীয় মুক্তির আন্দোলনের অংশ হয়ে দাঁড়ায়। শোষণ, নির্যাতন ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে চা শ্রমিকরা কাজ ছেড়ে দিয়ে নিজ আবাসভূমিতে ফিরে যাওয়ার আওয়াজ তোলে। ১৯২১ সালে কাছাড় ও সিলেট অঞ্চলের প্রায় ৩০ হাজার চা শ্রমিক এই আন্দোলনে অংশ নেয়। বিদ্রোহী চা শ্রমিকরা স্ত্রী, পুত্র ও পরিজন নিয়ে রেলপথ ধরে হাঁটতে থাকে চাঁদপুরের উদ্দেশে। শত কষ্ট করে তারা জমায়েত হয় চাঁদপুর জাহাজঘাটে। ২০ মে কলকাতা যাওয়ার উদ্দেশে চা শ্রমিকরা জাহাজে উঠতে চাইলে তাদের ওপর শুরু হয় পুলিশের গুলিবর্ষণ ও পৈশাচিক নির্যাতন। বাগান কর্তৃপক্ষ বিদ্রোহী চা শ্রমিকদের বাধা দিতে আগে থেকেই সরকার পক্ষের কমিশনার কিরণ চন্দ্র দে ম্যাজিস্ট্রেট সুনীল সিং এবং ইংরেজ মালিকদের প্রতিনিধি ফার্গুসনকে চাঁদপুরে পাঠায়। গুর্খা রেজিমেন্ট ও গুর্খা সৈন্যরা আক্রমণ চালিয়ে চাঁদপুর রেলস্টেশনে শত শত অসহায় চা শ্রমিক ও তাদের পরিজনকেও হত্যা করে। নিহত চা শ্রমিকদের লাশ ভাসিয়ে দেওয়া হয় মেঘনায়।
দীপংকর ভট্টাচার্য লিটন

No comments

Powered by Blogger.